বিএনপি কি বোঝে না, সেটাই বোঝে না

bnp-final1

by zainuddin sani  বেশ একটা যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি। তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই নড়বড়ে দল নিয়ে ভাঙাচোরা একটা আন্দোলন চালাবে? না জনগণকে সম্পৃক্ত করার নতুন কোন প্রচেষ্টা নেবে। জনগণ আশার আলো দেখতে পায়, এমন কিছু করবে। এখন পর্যন্ত তাঁরা যা করেছে, তা ছিল গতবছরের সেই হরতাল আর অবরোধ দিয়ে শীতকাল পার করবার চেষ্টার একটি ব্যর্থ ফটোকপি। সবার মনে তাই প্রশ্ন, এভাবেই চালাবে? না মাথায় নতুন কোন প্ল্যানিং আছে? প্রশ্ন অবশ্য আরও একটা আছে, নতুন কিছু করবার মতো মেধা কিংবা ক্ষমতা তাঁদের আদৌ আছে কি না? ছাত্র সংগঠন কিংবা দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব বলে তাঁদের কিছু আছে কি না? কিছু উত্তর দেশবাসী পেয়ে গেছে, বাকীটা সম্ভবতঃ আগামী কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

বিগত কিছুদিনের কার্যক্রমে আন্দোলনে কিছুটা গতি এসেছিল। আর সেকারণে, অনেকেই গাজীপুরের দিকে তাকিয়েছিল। তবে ২৭শে কি হবে, এই নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য উৎসাহ জাগানো ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেনি বিএনপি। এভাবে পিছু হটবে, সম্ভবতঃ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও ভাবেনি। ফখরুল সাহেবের হুমকি যে সিরিয়াসলি নেয়াড় মত কোন জিনিস না, তা দেশবাসী বুঝে গেছে। যতটুকু যা আস্থা ছিল, তা ছিল বিএনপি নেত্রীর প্রতি। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি তাঁর সেই পুরনো মূর্তিতে ফিরে আসছেন। যেভাবে তিনি মাঠে নেমেছিলেন, একের পড় এক সমাবেশ করছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, এবার আর বালির বস্তা দিয়ে আটকানো যাবে না।

ভুল ভাঙতে সময় লাগল না। আন্দোলন থামাতে এবার বালির বস্তাও লাগলো না। বাহ্যিকভাবে যদিও মনে হচ্ছে ১৪৪ ধারা আর ছাত্রলীগের ‘নেড়ি কুত্তা’ হুমকিই খেল দেখাল। তবে ভেতরের খবর আরও করুণ। গাজীপুরের নেতাদের ‘অসম সাহস(?)’ আর দলীয় কোন্দল এবার আওয়ামীদের কাজ সহজ করে দিয়েছে। বালির বস্তা আনবার খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে বক্সী বাজারের ‘নেড়ি কুত্তা’র ইফেক্টও কাজে দিয়েছে। দল হিসেবে বিএনপির তেমন কোন সম্মানজনক অবস্থান না থাকলেও, বিএনপি নেত্রীর ছিল। সেই দৃঢ় ইমেজে এবার বেশ বড়সড় ধাক্কা লাগলো।

দল হিসেবে বিএনপির এই অসম্মানজনক অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। পুরো আওয়ামী আমলটাতেই, সরকার বিরোধী আন্দোলনে, বিএনপির ‘পারফর্মেন্স’ ছিল বেজায় হতাশাজনক। প্রথম আওয়ামী আমলে তেমন কোন আন্দোলন কিংবা সাফল্য না থাকলেও তাঁদের সমস্যা এতো প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি। সেই অসফল আন্দোলন তেমনভাবে কারো চোখেও পড়েনি আর তাতে তেমন কোন সমস্যাও হয়নি, কারণ পরবর্তী নির্বাচনে জয় এসেছিল। সেই যাত্রা পার পেয়ে গেলেও দুর্বলতাটা থেকেই গিয়েছিল। এবারের আন্দোলনেও তাঁরা তেমন কোন নতুনত্ব আনতে পারেনি। যা করেছে, তা হচ্ছে আওয়ামীদের আন্দোলনের ফটোকপি। সেই হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর আর জ্বালাও পোড়াও। হরতালের বাজারদর কমে যাওয়া আর ভাংচুর এবং পেট্রোল বোমায় সাধারণ মানুষের মৃত্যু, এবার সমস্যায় ফেলেছে বিএনপিকে।

