ধরা যাক আমি পোকার খেলছি। ব্লাইন্ড বেট। খুব আজব এক বেটের কথা কল্পনা করি। বাংলাদেশের সব কার্টুনিস্ট আমার কার্টুন এঁকেছে, সবাই। আমি কেবল একটা কার্টুন কিনতে পারবো এবং সেই কার্টুনটা আমাকে কিনতে হবে গাটের পয়সা খরচ করে – ১০ হাজার টাকা দাম – কিন্তু কার্টুনটা না দেখে কিনতে হবে। সেজন্যেই ব্লাইন্ড বেট।
এখন আমার কল, ইন করবো না ফোল্ড?
আয়েম ইন – চোখ বন্ধ করে কিনে ফেলবো মেহেদীর আঁকা কার্টুন।
যদি মেহেদীর আঁকা কার্টুন না থাকে, তখন কারটা কিনবো?
আই’ল ফোল্ড, গ্রেশাসলি।
য়েস ইট ইজ দ্যাট সিম্পল। মেহেদী বাংলাদেশের বেস্ট এডিটরিয়াল কার্টুনিস্ট, পিরিয়ড।
তাই কি?
যতো ধরনের ভিজুয়াল আর্ট ফর্ম আমরা প্রত্যক্ষ করি বাংলাদেশে, তার মধ্যে ওপরের দিকেই থাকবে কার্টুন। প্রায় সব পত্রিকাই এডিটরিয়াল কার্টুন ছাপে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের এডিটরিয়াল কার্টুন কি টেকনিক, কি কন্টেন্ট সব দিক থেকেই নিম্ন মানের। এ কথাটি অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলে আমার আর্টিস্ট বন্ধুদের রোষ থেকে বাচা যেত কিন্তু ফ্যাক্ট অফ দা ম্যাটার ইজ – আমাদের কার্টুনিস্টরা ভালো কাজ করতে পারেন না অথবা করেন না।
এর প্রথম কারণ হোলো টেকনিক। যারা নিয়মিত কাজ করেন এর মধ্যে চার-পাঁচজন ছাড়া কারো ড্রয়িং নিঁখুত না। যাদের ভালো তারা আবার টেকনিক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন না। কখনো দেখেছেন শিশির এডিটরিয়াল কার্টুন অয়েল পেইন্ট কিংবা এক্রিলিকে করছেন? কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ছড়াছড়ি তাই কেউ আর ওয়াটার কালার করেন না (ওয়াটার কালার করতে সময় লাগে), কখনো সখনো শুধু ক্রেয়ন, পেন- ড্রয়িং, প্যাস্টেল এসব কাজ চোখে পড়ে। কোনো কার্টুনে কোনো টেক্সচার নেই – সব ফ্ল্যাট। কমিক্সের গ্রাফিক ইলাস্ট্রেশান আর এডিটরিয়াল কার্টুনের মধ্যে পার্থক্য না থাকলে কীভাবে হয় বলুন?
