প্রেমের শুদ্ধ বা ফলপ্রসু আলাপের প্রাথমিক শর্তই হোল হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা, পারস্পরিক আস্থা এবং সম্মান থাকা। শুরুটা এর উল্টো হলে প্রেম হওয়া তো দূরের কথা, বরং সম্পর্ক চাট্টিবাট্টি গোল করে পালাবে। শেখ হাসিনা হয়তো সত্যি সত্যিই ফোন করে থাকতে পারেন। এবং সত্যি সত্যি খালেদা জিয়ার ফোন বিকল থাকার জন্য যৌক্তিক কারণে রিংটোন শোনা যায়নি। এবার দেখুন গতকাল প্রধান প্রধান খবরের কাগজগুলোতে খবর ছাপা হয়, খালেদা জিয়ার রেড ফোন ঠিক করা হয়েছে। তাহলে কি প্রমাণিত হোল? ডিজিটাল বাঙলাদেশ গঠনের নেত্রী বুঝেন না কোনটা রিং টোন আর কোনটা ফলস টোন!
ওএমজি!
তর্কের খাতিরে সবচেয়ে খারাপ দিকটাই ধরে নিলাম এবং মেনে নিলাম খালেদা জিয়ার টেলিফোনটা সচল ছিল। তিনি হয় কল আসার সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে ছিলেন না কিম্বা ইচ্ছা করেই ধরেননি। শিষ্টচার বলে তো একটা কথা আছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন বারবার বলছেন, তার ফোনটা বিকল, তার কথায় শেখ হাসিনার আস্থা রাখা উচিত ছিল এবং কথা না বাড়িয়ে মূল প্রসঙ্গে চলে যাওয়াটাই ছিল উত্তম। ফোন সচল না বিকল খুবই একটা মামুলী বিতর্কের বিষয়। বারংবার বলা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা আটকে থাকলেন খালেদা জিয়াকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের জন্য। এই সামান্য বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী মেনে নিতে পারলেন না, খালেদা জিয়ার কথায় আস্থা রাখতে পারলেন না, তার কথাকে সম্মান জানাতে পারলেন না, তাহলে খালেদা জিয়া কিভাবে অপর পক্ষের প্রতি এতো বড় একটা জটিল রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আস্থা রাখবেন? শেখ হাসিনা সংলাপের আলোচনার চেয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে মিথ্যাবাদী প্রমাণে যে কষ্টটা করলেন, এর মাধ্যমে তিনি প্রতিপক্ষের টেম্পারমেন্টকে উস্কে দিলেন। তাহলে আলোচনার সুযোগ থাকল কোথায়?
প্রধানমন্ত্রী বারবার মূল ইস্যুকে ফোকাস না করে ব্যাক্তিগত বিষয়কে টেনে এনে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছেন। খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে তিনি জাজমেন্টাল কথা বলেছেন। যেটা বিরোধীদলীয় নেত্রীকে উত্তেজিত করেছে নির্দিধায় বলা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেখেন আপনি তো ১৫ই আগষ্ট জন্মদিন পালন করেন। কিন্তু ওটা তো আপনার জন্মদিন নয়’। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এবং চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠার এই সন্ধিক্ষণে কারো জন্মদিনের মতো ব্যাক্তিগত বিষয় টেনে আনা কতোটুকু দায়িত্বশীল আচরণ?
শেখ হাসিনার ফোনালাপকে কোন মতেই সংঘাত উত্তরণের উদ্যোগ হিসেবে মানা যায় না। আর মাত্র একটি উদাহরণ দেব।
শেখ হাসিনাঃ আপনি তো ওখানে ক্যামেরা লাগিয়ে আমার সাথে কথা বলছেন।
খালেদা জিয়াঃ এত নিচু মনের মানুষ আমরা নই।দেখবো,আপনিই ক্যামেরা লাগিয়েছেন এবং হয়ত কথা শেষ হলে দেখবো এটা টিভিতেও আসছে।
এই ধরনের আলাপচারিতাকে কি বলা যায়? এগুলো কি খুবই প্রাসঙ্গিক এবং জরুরী ছিল?
