সময় কাল, ১৯৭১/ বিহান তার ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছে । সীমান্তে যাবে, training নিতে, যুদ্ধে যাবে বিহান। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবিচারের বিরুদ্ধে একটি ন্যায়যুদ্ধে । ১৬ বছরের দিহান অস্থির হয়ে ছুটে আসে বিহানের ঘরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ভাইয়া তুমি রফিকে বাঁচাও। মোহাম্মদ রফি দিহানের বন্ধু, সমবয়সী। বাইরে গোলাগুলি শোনা যাচ্ছে। বিহান শুধু বলল, রফিকে বাসায় এনে উপরের ঘরে লুকিয়ে রাখ। কিছু হবে না ওর। আমি আছি না। হেসে বেরিয়ে গেল বিহান। দিহান ছুটে গেল রফির সন্ধানে।
বিহান একটু চিন্তিত। খবর পেয়েছে , বিহারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাঙালীরা। যুদ্ধে এটা হয়ই বোধ হয়। কিছু বাঙালী মনে করছে, এই উর্দু বলা বিহারীগুলোকে ধরলেই বোধ হয় পাকিস্তানীদের নির্মম অত্যাচারের শোধ নেওয়া হবে। বিহান ভাবে, বন্ধু পবনদা, মিহিরদা, আজিজ, তাজু ,মানস এদের নিয়ে কিছু একটা করবে, সীমান্তে যাবার আগেই। এই নিশ্চিন্তপুরে এটা হতে দেয়া যায় না।
রফি লুকিয়ে আছে, দোতলার ঘরে, ঠিক বারান্দার পাশেই। দিহানও আছে তার সাথে। বুক ফুলিয়ে বার বার বলছে, রফি, ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিহান ভাইয়া তো মুক্তিযোদ্ধা, ওরা কেউ এখানে তোকে খুঁজতে আসবে না। রফি শুধু বলে, “আব্বা, আম্মা, ভাইয়া এদের তো কোনো খবরই পেলাম না। ওদের যদি তোর এখানে নিয়ে আসতে পারতাম!” হঠাৎ বাইরের রাস্তায় আওয়াজ, রফির মায়ের কন্ঠ, “ও বেটা, আমার রফি কোথায়?”; রফির বড় ভাই, হাসান এর গলা শোনা যায়,“ও আম্মা, ও বাঁচুক”! চিৎকার শোনা যায়, “চুপ”/ রফি ছুটে যায় রাস্তায়। দিহান ওকে আটকাতে পারে না। রফি যোগ দেয় বিহারীদের কাফেলায়, ওরা তাদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, শোধ নিতে!
আচমকা কালিভূষণ! কালিভূষণ নাটক শেখায় ছোট্ট শহরটিতে, দিহান, বিহান, রফি, হাসান সকলেই নাটক শিখেছে কালিদার কাছে। যে বছর রফি, “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কারটা পেল, সে বছরই কালিদা তাকে টেনে নিয়ে গেল তার নাটকের দলে, তখন থেকেই রফি কালিদার প্রিয় ছাত্র!
কালিভূষণ কাফেলার সামনে এসে দাড়ায়। রফি, কালিদাকে দেখে হাসে, বলে উঠে চমৎকার শুদ্ধ বাংলায়-
“কালিদা, বাংলা আবৃত্তি শেখালে, বাংলা নাটক শেখালে, শেখালে না কি করে বাঙালী হতে হয়”।
মুহুর্তের জন্য থমকে গেলেও পরমুহুর্তেই কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি খায় কালিভূষণ, ধুলো ভরা রাস্তার উপরে। “বাবাগো আমার, তোরা ছেড়ে দে ওকে। ওতো বাচ্চা ছেলে আমার!”