কিন্তু
টেকনিক খুব ভালো না হলেও খুব ভালো কার্টুন করা সম্ভব যদি অডিয়েন্সের এবং অবশ্যই ঐ জাতির একটা ভিজুয়াল হিস্ট্রি থাকে এবং কার্টুনিস্টের ঘটে ঘিলু থাকে। প্রথমটা আমাদের নেই, দ্বিতীয়টার ব্যাপারে জেনারেলাইজেশানের উপায় নেই। আপনি যখন কার্টুন আঁকবেন তখন আপনার রেফারেন্সের দরকার হয়। এই রেফারেন্স কখনো আসে বিখ্যাত আর্টওয়ার্ক (ফিগার:১) থেকে , কখনো বা পপ কালচারের আইকন (ফিগার:২) থেকে, কখনো ফিল্মের কোনো দৃশ্য থেকে (ফিগার:৩)। আমরা বাংলাদেশীরা বেশী না, পঞ্চাশের দশকে কী পোশাক পরতাম তা জানি না, চল্লিশের দশকে বন্ধুরা রেগে গেলে মাদারচোদ গালি দিতো কি না তা জানি না এমন কি আমি বাজি ধরে বলতে পারি বড় পর্দায় ঢাকা শহরের ৮০’র দশকের সার্থক রিক্রিয়েশান করতে পারবে এমন কোনো আর্ট-ডিরেক্টর বাংলাদেশে নেই (দেখা যাবে ৮০’র দশকের ঢাকা কিন্তু সেখানে ২০১২’র মডেলের গাড়ী)। এরকম রেফারেন্সহীন পাঠকের জন্য পলিটিকাল কার্টুন আঁকা খুব সহজ না।
তার ওপর আছে অডিয়েন্সকে ভোদাই ধরে নিয়ে কার্টুন করার বাধ্যবাধকতা। মোরসালিনের কার্টুনটা (ফিগার:৪) দেখলেই বুঝবেন আমি কী বলছি। চমৎকার কনসেপ্ট, এগজেকিউশান নীট, কিন্তু কার্টুনিস্ট পাঠকের ইন্টেলেক্টের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না, তাই একটা ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়েছেন। এবং এই ব্যাখ্যাটা দিয়েই তিনি একটা চমৎকার কার্টুনের সর্বনাশ করেছেন। লেট য়োর অডিয়েন্স ইন্টারপ্রেট য়োর ওয়ার্ক।
কিন্তু এসব শেষ বিচারে বাংলাদেশী এডিটরিয়াল কার্টুনের নিম্ন মানের সব থেকে বড় কারণ না। মূল কারণ হলো আমাদের কার্টুনিস্টদের মনস্তত্ব। এক অদ্ভুত কারণে তারা প্রচণ্ড সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুভব করেন এবং নিজেদের কার্টুনিস্ট না ভেবে শিক্ষক এবং সমাজ সংস্কারক ভাবতে শুরু করেন। মজা করার বদলে জ্ঞান দেয়া হয়ে যায় মূল লক্ষ্য। বদলে দাও, বদলে যাও এই ধরনের প্রেরণা কার্টুনিস্টদের হলে বিপদ। তখন তারা কার্টুন না এঁকে পোস্টার আঁকবেন। আর ঠিক এ জিনিসটাই বাংলাদেশে হয়। বেশীরভাগ কার্টুনিস্টকে আমার কার্টুনিস্ট না, মনে হয় গ্লোরিফাইড ক্যারিক্যাচিওরিস্ট। ভয়ঙ্কর রেগে আছেন, তাই অপ্রিয় মানুষটাকে কতো বিভৎস ও কুৎসিত করে দেখানো যায় তার দোহাই হোলো এডিটরিয়াল কার্টুন। মনে আনন্দ নেই দেখেই কেউ শাহবাগ নিয়ে কোনো ফান করতে পারেন না। দেখুন একজন কার্টুনিস্টের ওয়ার্ল্ড ভিউ আর একজন কলামিস্টের ওয়ার্ল্ড ভিউ এক রকম হলে মহাবিপদ। ফাজিল না হলে কার্টুনিস্ট হওয়াটা আসলে খুবই কঠিন।
মেহেদীকে আমার খুবই প্রতিভাবান মনে হয় কারণ প্রথমত তার টেকনিক খুব তোফা এবং দ্বিতীয়ত তিনি রেগে থাকেন না, নিখাদ আনন্দের জন্যেই কার্টুন আঁকেন।
কেন মেহেদীর টেকনিক অসামান্য?
