কেমব্রিজ, ২৬ অক্টোবার ২০১৩
শাহবাগের সাফল্য যথারীতি জটিল আলোচনা। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই যদি এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে জমায়েত হয়ে একটা জায়গায় দিনের পর দিন বসে থাকা কোন অ্যাপ্রোচ হওয়ার কথা না। কারণ বিচার হচ্ছে আদালতের ব্যাপার, সাক্ষ্য প্রমাণের ব্যাপার। বিত্তবান খুনী জনপ্রতি পাঁচশো টাকা ধরে মোট দশ কোটি টাকা খরচ করে দুই লক্ষ লোককে দিয়ে আদালত ঘেরাও করলেও যেমন ন্যায়বান বিচারকের রায় বদলাবে না, তেমনি কারও কাছে সাক্ষ্য থাকলে সে আদালতে না গিয়ে জাফর ইকবালের মত শাহবাগে গিয়ে বসে থাকলেও বিচারের কোন সুবিধা হবে না।
তাছাড়া যে আয়োজন আর পরিসরে “শাহবাগ” এগজিকিউটেড হয়েছে, নির্দিষ্ট সোশ্য-পলিটিকাল কমিউনিটির রীতিমত অভূতপুর্ব ও ওভারওয়েল্মিং অংশগ্রহণ ঘটেছে এবং সর্বোপরি সেখান থেকে যেই পরিমাণে আওয়াজ ছড়িয়েছে, তাতে শাহবাগকে কোন সুনির্দিষ্ট দাবী আদায়ের আন্দোলনের চেয়ে একটা “অ্যাটেম্পটেড” কালচারাল রেভোলিউশান হিসেবে গণ্য করাই বেশি যুক্তিযুক্ত।
আমি নিশ্চিত আপনি ডিসিশানে এসে গেছেন শাহবাগকে একটা অ্যাটেম্পটেড কালচারাল রেভোলিউশান আখ্যা দিয়ে এইবার এইটার “ব্যর্থতার ১০১টি কারণ” টাইপের বয়ান দেয়াই আমার উদ্দেশ্য। হা হা! Got you! না। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমি খুবই সংকীর্ণ (ইতি/নেতিবাচক অর্থে নয়, আকৃতি অর্থে) একটি ব্যাপার নিয়ে লিখতে বসেছি।
একটি দেশের বহুমতের রাজনীতির ইউটোপিয়া বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তার একটা বৈশিষ্ট্য থাকবে- যে যেই দলই করুক, উদ্দেশ্য হবে দেশের কল্যাণ; সবাই বিরোধী পক্ষের গুষ্টি উদ্ধারের চেয়ে কনস্ট্রাকটিভ কথায় বেশি মনোনিবিষ্ট হবে; রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল বা ডোমেস্টিক বিষয়গুলোয় সব দলের কমন পলিসি থাকবে এবং সেখানে সমর্থকদেরও দ্বিমত থাকবে না; সমর্থকরা একে অন্যের ভিউকে সম্মান করবে; তর্ক হবে, কিন্তু কাদা ছোঁড়াছোঁড়ি নয়; আলোচনা হবে, হাম্বা ট্যাগিং বা ছাগু ট্যাগিং নয়, ইত্যাদি।
আমি উপলব্ধি করি, শাহবাগের পর উপরের পরিস্থিতিটা একটা বিশাল ধাক্কা খেয়েছে। তার মানে কি এই যে শাহবাগের আগে বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছিল? মোটেই নয়। কিন্তু যাই ছিল, সেটাও বিলীন হয়েছে।
সোশাল মিডিয়ায় পলিটিকাল অ্যাক্টিভিজমের জন্ম শাহবাগের মধ্য দিয়ে হয়নি। অন্যান্য দেশে তো বটেই, বাংলাদেশেও তা দীর্ঘদিন ভাবে চলে এসেছে। কিন্তু শাহবাগের পর নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে- রিপোর্ট করে প্রোফাইল খাওয়া, বিটিআরসিকে চাপ দিয়ে ওয়েব পেইজ ফেসবুক পেইজ খাওয়া, একে ওকে সিন্ডিকেটেড অ্যাটাক, এই গ্যাং সেই সেলের দৌরাত্ম্যে গালাগালি ইত্যাদি।
এই তো গেল সোশাল মিডিয়ার কথা। সোশাল মিডিয়ার বাইরের জগতটাতেও টলারেন্স বেশ শিফট করেছে। “তুই নাস্তিক” “তুই ছাগু” তো আছেই, সেই সাথে কথাবার্তায় র্যাশনেলও যেন কমেছে। পলিটিকাল নার্ভাসনেসের যদি কোন ইনডিভিজুয়াল ভার্সন থাকে, তাহলে দল ও মতগুলোর সমর্থকরা সবাই নতুন মাত্রায় তাতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এর ফলে যুক্তি ম্লান হয়েছে।
মানবচরিত্রের বিচিত্র দিক, যার কোনদিন হয়তো ব্যাখ্যা পাব না, তাও উম্মোচিত হয়েছে। হ্যাঁ, মতিঝিল ম্যাসাকার প্রসঙ্গে বলছি। একদল হুজুর ঢাকার একটা অঞ্চল দখল করে ছিল, তাদেরকে মুড়ি-মুড়কির মত হত্যা করা হয়েছে- এই ঘটনায় বিশিষ্ট, শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র, সংস্কৃতিবান, প্রগতিশীল, আধুনিক ইত্যাদি ব্যাক্তিবর্গের (আত্মীয়-বন্ধু সমেত) যে উচ্ছ্বাস, হর্ষধ্বনি আর উৎসব দেখেছি, তার ব্যাখ্যা কবে পাব জানি না। সাঈদির ফাঁসির রায়ের পর জামায়ত-শিবিরের নেতাকর্মীর মুড়ি-মুড়কির মত মরার পরও সেই উৎসবের আঁচ পেয়েছি। জানি না সামনে কখনও তখনকার উৎসবকারীদের সমর্থিত দল/জোটের কর্মীরা এভাবে মরবে কিনা, আল্লাহ না করুন, মরলে হয়তো তখন আজকের “বাটে পড়া”-দের মনোভাব অ্যাসেস করতে পারব। কিন্তু যতদিন সে মুহুর্ত না আসছে (আবারও বলি- আল্লাহ মাফ করুন), ততদিন সেই হর্ষধ্বনি আর হাসি অত্যন্ত যন্ত্রণার স্মৃতি হয়ে থাকবে।
এই মুহুর্তে খুব অস্থির একটি রাজনৈতিক অধ্যায় চলছে। এক সপ্তাহ তো এক সপ্তাহ, চব্বিশ ঘন্টা পর পরিস্থিতি কী হবে কেউ জানে না। সবার আশাবাদের পাশাপাশি বিশ্বাস বা ধারণা হচ্ছে, শীঘ্রই একটা বড় ঘটনার মধ্য দিয়ে (বড় ঘটনা মানে ওয়ান ইলেভেন বা এরশাদের তৃতীয় বিয়ে না, হতে পারে নতুন ফর্মের কোন অস্থায়ী সরকার ও তারপর ইলেকশান) রাজনীতিটা স্টেবিলাইজ করবে।
রাজনীতি স্টেবিলাইজ করবে রাজনীতির গতিতে, কিন্তু শাহবাগের (নাকি আমার সো-অ্যাজিউমড “অ্যাটেম্পটেড কালচারাল রেভোলিউশান” এর?) যে কালচারাল ইমপ্যাক্ট, সেটা স্টেবল হতে মনে হয় তার চেয়ে একটু বেশি সময় লাগবে।