হরতালের বদলে দেয়ার মত হাতে তেমন নতুন কোন কর্মসূচিও নেই। মানব বন্ধন কিছু দিয়েছিল, তবে সেখানে তেমন কোন গ্ল্যামার নেই, ওটা অনেকটা সুশীল সমাজ সুশীল সমাজ ভাব এনে দেয়। খুব ভালো কাভারেজও জোটে না, ফলে সেই লাইনে এগিয়েও খুব বেশি সাফল্য আসেনি। সমাবেশের নাম পাল্টে, বিক্ষোভ সমাবেশ করেও তেমন কোন লাভ হয়েছি কিনা সন্দেহ। ফলে ঘুরে ফিরে সেই হরতাল আর মিছিল। আর অতি ব্যবহারে এই মহার্ঘ অস্ত্রের প্রতি জনগণ আর দলীয় কর্মীদের মধ্যে এসেছে এক বেশ দায়সারা ভাব। হরতালের এই কর্মক্ষমতা হারানো আর বিকল্প কিছু না পাওয়া, সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে বিএনপিকে।

চিন্তার দৈন্যতার চরম প্রকাশ করলেন বিএনপির জনৈক নেতা। আওয়ামীদের ‘লগি-বৈঠা’ নকল করে ‘দা-কাস্তে’ বলে বেশ বড়সড় ঝামেলা বাঁধালেন। এরপরে বেশ কিছুদিন তিনি লাপাত্তা হয়ে থাকলেন। বিএনপির নেতারা, ‘নিজস্ব মতামত’ বলে দূরত্ব তৈরি করলেন। ঢাকা মহানগরে আগে থেকেই দলীয় কোন্দল ছিল, সেখানে কিছু হাওয়া লাগলো। খোকা সাহেবকে কোণঠাসা করবার এই সুযোগ, অন্য পক্ষ হাতছাড়া করল না। পুরো ঘটনার সারাংশ যা দাঁড়াল, তা হচ্ছে, দলীয় কোন্দলের সাথে সাথে বিএনপির চিন্তার দৈন্যতা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠল।

এদেশে আন্দোলন করবার সময় হচ্ছে এই শুষ্ক মৌসুমটা। হাতে আছে আর বড়জোর তিনমাস। এই সময়ের ভিতর বিএনপি কিছু করতেন না পারলে পিছিয়ে যাবে এক বছর। কারো কারো মতে পুরো চার বছর। যত সময় যাচ্ছে, ততোই প্রশ্ন জাগছে, এই শীতকালে কিছু করতে বিএনপি কি পারবে? কিছুদিন আগের ‘কতোটা সফল হবে’ থেকে আলাপ আলোচনা সেই প্রথম ধাপেই ফিরে এসেছে ‘বিএনপি আদৌ কিছু করতে পারবে কি না?’ ২৭ তারিখের পরে, এই উত্তর কমবেশি এখন সবাই জানে। টক শো আর বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় বেশ অনেক বুদ্ধিজীবীই এখন ভবিষ্যৎ করনীয় নিয়ে উপদেশ দেয়া শুরু করেছেন। আসলে বিভিন্ন ভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, এভাবে হবে না। হয়তো বিএনপি নিজেও জানে, তাঁদের কিছু করার ক্ষমতা নাই। তবে যেটা জানে না, তা হচ্ছে, এর কারণ।

