সেই আশির দশকের কথা। খুব বেশী আগের নয়, আবার একদম কালকেরও নয়। বাস শুধু ঢাকা থেকে পাটগাতী পর্যন্ত চল। বাসগুলো ছিল মুড়ির টিনের চেয়ে কিঞ্চিত উন্নত। বাসষ্টান্ডে নেমেই বাকী ৬/৭ মাইলের চিন্তায় কষ্টে খুব কান্না পেত। বর্ষাকালে অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। ঢাকায় দিনটা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সাধারণত: রাতের গাড়ীতেই রওয়ানা দিতাম। খুব সকালে গাড়ী পৌঁছে যেত টুংগীপাড়া-পাটগাতী বাসষ্ট্যান্ডে। ফজরের আজান পড়তে অনেক দেরী। রাতের কিছুটা কোনমতে বাসে কাটাতে দিলেও সূর্যের আলো ফোটার অনেক আগেই হাঁকডাক পড়ে যেত নেমে যাবার জন্য। গাড়ী সাফ সুতরা করতে হবে।
তখনো অনেক ভোর। সূর্যের দেখা নেই। শুকনো মৌসুমে দু’একটা ভ্যান চললেও বর্ষা মৌসুমে নৌকা, লঞ্চ এবং দু’পাই একমাত্র ভরসা। লঞ্চের অপেক্ষায় বসে থাকলে সকাল আটটা। কমছে কম আরো তিন চার ঘন্টা। এরপরেও কোন নিশ্চয়তা নেই। লঞ্চ চলে বাঙলা টাইমে। একা অপেক্ষার কষ্ট, হাঁটার চেয়েও বেশী। হাঁটলে তবুও গতি থাকে। অপেক্ষা বড় নিথর, চুপচাপ। এতোটা পথ এসে বাড়ী পৌঁছনোর তাড়াও থাকে। সে যুগে কোন মোবাইল ফোনও ছিল না। থাকলে বাটন টিপে সময় পার করা যেত। বাধ্য হয়েই জোর পায়ে হাঁটা ধরতাম। বাসষ্টেশন থেকে পাটগাতী বাজার পর্যন্ত সম্ভবত: তখন ইট সুড়কির রাস্তা ছিল। পাটগাতী বাজারে পৌঁছেই বাম দিকে মোড়। এরপরেই মাটির পথ।
বাবারে! পুরো রাস্তা কাদায় ঢাকা। মানুষের পায়ের ছাপ। গরু ছাগলেরও। হয়তো কাল কোন এক সময়ে হেঁটেছিল কেউ। রাতে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এ পথ মাড়ানোর কথা নয়। ব্যাগটা এক হাতে, বগলে জুতো এবং অন্যহাতে ছাতা মেলে ক্লান্ত দেহে বিরক্তিকর হাঁটা। কি:মি: নয়, ৬/৭ মাইল হাঁটতে হবে। পা ডেবে যাচ্ছে কাদায়। দু’ মাইলের মতো যাবার পরে মাঝারী সাইজের একটা নদী। বর্ষাকালে প্রচন্ড স্রোত থাকত। স্রোতের প্রচন্ডতায় জায়গায় জায়গায় পানি ঘুরপাক খেত। এখনো ভাবলে বুকটা কেঁপে ওঠে।
বাতাসের ঝাপটায় পাখি ওড়ার শব্দও নেই। খেয়া নৌকার মাঝির ঘুম ভাঙেনি। রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি ছিল। এখনো থেমে থেমে বাতাসসহ ঝড়ো হাওয়া। মাঝির ঘুমটা জমেছে কেবল। কি আর করা! সেই অপেক্ষা! নৌকা পাড়ি দিয়ে আবার হাঁটা। একটু সাহস জমেছে। আলো পুরোপুরি না ফুটলেও মানুষ বাইরে বের হয়েছে। কেউ প্রকৃতির ডাকে, কেউবা জীবিকার তাগিদে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত দেহে এক সময় বাড়ী পৌঁছানো।
বাড়ী পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য হাসি ছড়াল। কাছাকাছি যেতেই দৌঁড়ে এসে কেউ ব্যাগ, কেউ জুতো নিয়ে সাহায্য করছে। চারিদিকে হাকডাক পড়ে যায়। অমুক এসেছে। শুধু আমার বেলাতে নয়। গ্রামের কেউ পাশের গ্রামে আত্নীয়ের বাড়ীতে গিয়ে দু’দিন বাদে ফিরলেও সেই একই আতিথেয়তা। যেন ‘কতোদিন দেখিনি তোমায়’। কি যে মায়া! কতো ভালবাসা!
