by Shafiq
আমি অনেক আগে থেকেই একটা জিনিষ ভেবে আশ্চর্য হতাম যে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি এবং মেইনস্ট্রীম দল হয়েও আওয়ামী লীগ কেনো মনমানসিকতায় ছোট, উগ্রপন্থী দলগুলির মতো মৌলবাদী? কেনো এরা ভাবতে পারে না তাদের চিন্তা-চেতনার বাইরেও অন্য চিন্তা-চেতনা আছে যেগুলি দুনিয়া সকল দেশের মানদন্ডেই রেসপেক্টেবল এবং কনভেনশনাল? কেনো এরা নিজেদের ক্ষমতায় এনটাইটেলড মনে করে? কেনো প্রতিপক্ষের এতো বিপুল জনসমর্থনকে বার বার চোখে দেখেও এবং নির্বাচনে একের পর এক অভাবিত পরাজয়ের পরেও এই দলটি ছোট ছেলেদের মতো প্রতিপক্ষকে তুচ্ছজ্ঞান করে?
এই সবের নিশ্চই অনেক জটিল এবং পারস্পরিকভাবে সম্পৃক্ত কারন আছে তবে আমার কাছে একটা সোজা, সাদাসিধে কারন মনে হয় যে, আওয়ামী লীগের একটি rite of passage হয় নি, যে কারনে এরা এখনও রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি দশায় আটকে গেছে, পরের দশায় উত্তীর্ণ হয় নি।
Rite of passage অর্থ হলো একজন মানুষের জীবনের একটি দশা থেকে আরেকটিতে উত্তীর্ন হওয়ার জন্যে সামাজিকভাবে যেসব ritual event বা আচার-অনুষ্ঠান করা হয় সেসবকে বলা হয়। যেমন ইহুদী কিশোরদের বার মিৎজভা, প্রথম সন্তানসম্ভবা নারীর বেবী শাওয়ার, এরকম সর্বত্র প্রচলিত rite of passage। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশীয় গনতন্ত্রের যে rite of passage টি মিস করে গেছে সেটি হলো গনআন্দোলনের মুখে পতন। আওয়ামী লীগের এখন পর্যন্ত তীব্র গনআন্দোলনের সামনে পিছু হটে ক্ষমতা ছাড়ার rite of passage এর অভিজ্ঞতা হয় নি।
ক্ষমতায় থাকার সময়ে জন্ম ও সংগঠনের কারনে বিএনপি’র কখনোই নিজের গনভিত্তি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা ছিলো না। ১৯৯১ এর বিজয়ের পরে বিএনপি যাও নিজেকে কিছুটা কতো বড়ো ‘হনু’ ভাবতে শুরু করেছিলো, সেই ভাবনা ১৯৯৬ এ তীব্র জনবিরোধিতা ও নির্বাচনে পরাজয়ে ঘাম দিয়ে ছুটে গিয়েছিলো। ২০০৬-০৭ এ ফের বিরোধিতা এবং সামরিক-তত্বাবধায়কের নির্যাতন ফের বিএনপি’র জন্যে আরেকটি rite of passage হয়েছে। জাতীয় পার্টির কথা এখানে গোণারই দরকার নেই, কথা হচ্ছে মেইনস্ট্রীম পার্টি নিয়ে।
আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬,২০০১ এর পরাজয়, ১/১১ এর সরকারের ট্রীটমেন্ট এসবে অনেক শক পেলেও একটি
rite of passage এখনো তাদের অভিজ্ঞতায় যোগ হয় নি। এটি তাদের স্পেশাল কোন কৃতিত্ব নয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার দ্বারা জনগন ও গনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অপরাধ করেছিলো শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাকশাল পত্তনের মাধ্যমে। এই বাকশাল করার জন্যে শেখ মুজিবের পরিষ্কার প্রাপ্য ছিলো একটি গনবিদ্রোহে উৎখাত হওয়া এবং নিকোলাই চসেষ্কুর মতো পরিনতি। কিন্তু কিছু unduly entitled সামরিক অফিসারদের হটকারীতা এবং অভাবিত নিষ্ঠুরতার কারনে ১৯৭৫ হয়ে গেলো আওয়ামী লীগের আরেকটি founding saga এর অংশ। গনরোষ ও গনবিদ্রোহের রূপ তাদের দেখা হলো না সে যাত্রা। ২০০১ এ আওয়ামী লীগ আগে থেকে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অনেক চেষ্টা করলেও সরাসরি তত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে আঘাত করে নি। এই কৃতিত্ব তাদের দিতেই হবে। কিন্তু এর আরেকটি মাইনর ফল দাড়ায় যে আওয়ামী লীগের rite of passage ফের পিছিয়ে গেলো।
আজকের এই সময়ে আর কোন দ্বিধা নেই। অবশেষে আওয়ামী লীগের rite of passage এর সময় এসেছে। নেগোশিয়েট করে এই ritual অনুষ্ঠান এযাত্রা না হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিলো, সেটিও শেষ হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন জনতার মুখোমুখী। আশাকরি এই rite of passage এর পরে আওয়ামী লীগ এডাল্ট হয়ে একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক দলে পরিনত হবে।