বীর পুরুষের দল, ধমকে উঠে কালিভূষণকে, “আহ, কালিদা, কাজের সময় জ্বালাতে এসো নাতো, সরে যাও,” একরকম ধাক্কা দিয়েই সরিয়ে দেয় তাকে। কালিভূষণ কাঁদতে থাকে, বীর পুরুষের দল এগিয়ে যায়, এগিয়ে যায় রফি, আমানত, হাসানদের কাফেলা।
তারপর, অনেক দিন পার হয়ে যায়,লাখো বাঙালীর আত্মত্যাগ, হাজারো নারীর সম্ভ্রম, আর একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে বাঙালী পায় নতুন একটা দেশ, বাংলাদেশ। বাংলাদেশীরা যুগ যুগ ধরে গর্ব করতে থাকে এই দেশ নিয়ে, তর্ক করতে থাকে স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিল, এনিয়ে চায়ের কাপে উঠে ঝড়।
এভাবে ৪০ বছর কেটে যায়। এরি মাঝে একদিন হজরত শাহজালাল এয়ারপোর্ট এ ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এর একটি বিমান এসে নামে। মোহাম্মদ রফির আরেক ভাই, মোহাম্মদ নায়ীম, এসে পৌছায় ঢাকায়। ৭১ এ সে এবং তার আরেক ভাই লন্ডনে পড়ছিল। ঢাকায় পৌঁছেই সোজা চলে যায় বাসের উদ্দেশ্যে। বাস এসে থামে ঠাকুরগাঁয় । চৌরাস্তায় এসে অবাক হয়ে চারদিকে তাকায় নায়ীম । কত্ত বদলে গেছে শহরটা । কি যেন খুঁজে সে, নিজেও বোঝে না কি তা ! হঠাৎ চোখে পড়ে খুব চেনা একটা মুখ। একটু ইতস্তত করে এগিয়ে যায় সে।
“পবনদা; চিনতে পারছ?” শুদ্ধ বাংলায় প্রশ্ন নায়ীম।
পবন চমকে উঠে। “নায়ীম না”!
“হুম”।
দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অপলক। কত্ত ভাবনা, কত্ত স্মৃতি ভেসে উঠে। জড়িয়ে ধরে পবন নায়ীমকে।
“কবে এলি নায়ীম ?”
“গতকাল, পবনদা। কেমন আছো তুমি, তোমরা ??”
“আছি ভালই”।
পবন নায়ীমকে নিয়ে যায় বিহানের বাসায়। বৈঠকখানায় বসে পেপার পড়ছিল বিহান। নায়ীমকে দেখে বুঝে উঠতে পারে না বিহান কি বলবে । নায়ীম এগিয়ে যায় বিহানের দিকে। বাঁধ ভেঙ্গে যায় বিহানের। বলে ওঠে, “আমাকে মাফ করে দিস নায়ীম, পারিনি আমি ওদের বাঁচাতে, আমায় মাফ করে দিস”।
“বাদ দাওনা বিহান ভাই, Nothing is unfair in love and war. তোমরা ভালো আছো তো? এতো প্রাণ, এতো রক্তের বিনিময়ে এই মায়াভরা দেশটাতে তোমরা সুখে আছো তো?”
কাঁদতে থাকে নায়ীম, কাঁদতে থাকে পবন। ৪০ বছরের পুরনো কান্না।
তারপরে আরো কিছু দিন কেটে যায়। আড়িয়াল বিলের মানুষগুলো ফুঁসে উঠে, বাপদাদার ভিটা রক্ষার সত্য আন্দোলনে, একটা বোকা নিরুপায় পুলিশ মরে যায় এর মধ্যে, শেয়ারবাজারের ভরাডুবিতে লাখ লাখ মানুষ নেমে পড়ে পথে, সংবিধান মুদ্রণ, পুনর্মুদ্রণ এর খেলা চলে, মেহেরজান নিয়ে ব্লগে, ব্লগে চলে বিশাল উত্তেজিত আলোচনা, ধর্ষিত হেনার মৃতদেহের শুকিয়ে যাওয়া দোররার দাগ নিয়ে চলে গবেষণা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত আলেমেরা পায় ফতোয়া দেবার সরকারী অনুমতি, ওদিকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে থাকে ফেলানি।
আগের প্রজন্মের গর্বের বাংলাদেশ রয়ে যায় আমাদের ভালোবাসার হয়ে, কর্পোরেট নারীপুরুষ লাল-সবুজ জামা পরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে উঠে নীরব সংসদ ভবনের সামনে। আর আমি, সারাজীবন বিজ্ঞান পড়া মানুষটা, প্রাপ্ত বয়স্কের মাথা নিয়ে খুঁজি একটি জরুরী প্রশ্নের উত্তর; “ বাঙালী হওয়া মানে কি?”
(চরিত্রগুলোর নাম বদলে দেওয়া হয়েছে)
It’s outstanding.
স্বাধীনতা ? সুশীল-প্রগতিশীলরা বরাবরই এড়িয়ে চলে কিছু প্রশ্ন। তাদের দম্ভে ভরা কুটিল মন এসব প্রশ্নের উত্তর দিবেনা। পাছে তারা অবাঙালি প্রতিভাত হয়। 😐
almost read like a poem. beautifully written. please write more. you have it in you. – Naushad
Are we bangali yet? Or we will have to start speaking hindi to complete the transition.
অসাধারন লেখা । এক নিমেষে পড়ে শেষ করলাম ।