এভাবে প্রতিপক্ষকে মিথ্যাবাদী প্রমাণে আপ্রাণ চেষ্টা, জন্মদিনের মতো একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়কে সামনে টেনে এনে শেখ হাসিনা মূলতঃ খালেদা জিয়ার সাথে একটা সাইকোলজীক্যাল গেম খেলেছেন। তিনি হয়তো চেয়েছেন প্রতিপক্ষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে এমন কিছু বক্তব্য আশা করা যার ফলে তার ইমেজ নষ্ট হয়। কিছুটা হলেও তিনি সফল হয়েছেন, কিন্তু দুর্বল হয়ে গেল সমাঝোতার সম্ভাবনা। খালেদা জিয়া তার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে কিছুটা উত্তেজিতভাবে আলোচনায় জড়িয়ে পড়েন।
শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান চাইলে আলোচনার শুরুটা সেভাবেই করতেন। পূর্ব ঘোষিত হরতালে পুলিশকে নির্দেশ দিতেন আরো বেশী সহনশীল হবার জন্য। মাত্র তিনদিনের হরতাল দেশের ক্ষতি করলেও অচলাবস্থার সমাধান হলে দেশ ও জনগণ বেঁচে যেত শংকা থেকে। তিনি এর কোনটিই করেননি। বরং অব্যাহতভাবে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, সংসদে শেখ সেলিমের মেয়েলী কন্ঠে খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যাঙ্গ এবং শেখ হাসিনার মুখ টিপে হেসে সমাঝোতার সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। মনে হয়েছে, টেলিফোন আলাপটাই ছিল একটা ট্র্যাপ অথবা কোন শক্তির চাপে পড়ে করা।
ইনু বেশ কয়েকদিন ধরে আজকে, কালকে হাসিনা ফোন করবেন বলে প্রচার করলেন। সেই ফোন এমন একটা সময় করা হোল, তখন বিরোধীদলীয় নেত্রীর একার পক্ষে পূর্বঘোষিত কর্মসূচী বাতিল করা হোত আত্নহত্যার শামিল। হরতালের ঠিক আগেরদিন সন্ধ্যায় কর্মসূচী প্রত্যাহার কিভাবে সম্ভব? ১৮দলীয় জোটের অধিকাংশ নেতা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তাৎক্ষনিক স্বিদ্ধান্তে জোটের নেতৃবৃন্দকে জড়ো করা কতোটুকু সম্ভব ছিল? খালেদা জিয়া যদি এককভাবে স্বিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে জোটের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হোত এবং জোট ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হোত। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই কি একদম শেষ পর্যায়ে উনি ফোন করলেন? তারপরেও বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছেন, নীতিগতভাবে নির্দলীয় সরকার মেনে নিলে তিনি দায়িত্ব নিয়ে হরতালসহ সব কর্মসূচী প্রত্যাহার করবেন। শেখ হাসিনা সেই প্রতিশ্রুতি দেননি।
হরতালের প্রায় শেষভাগে এসে আরেকটি গন্ডগোল পাকিয়ে আলোচনার পথকে রুদ্ধ করে দেয়া হোল। সরকারের পক্ষ থেকে ফোনের বিস্তারিত প্রকাশ করে দিয়ে সংকটকে ঘনীভুত করা হোল। ইনু প্রথমে বলেন যে, খালেদা জিয়া ফোনের অংশ বিশেষ প্রকাশ করে শিষ্ঠাচার লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু যে অডিওটা আমরা প্রথম শুনতে পাই সেখানে দেখা যায় হাসিনা ফোনে কথা বলছেন। অর্থাৎ রেকর্ডটা করা হয়েছিল শেখ হাসিনার প্রান্ত থেকে। তাহলে কি শেখ হাসিনার চারিদিকে ঘিরে থাকা লোকজনের মধ্যে খালেদা জিয়ার চর লুকিয়ে আছে? ইনুর বক্তব্যে বুঝা যায় ফোনালাপ প্রকাশে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশী। এতে মহাজোটের কতোটুকু লাভ হোল? বিশেষ করে আওয়ামিলীগের? বরং এইচ টি ইমামদের অপপ্রচার যে মিথ্যা ছিল সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। খালেদা জিয়া নাকি বলেছিলেন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারাই গণহত্যায় অংশ নেয়। এমন কথা বিরোধীদলীয় নেত্রী বলে থাকলে সেটা ছিল ভয়ানক অপরাধ। সেটা বলে থাকলে জনসমর্থন হাসিনার দিকে বেড়ে যেত। কিন্তু খালেদা জিয়া সেটা বলেননি। তারপরেও ইনু পুরো কথোপকথন প্রকাশ করল কার স্বার্থে? ঘরের শত্রু বিভীষন। ইনু সেই কাজটি করেই মহাজোটের ভিতরে থেকে আওয়ামিলীগের মহা সর্বনাশ করলেন। নেপথ্যের কারণ কি হতে পারে? রক্ষী বাহিনীর হাতে জাসদের ত্রিশ হাজার কর্মীর হত্যার কিঞ্চিত প্রতিশোধ নেয়া? নাকি ইনু চাচ্ছেন দুই দলের সমাঝোতা না হোক? আওয়ামিলীগের অধীনে একপাক্ষিক নির্বাচন হলে তিনি আবারও মন্ত্রী হতে পারবেন। সমাঝোতা হলে যদি মহাজোট ক্ষমতায় আসতে না পারে তবে তার সেই সম্ভাবনা থাকবে না।
