জনগণ প্রার্থনা করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য যে বাংলাদেশ বিভক্ত নয়; যে দেশ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতমুখী; শুধুই অতীতআশ্রয়ী নয়। যে বাংলাদেশ জনগণের; ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের দেশ নয়। যে বাংলাদেশ প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় কিন্তু নতজানু ক্রীতদাস হতে চায় না। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণ আপনার কাছ থেকে তেমন রাজনীতিই আশা করছে, যে রাজনীতি বাংলাদেশী নাগরিকদের মাথা উচুঁ করে বাঁচতে সহায়তা করবে।
বেগম জিয়া একজন মিতভাষী মানুষ। তার শান্ত ও ধীর স্হির বক্তব্য এদেশের কোটি কোটি মানুষের পছন্দ। এমনকি যে মানুষটি বিএনপির রাজনীতি করে না সেই মানুষটিও প্রতিপক্ষের উত্তেজনাময় বক্তৃতার বিপরীতে তার ধীরস্হির ও শান্ত বক্তব্যকে প্রশংসা করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বেগম জিয়ার শেষ মুহুর্তের বক্তৃতা বিএনপির কয়েক শতাংশ ভোট বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাসমান ভোট ব্যাংকের ভোটগুলো তার দলের ভোট বাক্সে পড়েছিল। ফলে আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি সিট পেয়ে তিনি সরকার গঠন করেছিলেন।
তিনি রাজনীতির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক লড়াইও ছিলো। সেই লড়াইয়ে তার স্বামী লে. জেনারেল (তৎকালীন সময়ে মেজর) জিয়াউর রহমান একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে প্রথমে ১ নং সেক্টর এবং পরে জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অকুতোভয় এই সেনা কর্মকর্তা জীবন বিপন্ন করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানের কারাগারে স্বেচ্ছাবন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বীরের মতো রনাঙ্গনে লড়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বীর উত্তম উপাধি দিয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া এমনই একজন বীর সেনার স্ত্রী, যিনি শুধু দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে নিজেকে সপে দেননি, ১৯৭৫ সালে জাতি যখন গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত তখন দেশ রক্ষায় সাহসিকতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে এসেছিলেন। দল মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। যে ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা জিয়াকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল, জেনারেল জিয়ার স্ত্রী হিসেবে সেই ঝড় ঝাপটা থেকে তিনিও রেহাই পাননি। প্রাণপ্রিয় স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েননি। বরং দেশের প্রয়োজনে নিজেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক পরে যোগ দিলেও বেগম জিয়া অনেক ঝানু পলিটিশিয়ানের চেয়েও নিজেকে একজন প্রজ্ঞাশীল রাজনীতিক হিসেবে প্রমাণ করেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। সেকারণেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জনগণ তার প্রতি আস্হা রেখেছিল। দীর্ঘ নয়বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন তিনি। আর জনগণ তাকে উপহার দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীত্ব।
একাধিকবার বাংলাদেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা থেকে বেগম জিয়া নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছেন, দেশ পরিচালনা সহজ নয়। বাংলাদেশ একটি ছোট্ট ভূখন্ড। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষ। যখন দেশটি স্বাধীন হয়েছিল তখন লোকসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে সাত কোটি। সেই মানুষদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়েও হিমশিম খেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করে দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থতা এবং স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে শতাব্দীর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। শেখ মুজিব নিজ দলের মধ্যে চরম বিশৃঙখলা আর দুর্নীতির ভয়াবহতায় নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমার কম্বল কোথায়?