গ্রামে আমার তেমন ন্যাংটোকালের বন্ধু নেই। ছোটবেলায় গ্রামে থাকা হয়নি তাই। তবে মাঝে মাঝে আসা যাওয়ার কারণে কিছু বন্ধু হয়েছিল। তাদের সংগে আলতাফ ভাইর চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে সময় পার করা। বাকী সময়টা বাড়ীর বারান্দায় শুয়ে কাটানো। যতোদূর চোখ যেত শুধু পানি আর পানি। বারান্দার জানলা দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। দূরে মাঝিরা নৌকা চালিয়ে ভাটিয়ালি সুরে গান ধরেছে। বলতে পারব না, লিখতে তো নয়। সে কি অপার্থিব এক সুখ! হারিয়ে যেতাম! বেশ খানিকটা সময় সেই সুখের রেশ থাকতো। এখনো একাকী কোন অলস সময়ে দিনগুলোর কথা মনে পড়লে নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে টুপ করে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। এটা কি সুখের অশ্রু নাকি বেদনার? কে জানে!
হঠাৎ শুনা গেল দিন বদলের পালা। বিদ্যুৎ আসছে খুব তাড়াতাড়ি। সেই নদীটার উপরে ব্রীজ হবে, রাস্তাও নাকি পাকা হয় হয়। সে কি উত্তেজনা! গ্রামটার উন্নতি শুধু সময়ের ব্যাপার। উৎকন্ঠাও ছিল মানুষের মনে। নৌকা চালিয়ে খাওয়া মাঝিদের কিংবা সেই খেয়া নৌকাওয়ালার কি হবে? কি অদ্ভুদ মমতা। কে মাঝি আর কে খেয়া নৌকাওয়ালা! তাদের চিন্তাও চা দোকানের পরিবেশ ভারী করে তুলতো। আবার বিদ্যুতের আলো, ব্রীজ কিংবা পাকা রাস্তাও তাদের সুদিনের স্বপ্ন দেখাত। অদ্ভুদ এক মায়াবী দোটানা। দিনবদলের কারণে পুরানো পেশা হারানো মানুষগুলো ঠিকই মানিয়ে নিয়েছিল নতুন পরিবেশের সাথে। কিন্তু কিছু জিনিস মানানো যায়নি। সেগুলো এখনো মানবিক বোধগুলোকে বড় বেশী নাড়া দেয়।
আজ এই দুই সময়ের মধ্যে পার্থক্যটা খুব চোখে পড়ে। দু’য়ের দূরত্ব দেড় যুগ হবে বড়জোড়। আজকাল একদম বাড়ীর উঠোনে গাড়ীতে করে নামা যায়। পাকা রাস্তার পথ চিনে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো শহরমুখী হয়েছে। গ্রামে থাকা মানুষগুলোর শহরে সাহেব হয়ে চলার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা টাকাও নাই। জীবিকার তাগিদে, আরেকটু ভাল থাকার জন্য শহরে আসা। এসেই হয় গার্মেন্টস কিংবা সে রকম অন্য কোন কম বেতনের চাকরী করতে হোত। গ্রামে ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়েও দিন পার করা যায়। শহরে? টিকতে হলে গতর খাটাতে হয়।
কাজ করাতো মন্দ নয়। তবে যে কাজ তারা পেত তা দিয়ে অভাব ঘুচে না। যে পরিবেশে থাকতে হয়, সেখানে ভদ্দরলোকেরা টিকতে পারে না। তাই বাধ্য হয়েই পাল্টে যেতে হয়। শহরের চাকচিক্য এমনই যে, বাঁচার ভরসা না দিলেও অবিরাম ছুটে চলার নেশা জাগায়। সেই নেশায় পেয়ে বসে গ্রামের সহজ সরল, জমিলা, করিমন কিংবা কামাল, জামালদের। তারাও ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে এক সময় ঘাস ফুলের ডগা থেকে টুপ করে শিশির বিন্দু ঝরে পড়ার মতো গ্রামের সেই সহজীয়া ভাবটাও জীবন থেকে হারিয়ে যায়।
এইসব লোকেরা যখন আবার গ্রামে ফিরে, তখন সেই নির্মল স্বভাবটা আর নেই। বেশভুষার সাথে সাথে পাল্টে যায় অনেক কিছু্। কম দামী হলেও হাতে চকচকে ঘড়ি, চোখে গুলিস্তানের সানগ্লাস। গ্রামের মানুষগুলো হা করে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। চেনা মানুষগুলোর অচেনা হবার কাহিনী। চোখের সামনে ঘটতে থাকে অহরহ। কেউ কেউ সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলে, তুমি মুন্সিবাড়ীর অমুকের পোলা না?
