By Faysal Kabir Shuvo
দূঃখজনক হলেও সত্যি যে স্বৈরাচার পরবর্তী প্রতি সরকারের শেষ সময়ের মতোই এই মূহুর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অংগনের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় হলো নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা। বলাবাহুল্য এইবারের সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে বর্তমান সরকারের অনেকটা ‘জোর জবরদস্তি’ আচরনের কারনে। হঠাত করেই নির্বাচনী এজেন্ডা বহির্ভূতভাবে এবং একক সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে বিরোধী দলের সাংসদদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে মাত্র ৪ মিনিটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এরপর থেকেই প্রধান বিরোধী দল সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেনীর সুশীল ব্যক্তিবর্গ এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ‘ক্ষমতা্য যাওয়া’ কেন্দ্রিক বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাই সরকার বিরোধী রাজনীতির অন্যতম ইস্যুই তাই হয়ে পড়েছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পূনর্বহাল’ করার দাবী। এমনকি বর্তমান আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধী দল শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার কারন হিসেবে অনেকেই মনে করেন আওয়ামী লীগের সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাবার আন্দোলনকে গুরুত্ব বেশি দেয়া। এতো আগে থেকে এই বিষয় নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেও সরকার এ সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নেবার কারনে এই মূহুর্তে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ দেশের একটি অন্যতম হট টপিক বলাবাহুল্য এইখানে স্পষ্ট দুইটা অবস্থানঃ বিরোধী দল এবং তার কট্টর সমর্থকেরা ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ বা একটা ‘লেভেল প্লেইং’ নির্বাচনকালীন অবস্থার জন্যে এক দফা দাবিতে অনড় এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের সমর্থকেরা আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে একাট্টা হয়ে আছে। এই ‘ডেডলক’ অবস্থার মধ্যে গত ১৭ অক্টোবরে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী সব দলের সংসদ সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের নাম দেবার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছেন।
যদিও একটা ‘লেভেল প্লেইং’ নির্বাচনকালীন অবস্থার জন্যে চুড়ান্ত আন্দোলন শুরু করার প্রাক্কালে বরাবর কঠোর অবস্থানে থাকা প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব তাদেরকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে, কারন সরকারের সমালোচক অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এই আহবান ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। কিন্তু তারপরও অনেক শংকার জায়গা এই প্রস্তাবে এখনো রয়ে গেছে। তার চেয়েও বড়কথা প্রধান বিরোধী দল বি এন পি এবং তার একনিষ্ঠ কর্মীবাহিনী বিভিন্ন সরকারী অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে দীর্ঘসময় সহিংসতা এড়িয়ে যে ইস্যু নিয়ে একটা চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছে তা যেন হঠাতই বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। আপাত দৃষ্টিতে এখন বি এন পি এর সামনে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ২ টা দৃশ্যমান অপশন দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আসলে বি এন পি এর কি করা উচিত সেই বিষয়েই কিছু চিন্তা শেয়ার করতে চাই।
অপশন ১- নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী নিয়ে আন্দোলন।
এই দাবীর মূল কারন হলো একটা ‘লেভেল প্লেইং’ নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু ২০০১ পর্যন্ত সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে কেয়ারটেকার প্রধান করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতি ছিলো, সেই সিস্টেম চালু করা হলেও বি এন পি এর জন্যে লেভেল প্লেইং ফিল্ড হবেনা। সেইক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো সামনে আসে- এই মূহুর্তে ‘অধুনাবিলুপ্ত’ তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম পূনর্বহাল করা প্রাগমাটিক হবে কিনা? কাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করা হবে? যাকে করা হবে সে কি শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ ভাব বজায় রাখতে পারবে বিশেষ করে যেখানে প্রশাসনকে কয়েক স্তরে আওয়ামী লীগ নিজের মত করে সাজিয়েছে বলে অনুধাবন করা হচ্ছে? সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম পূনর্বহাল হলেই যে তা ‘লেভেল প্লেইং’ ফিল্ড নিশ্চিত করবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়না।
এইরকম কিছু হলে বিরোধী দলের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া ইস্যু নিয়ে আন্দোলনটা মাঠে মারা যাবে এবং ইতিহাসে অন্যতম ব্যর্থ বিরোধী দল হিসেবে আলোচিত হবে।
অপশন ২- নির্বাচন কালীন সর্বদলীয় সরকার ব্যবস্থায় রাজী হওয়া
যে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচঙ্কালীন সরকার নিয়ে বরাবরই বি এন পি এর দাবীকে অগ্রাহ্য করে এসেছে তার কাছে থেকেই হঠাত এই সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বড় যে সমস্যা সেটা হলো এই সরকারের প্রধান কে হবে। নির্বাচনকালীন কোন সরকারের প্রধান হবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেটা বি এন পি এর মেনে নেবার কোন কারনই নেই। শুধু বি এন পি নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সচেতন কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান রেখে কোন নির্বাচনকালীন সরকার মেনে নিবেনা। কিন্তু শুধু সরকার প্রধানই একটা ইস্যু না এই ধরনের সরকারে। দীর্ঘ ৫ বছর আইন শৃংখলা বাহিনী যারা একটা ‘ফেয়ার’ নির্বাচনের জন্যে অতীব গুরুত্বপূর্ন, তাদের যে মন্ত্রনালয় নিয়ন্ত্রন করেছে সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব কে পাবে? স্থানীয় সরকার প্রশাসনের যারা নির্বাচনে প্রভাব করার সুযোগ পায় তাদের নিয়ন্ত্রনে ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের’ দায়িত্ব কে পাবে? এই জায়গাগুলো এখন পরিষ্কার না।
একইভাবে এই সর্ব্দলীয় সরকার কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে বা গত ৫ বছরে চরম নিপীড়নের স্বীকার বি এন পি এর কতখানি আস্থায় আসতে পারবে সেটাও বিশাল এক অনিশ্চয়তা।
সাধারন মানুষের দাবীর কি দাম নেই??
এ কথা সত্য যে সম্প্রতি বিভিন্ন নিরপেক্ষ জরীপে দেশের বেশিরভাগ মানুষের মতামত এসেছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার। কিন্তু এই রেজাল্ট এসেছে প্রশ্নের সুত্র ধরে। জরীপের অপশন যদি ‘আওয়ামী লিগের অধীনে নির্বাচন’ নাকি ‘সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’ হিসেবে থাকতো- তাহলে হয়তো পরের অপশনে বেশি উত্তর আসতো। আবার এটাও অমূলক না যে এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব একটা সময়ক্ষেপনের অযুহাত।
সুতরাং, এই মূহুর্তে যদি বি এন পি তাদের প্রধান দাবী (অপশন-১) নিয়ে সোচ্চার হয় তাতে যেমন অনিশ্চয়তা আছে তেমনি আছে প্রচুর সংঘাত ও প্রানক্ষয়ের সম্ভাবনা। আবার দ্বিতীয় অপশন অনুযায়ী বি এন পি এখন প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে আমলে নিয়ে নিজেদের ক্যাপাসিটির মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্ঠা করতে পারে যাতে একটা সাম্যাবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠা হয় এবং প্রশাসন যেন ‘আনবায়াসড’ হয়ে কাজ করে। সরকার তখন যদি তাদের দাবী না মানতে চায় তাহলে আর কি করার- রাজপথেই সমাধান খুজতে হবে।
তবে বি এন পি যেহেতু এখনো প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের ব্যাপারে কোন আনুষ্ঠানিক সাড়া দেয়নি, আশা করা যায় তারাও একটু অনুরুপ এবং গ্রহনযোগ্য প্রস্তাব নিয়ে আসবে।