স্বাধীনতার পরপর রাজনীতিতে তোষামোদকারীদের প্রাধান্য ও প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ধারা জিয়াউর রহমান সততা আর সাহস দিয়ে ভাঙ্গতে চেষ্টা করেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালকের ব্যবস্হাপনাগত ব্যর্থতা ও তোষামোদে বিগলিত হওয়ার ফলে কি হতে পারে বাংলাদেশের মানুষ সেটি দেখেছিল ১৯৭২ থেকে ৭৫ সময়কালে। শুধু নেতার সততা ও সদুদ্দেশ্য দিয়ে যে কাজ হয় না, সৎ প্রশাসন ও ব্যবস্হাপনার যে দক্ষ টিম দরকার হয়, সেটি এই দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল জিয়ার শাসনামলে। এই দুই ধারা থেকে আমাদের করণীয় জেনে নেয়া প্রয়োজন। আমাদের দরকার একজন সৎ নেতার নেতৃত্বে একটি সৎ, সুদক্ষ ও আধুনিক ব্যবস্হাপনা টিম।
সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডে বেগম জিয়ার অসন্তুষ্টির কথা গত পৌনে পাঁচ বছরে অনেকবার আমরা শুনেছি। এখন সময় হয়েছে নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে জনগণের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরার। এ ব্যাপারে বিএনপি এবং এর নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের প্রস্তুতি কেমন জানি না। জনগণ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা বরখেলাপের বড় বড় ঘটনা দেখেছে। কিন্তু তা নিয়ে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ দেখতে পায়নি। বিরোধী দল হিসেবে শেয়ার বাজার দুনর্ীতি, হলমার্ক দুনর্ীতি কিংবা এমন আরো বড় বড় আর্থিক দুনর্ীতির বিরুদ্ধে কার্যকর চাপ সৃষ্টি করেনি। জনগণ দেখেনি সংসদে তাদেও সরব উপস্হিতি কিংবা সাগর রুনি হত্যাকান্ডসহ অমিমাংসিত হত্যাকান্ডগুলোর ব্যাপারে সোচ্চার হতে। ভারতের সীমান্ত হত্যার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সুনির্দিষ্ট ও কঠোর সমালোচনা জনগণের সামনে ফুঁটে উঠেনি। আরো অনেক বিষয় রয়েছে যেখানে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা দেখা যায়নি, যা জনগণের একান্ত প্রত্যাশা ছিল।
নির্বাচনের সময় যতো ঘনিয়ে আসছে টেনশন বাড়ছে। সাধারণ জনগণ উদ্বিগ্ন। বিরোধী দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রতিপক্ষ দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকান্ড মোকাবেলায় প্রয়োজনে জনগণকে ‘দা-কুড়াল’ নিয়ে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। এই তো সেদিন ২০০৬ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায়, তখন তাদের বিরুদ্ধে লগি-বৈঠা নিয়ে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। ফলে লাশ পড়েছিল ঢাকার রাস্তায়। সাধারণ মানুষের চোখের সামনে সেদিনের নৃশংস তান্ডব এখনো স্পষ্ট। সেই সূত্রে দেশে দুই বছরের জন্য পরোক্ষ সেনা শাসন এসেছিল। জনগণ তেমন পরিস্হিতির পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। বিএনপি কি শেখ হাসিনা ও তার দলের দেখিয়ে দেয়া পথে হাটতে চায়?