এখন নাকি পাকা রাস্তা দিয়ে শাঁই শাঁই করে মটর সাইকেল চালিয়ে নির্বাচনের সময় শহর থেকে গুন্ডাও আসে। এলাকাতে তাদের বেশ সাগরেদও আছে। একই রাস্তা দিয়ে গ্রামের চাষীদের ফলানো শাক শব্জী, খাল বিলের মাছ শহরে চলে যায়। ভোররাতে গ্রামের ফরিয়ারা কম দামে মাছ কিনে শহরে পাঠায়। সেই মাছ দিনের আলোতে আবার চড়া দামে গ্রামে ফিরে এসে বিক্রী হয়।
যে সময়টার কথা বলছি তখন গ্রামে মাঝে মাঝেই গানের আসর বসতো। আজ সেখানে ভিসিআরে ছবি দেখার ছড়াছড়ি। শুনলাম গ্রামে ডিশ এন্টিনাও চলে এসেছে। এগুলো শুধুই বিনোদনের জন্য। খেটে খাওয়া মানুষের বিনোদন অনেক সময়ই বিপথে চলে যায়। গভীর রাতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাজে ছবির প্রদর্শন চলে। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন খিস্তি খেউরও কানে আসে রাতের নিস্তব্ধতা ভেংগে। কেউ কেউ বলে তরুণ সমাজের অনেকেই নেশা ধরেছে। পরিমিত নেশা করতে হলেও একটা শিক্ষা লাগে। একটা বাছ বিচার থাকতে হয়। ওদের সেই শিক্ষা কিংবা টাকাও নেই। তাই নেশা মানেই ভাং গাঁজার নেশা। কিছু টাকা জোগাতে পারলে শহর থেকে বাংলা মদ কিনে আনা। একদিন হয়তো শোনা যাবে গ্রামে বিপ্লব ঘটে গেছে। শহরে যেতে হয় না আর মদ কিনতে। গ্রামের কোথাও কেউ কষ্ট করে বানিয়ে সবাইকে সেবা দিচ্ছে। দামও কিছু কম হবে নিশ্চয়!
কি আশ্চর্য! শহরের মদের কারখানা গ্রামে এলে মদের দাম কমে যায়। কিন্তু গ্রামের মাছ তরকারী শহর ঘুরে গ্রামের বাজারে এলেই দাম তরতর করে বাড়ে।
এভাবে শহর আর গ্রামের পার্থক্যটা কমেছে। যে জায়গুলোতে সেই পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো কি খুব জরুরী ছিল? নাকি শহরের যেটাকে এখনো গ্রামের মানুষ ছুঁতে পারেনি সেই জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন? আগেই মতোই এখনো গ্রামের মানুষ অসুস্থ্য হলে শহরে যেতে হয়। ভাল স্কুলের অভাবে মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। গ্রাম এবং শহরের মধ্যে শিক্ষার মানে যে ফারাক সৃষ্টি হয়ে চলেছে দিনকে দিন, তাতে গ্রামে বড় হওয়া মানুষগুলোর স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট জুটলেও ভাল চাকরী জোটে না। গ্রামে কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও নেই।
এতো সব নেতিবাচক পরিবর্তন দেখে মাঝে মাঝেই পিছনে হাঁটতে ইচ্ছে হয়। সেই বটতলা, মিজান কিংবা আলতাফ ভাইয়ের চায়ের দোকান। জম্পেস আড্ডা। কি নির্মল আনন্দ! শর্তহীন, স্বার্থহীন ভালবাসা। চাঁদনী রাতে খোলা নৌকায় ঘুরে বেড়ানো। মামুনের দরাজ কন্ঠে হেমন্তের গান কিংবা হাফিজের পল্লীগীতি! রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে ভেংগে দিত।
উন্নয়নের ছোঁয়ায় পায়ে হাঁটার কষ্ট কমেছে। পাকুড়তিয়া থেকে বাঁশবাড়িয়া যাবার দেড় কি:মি: রাস্তা মানুষ একটা সময় হেঁটে যেত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শরীরের কিছু ব্যায়াম হোত। আজকাল হেঁটে যাওয়া নাকি প্রেষ্টিজের ব্যাপার। কেউ হাঁটে না। শরীরে মেদ জমলেও প্রেষ্টিজ তো পাংচার করা যায় না! অনেকের কাছে বিদ্যুৎ আসায় ভিসিআরে হিন্দী ছবি দেখা যেমন উন্নয়ন, ঠিক তেমনি মেদবহুল ঝুকিঁপূর্ণ শরীরও ভাল স্বাস্থ্যের লক্ষণ! এমনিভাবেই সেই পাকা রাস্তা, ব্রীজের হাত ধরে বিদ্যুতের আলোয় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তার অনেক কিছুই বড় কষ্টের। যে পরিবর্তনগুলো আসার দরকার ছিল সেগুলোর তেমন দেখা নেই।
গ্রামের মানুষকে নিজের বিবেচনায় দাঁড়ানোর উপলব্ধি বা শিক্ষাটা না দিয়ে হাতে তুলে দেয়া হয়েছে আধুনিক ভোগবাদী সমাজের অনেক কিছু। শহরের চাকচিক্যে তারা কেবল ছুটছে আর ছুটছে।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, এই যে পরিবর্তনটা, সেটা কার জন্য? কিসের জন্য? এটাই কি সেই উন্নয়ন?
উন্নয়ন আসলে কি?
মেদবহুল শরীরের মতোই মোটাতাজা কিন্তু জীবনসংহারী!
নাকি পায়ের কষ্ট কমিয়ে দিয়ে, হৃদয়ের দূরত্ব বাড়ানো!
কে জানে!