প্রথমত, ড্রয়িং এর দিক থেকে মেহেদী অনবদ্য। শিশির আর তুলি ছাড়া আমি বাংলাদেশের অন্য কোনো নিয়মিত কার্টুনিস্টের কাজ দেখি নি যার ড্রয়িং কাছাকাছি মানের। মেহেদীর বেসিক খুব ভালো এবং ইনস্টিটিউশানাল আর্টের চক্করে পড়েন নাই দেখে খুবই রিফ্রেশিং তার এপ্রোচ। একজন কার্টুনিস্টের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হোলো তার স্টাইল খুঁজে পাওয়া এবং তার ক্যারেক্টারগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য থাকা। শিশিরের হাসিনার পাশে স্বাক্ষর থাকার দরকার নেই, সবাই বোঝে এটা শিশিরের হাসিনা। কিন্তু ঠিক ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ হোলো শিশিরের ইউনুস যেন সিম্পসনের ইউনুস না হয়ে যায় – এই সমন্বয়টা হোলো স্টাইল।
খুব অল্প বয়সেই মেহেদী তার স্টাইল খুঁজে পেয়েছেন, বলা যায় ২০১১ সালে। প্রথমত, আমি খেয়াল করি যে ২০১১ তে এসে আগের কার্টুনের ড্রয়িং থেকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে গেলেন। তার স্ট্রোক বোল্ড হওয়া শুরু করলো কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তিনি কালার স্কীম আয়ত্ত করলেন। তা এই কালার স্কীম জিনিসটা কি? রং এর একটা গ্রামার আছে। আর্টিস্টরা এই গ্রামার মানেন আবার ভাঙ্গেনও। ২০১০ এর এই কার্টুনটা (ফিগার-৫) দেখলেই বুঝবেন যে তিনি কোনো কালার স্কীম মানছেন না এবং সম্ভবত জানেনও না। যে কারণে কটকটে রং এর ছড়াছড়ি। কিন্তু এই একই কার্টুনিস্টের ২০১১’র কার্টুনে আমি লক্ষ্য করি খুব সচেতন ভাবে তিনি কালার উইলের কমপ্লিমেন্ট, ট্রায়াড ও এনালজিক স্কীম ব্যবহার করছেন, কটকটে কালার বাদ দিয়ে প্যাস্টেল শেডের দিকে ঝুঁকছেন। আমি ঠিক তখনই তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি, উপলব্ধি করি an artist in making।
একজন কার্টুনিস্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ হোলো তার wit (wit এর বাংলা হতে পারে বুদ্ধি-হাসি). ফিগার:৬ দেখুন, এই কার্টুনটা না বুঝলে এই আর্ট ফর্ম আপনার জন্যে না। কার্টুনিস্টের যে wit সেটা আপনি হয়তো প্রথমেই ধরতে পারবেন না কিন্তু যখন পারবেন তখন বলবেন, “নাহ; মাল আছে মাথায়”. ঠিক এ জায়গাতেই মেহেদী তার সহকর্মীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তার ড্রয়িং এ একটা মজা আছে যেটা অনেকেরই নেই। খেয়াল করুন ফিগার:৭। মাহমুদুর রহমানকে তিনি হলুদ রং এ এঁকেছেন হলুদ সাংবাদিকতা বোঝাতে। বাংলাদেশের বেশীরভাগ কার্টুনিস্ট এই কাজটা করলে চোখে হাত দিয়ে কেরদানী বোঝাতেন – মাহমুদুর রহমানকে আঁকতেন ন্যাপলস য়েলো না কটকটে ক্রোম য়েলো দিয়ে। কিন্তু মেহেদীর কাজের পরিমিতিবোধটা দেখুন, টোনাল ব্যালেন্সটা তিনি নষ্ট করেন নি – এটাই মাস্টার স্ট্রোক। মেহেদী রেগে নেই তাই তিনি পুরো ঘটনাটা দূর দেখে দেখছেন এবং মজা করছেন। খেয়াল করুন তার wit – মাহমুদুর রহমান কোনো মিথ্যা কথা বলছেন না কিন্তু। ফ্যাকচুয়ালি, এই কার্টুনে যা বলা হয়েছে তা হয়তো ঠিক না কিন্তু আর্ট ফ্যাক্ট না, আর্টিস্টের ইন্টারপ্রেটেশান। সে বিচারে এটা খুবই উঁচু মানের কার্টুন।