১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তার শাসনামল দীর্ঘায়িত করেছিল। বেগম জিয়া সেপথে হাটেননি। নীতি ও আদর্শ বিচ্যুত হননি, যেকারণে জনগণ তাকে ‘আপোসহীন নেত্রী’ আখ্যা দিয়েছিল। ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসা সেনাসমর্থিত সরকার যখন ‘মাইনাস টু থিওরি’ বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়, তখন তার অনমনীয় মনোভাবের কারণেই তা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখন বেগম জিয়াই হাল ধরেছিলেন এবং দেশকে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। এভাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার স্বাথর্র্ে নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত কূটকৌশলের আপসকামী রাজনীতির সাথে তার ও তার দলের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জনগণ দেখেছে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিভাবে জামায়াতের সঙ্গে দোস্তি গড়ে তুলেছিল। কিভাবে ধর্মকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিড়ি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করেছে। আবার সুবিধামতো ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্হান নিচ্ছে। পক্ষান্তরে, জনগণ বিএনপির মধ্যে বৈপরিত্য কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য লোক দেখানো কর্মকান্ড নয়, বরং রাজনীতির ধারাবাহিকতা দেখতে পায়। এই প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়া যখন কোন কথা বলেন তখন মানুষ সে কথায় আস্হা রাখে; বিশ্বাস করে। দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনীতির মাধ্যমে তিনি মানুষের আস্হা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। সে কারণেই জনগণ মনে করে, দেশের ক্রান্তিলগ্নে তিনি দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। জনগণ প্রত্যাশা কওে, ২০০৬ সালের মতো কোনো ‘লগি-বৈঠা’ মার্কা রাজনীতিতে তার নেতৃত্বাধীন দল জড়াবে না। বিএনপি কথা বলবে না আওয়ামী লীগের ভাষায়।
জিয়াউর রহমানের মতো একজন তরুণ বীর যোদ্ধা ও সৎ রাষ্ট্রনায়কের হাতে গড়া বিএনপিকে দেশের সাড়ে সাত কোটি কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর দল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রবীণ ও নবীন নেতৃত্বের একটি নতুন কাঠামো নিয়ে ভাবতে হবে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। বিএনপি যে স্বাধীনতার মূল শক্তির বাংলাদেশী দল, সেই বার্তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা স্টাইলের রাজনীতির পরিবর্তে জনগণকে নতুন ধারার রাজনীতি উপহার দিতে হবে। এর ইঙ্গিত সাম্প্রতিককালে বেগম জিয়া দিয়েছেন। জনগণ আশা করছে, তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তেমন কর্মসূচিই ঘোষণা করবেন যা জনগণকে সঠিক পথে চালিত করবে। জনগণ প্রার্থনা করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য যে বাংলাদেশ বিভক্ত নয়; যে দেশ অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতমুখী; শুধুই অতীতআশ্রয়ী নয়। যে বাংলাদেশ জনগণের; ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের দেশ নয়। যে বাংলাদেশ প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় কিন্তু নতজানু ক্রীতদাস হতে চায় না। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণ আপনার কাছ থেকে তেমন রাজনীতিই আশা করছে, যে রাজনীতি বাংলাদেশী নাগরিকদের মাথা উচুঁ করে বাঁচতে সহায়তা করবে।
তারেক রহমানের মতো সন্ত্রাসবাজ ও দুর্নীতি প্রমোটকারী নেতাকে বিএনপি কীভাবে প্রতিহত করবে তা একটা বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে অবসর নিলে বিএনপি-প্রধান কে হবেন? তারেক রহমানকে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে না রাখতে পারলে তো সে-ই হবে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী – যা কিনা দেশের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
জামাতে ইসলামীর মত মৌলবাদী এবং সুবিধাবাদী সংগঠনকেই বা বিএনপি-র ছত্রছায়া থেকে কবে বিতাড়ণ করা হবে? আজ জামাত সরকারের সাথে লড়তে গিয়ে বিএনপিকে ব্যবহার করছে, কাল যে সে আওয়ামী লিগের সাথে আঁতাত করে বিএনপি-র ক্ষতি করবে না – তার কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। আর আওয়ামী লিগ যতই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হোক না কেন, বিএনপি-বিরোধিতা করতে গিয়ে যে প্রয়োজনে মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে জামাতকে ছাড় দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই – অন্তত ইতিহাস তা-ই বলে।
সব মিলিয়ে লেখাটা অনেক বেশী সুপারফিশিয়াল মনে হয়েছে। শুধু জিয়াবন্দনা আর খালেদা জিয়ার প্রতি মোটা দাগের কিছু দিকনির্দেশনা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না লেখায়। লেখার একমাত্র ভালো দিক হলো আওয়ামী দুঃশাসনের কিছু খণ্ডচিত্রের বর্ণনা। ধন্যবাদ।