একথা ঠিক যে আওয়ামীদের এমন কোন জনপ্রিয়তা এখন নেই। ৫ই জানুয়ারী নির্বাচনকে প্রথমে বেশ কিছুদিন সফল নির্বাচন বলে চালানোর চেষ্টা করলেও সম্প্রতি তাঁরা সুর পাল্টেছে। এখন তাঁরা সেই গণতন্ত্র হত্যাকে সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতা বলে চালানোর চেষ্টা শুরু করছেন। ভাষার এই পরিবর্তন থেকে হয়তো কিছুদিন আগেও বিএনপির মনে আশা জেগেছিল, হয়তো ভাবছিল, আন্দোলন ভালমত করতে পারলে, কপালে শীকে ছিঁড়তে পারে। এখন পর্যন্ত তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না আর বোদ্ধা মহলও বলছেন, বিএনপির যে সাংগঠনিক অবস্থা আর দলীয় কোন্দল, তাঁদের দিয়ে তেমন কোন আন্দোলন সংগঠিত হওয়া সম্ভব না।

এর আগের বিভিন্ন সরকার বিরোধী আন্দোলনে, সাধারণ জনতা, হয় নিজেই মাঠে নেমেছিল আর নয়তো মৌন সম্মতি দিয়েছিল। এবার দুটোর কোনটাই ঘটছে না। পুরো আন্দোলনকে তাঁরা দেখছে, দুই দলের ক্ষমতায় যাওয়ার কামড়াকামড়ি হিসেবে। চর দখলের এই প্রতিযোগিতায় কেউই অংশ নিতে রাজী না। আন্দোলন করে, আওয়ামীদের গদি থেকে নামাবার পরে কি? কি পাবে তাঁরা? এই উত্তরে জনগণ দেখতে পাচ্ছে সেই একই হতাশা। আরেকটি স্বৈরাচারী সরকার, শুধু নেত্রীর নাম পরিবর্তন।

জনগণকে যদি পাশে পেতে চায়, বিএনপিকে প্রথমে বুঝতে হবে, জনগণ কি চায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁদের নেতার অবস্থান মুখস্থ করানো নিয়ে জনগণ বেজায় বীতশ্রদ্ধ। প্রয়াত নেতাদের পূজা করা এবং জনগণকে সেই পূজা করতে বাধ্য করার এই প্রবণতার একটি ইতি টানবার চেষ্টা তাঁরা দেখতে চায়। ছাত্র সংগঠনের উদ্দাম অস্ত্র নৃত্য কিংবা দুর্নীতির কড়াল গ্রাস থেকে মুক্তি চায়। ক্ষমতায় গেলে করব, এই ফর্মুলা থেকে বেড়িয়ে এসে, এখনই কিছু করার প্রচেষ্টা দেখতে চায়। ‘ওদের আমলে কি হয়েছে?’ এই যুক্তিতে নিজেদের অন্যায় চালিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতার অবসান দেখতে চায়।

অলৌকিক কিছু না ঘটলে, এই সাংগঠনিক অবস্থানিয়ে বিএনপির পক্ষে সফল কোন আন্দোলন করা সম্ভব না। এই তথ্যটা বিএনপি বুঝে গেছে। তবে যেটা বোঝেনি, তা হচ্ছে, কেন তাঁদের এই অবস্থা। জনগণের আকাঙ্ক্ষা বোঝার যে অক্ষমতা আওয়ামীদের ভেতর এখন কাজ করছে, তা তাঁদের ভেতরেও কাজ করছে। গদি থেকে আওয়ামীদের সরিয়ে বিএনপিকে বসাতে কেউই আগ্রহী না। স্বৈরতান্ত্রিক ফরম্যাটের সরকারের শুধু নেত্রী পরিবর্তনের জন্য কোন জনগণই মাঠে নামবে না। বিএনপির কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা জনগণের এই সরল প্রত্যাশাটা এখনও বোঝেনি। বিএনপির এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা কি বোঝেনা, সেটাই বোঝেনা।