তবে
আমার মনে হয় মেহেদীর আরো অনেক বেশী রেফারেন্স ব্যবহার করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শফি হুজুর, শেখ হাসিনা ও গোপাল ভাড়, এরশাদ ও কাসানোভার এক কার্টুনে আসতে বাধা কোথায়? আমাদের দেশে “সম্মানিত” – এর একটা আজগুবি ব্যাখ্যা আছে – এই ধারণাটাকে চ্যালেঞ্জ করতে কার্টুনের বিশেষ উপযোগিতা আছে। তার অবশ্যই টেক্সচার্ড পেপারে ওয়াটার কালার করা উচিত – প্রয়োজন হলে। আগেই বলেছি ওয়াটার কালার না ব্যবহার করলে, ভিজুয়ালি, কার্টুন খুব ফ্ল্যাট লাগে। আর আমার মনে হয় তিনি কমিক্সের ইলাস্ট্রেশানে নেগেটিভ স্পেস যেরকম চমৎকার ব্যবহার করেন, পলিটিকাল কার্টুনে তেমনটা পারেন না।
যেকোনো ভিজুয়াল আর্ট ফর্মের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হোলো ডাইমেনশান – মানে ছবিটা কত বড়। একই ছবি কাগজে যেমন লাগে বিলবোর্ডে তেমন লাগে না। বাঁশ বাগানের মাথার ওপর পূর্ণিমার চাঁদটার ২০০ মিমি টেলিফটো লেন্সে তোলা ছবি দেখলে মনে হয় কেয়ামতের আর দেরী নাই – একই চাঁদের ৩৫ মিমি এ তোলা ছবি দেখলে মনে হয় কলকাতার রসগোল্লা। একই কার্টুন ওয়েবে ও পত্রিকায় এক রকম লাগে না। আমার মনে হয় তিনি কার্টুন করার সময় স্ক্রীনের ডাইমেনশান মাথায় রাখেন – যে কারণে তিনি খুব বেশি নেগেটিভ স্পেস রাখেন যেটা আমার কাছে অপচয় মনে হয়। আর হ্যা, কার্টুনে তার হাতের লেখা অন্তত তুলি কিংবা শিশিরের পর্যায়ে আনা উচিত। সব থেকে ভালো হয় তিনি যদি ইংরেজি কমিক স্ট্রিপে ব্যবহৃত ফন্টের মত কোনো বাংলা ফন্ট চালু করতে পারেন। বাংলা ভাষার একমাত্র ডিসেন্ট নন-ফর্মাল ফন্টটি দেশ পত্রিকার এক ইলাসট্রেটরের – যে স্টাইলের বয়স কম না হলেও বিশ বছর। নতুন কিছু একটা করা যেতেই পারে।
খুব কম বিষয়ে আমরা বিশ্বমানের কাজ করি – এটা অস্বীকারে কোনো বাহাদুরী নেই, আবার স্বীকার করতে লজ্জা লাগে। এই লজ্জা বোধ থেকে আমাকে মুক্তি দেন মেহেদী। তার কাজ দেখলে আমি মনে সাহস পাই, আশা করতে ইচ্ছা হয় যে এই ছেলেটি সত্যিই একদিন সিন্ডিকেটেড কার্টুনিস্ট হবে, হয়তো নিউ য়োর্কারের প্রচ্ছদ হবে মেহেদীর কার্টুন। খুব কি বাড়িয়ে বললাম? নাহ, মেহেদী সত্যিই ওয়ার্ল্ড ক্লাস – সমস্যা হোলো এই স্বপ্নটা আমার না, মেহেদীর থাকা প্রয়োজন – তাহলেই কেবল সম্ভব।
আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।
শিশিরকে মিস করে যাওয়া মনে হয় উচিত হয়নি……
“আশা করতে ইচ্ছা হয় যে এই ছেলেটি সত্যিই একদিন সিন্ডিকেটেড কার্টুনিস্ট হবে, হয়তো নিউ য়োর্কারের প্রচ্ছদ হবে মেহেদীর কার্টুন।”
আশা আমরা করতেই পারি।