সংঘাত সূচনার একটা ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া আছে। শেখ হাসিনা অবিরামভাবে খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটাক্ষ করে, একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সংঘাত সৃষ্টির যে ক্রিয়া শুরু করেছন, সেই বিষয়টা আমরা কেউ কেউ বেমালুম চেপে যেতে চাইছি। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় যেগুলো ঘটে চলেছে সেগুলোকে হাইলাইট করা হচ্ছে বেশী। প্রতিক্রিয়ার সূচনাকরী ক্রিয়াকে লুকিয়ে, প্রতিক্রিয়া দেখান পক্ষের চরিত্র হণনের চেষ্টা কেন? কিছু মিডিয়ার এই দলকানা ভূমিকা সমস্যাকে জিইয়ে রাখছে।
দুই নেত্রীর উত্তপ্ত টেলিফোন আলাপের সময়ে ঘটে গেল আরেকটি বিপর্যয়। একাত্তর টিভিসহ কিছু মিডিয়ার উপরে বিক্ষোভকারীরা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণকে সমালোচনার উর্দ্ধে রাখা যায় না। তবে এটাকেও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। একাত্তর টিভির মতো কিছু মিডিয়া তাদের অপকর্মের জন্য বিক্ষোভকারীদের হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। এরা দিনের পর দিন একটা দলের পক্ষ হয়ে তথ্যকে বিকৃতভাবে প্রচার করে আসছে। ফলে প্রতিপক্ষের সমর্থকেদের রাগিয়ে দেয়াটাই স্বাভাবিক। তারপরেও এই আক্রমণকে মেনে নেয়া যায় না। পুরো ঘটনাগুলোকে কয়েকভাবে দেখা যেতে পারে।
প্রথমতঃ কিছু মিডিয়া সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। কেন? এরাও একটা রাজনৈতিক দলকে তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে তারচেয়েও ভয়াবহভাবে অব্যাহতভাবে আক্রমণ করে যাচ্ছে। একাত্তর টিভির উপরে আক্রমণকারীদের যারা এক চেটিয়াভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে গালমন্দ করছেন তারাও মূলতঃ এক পক্ষের দোষকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছেন। গাড়ীতে ককটেল মারার চেয়ে তথ্য সন্ত্রাস কখনো কখনো ভয়ানক হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ মাহমুদুর রহমানকে যখন গ্রেফতার করা হোল তখন এই সকল মিডিয়া প্রতিবাদ তো করেইনি বরং সরকারকে উস্কে দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে আরো কঠোর হবার জন্য। এখন এদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা কি খুব জরুরী?
উপরের যুক্তিগুলো দেয়া হোল শুধুমাত্র এক পাক্ষিক দোষারোপকে বন্ধ করার জন্য। সত্যি কথা হোল, আমাদেরকে প্রতিহিংসার এই দুষ্ট চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যে কোন মিডিয়ার রাজনৈতিক দর্শন থাকতেই পারে। এটাতো দোষের নয়। তবে সাদাকে কালো এবং কালোকে সাদা বলার মতো তথ্য বিকৃতি করার অধিকার কারো নেই। তখ্য বিকৃতিতে একাত্তর সব সীমা পার করে ফেলেছে।
মাহমুদুর রহমানকে স্কাইপ আলোচনা ফাঁস করে দেয়াতে জেলে ঢুকান হয়। এখন ইনু এবং একাত্তরের মোজাম্মেল বাবুকেও কি জেলে ঢুকান হবে? তথ্যমন্ত্রী ইনুকেও কি বিচারের আওতায় আনা হবে? কারণ টেলিফোনের কথোপকথন প্রকাশের দায়িত্ব তিনিই নিয়েছেন। সেই সাথে জাতিকে আবারো ফেলে দিয়েছেন গভীর সংকটে।
পুনশ্চঃ এতো কিছুর পরেও সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আশাবাদী, বড় দুই জোটের মধ্যে একটা ফলপ্রসু আলোচনা এবং সমাধান হবে শীঘ্রই এবং জাতি উদ্ধার পাবে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাতের হাত থেকে।