বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও একটি দলের ষ্ট্র্যাটেজিক এনালাইসিস (পর্ব-১: ষ্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং প্রসেস )
ভূমিকা
দেশের সমাজ ও রাজনীতি একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গত দুই দশকে নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকবার সরকার আর বিরোধীদলের মধ্যে অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ইউনিক। বিগত কয়েক বছরে সরকারের কর্মকান্ড থেকে প্রতীয়মান হয় যে এবারের পরিস্থিতি মোটেই হঠাত করে উদ্ভুত ক্রাইসিস না। বরং এই পরিস্থিতি বড় দলগুলোর পরিকল্পিত ষ্ট্র্যাটেজির প্রতিফলন। বর্তমান পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে ষ্ট্র্যাটেজি এনালাইসিস সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারনা প্রয়োজন। তার পরে প্রয়োজন হবে প্রধাণ দলগুলির (lets call them এ দল ও বি দল) ষ্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে ধারণা। এর পরে আমরা সহজে বুঝতে পারবো দলগুলি কি করছে আর কেন করছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি জানা যাবে তা হচ্ছে, তারা ভবিষ্যতে কি করতে পারে। (নিশ্চিতভাবে আমাদের দুই দল একে অপরের সম্পর্কে এনালাইসিস করে কর্মপন্থা ঠিক করেছে, কিন্তু স্বভাবতই তারা সাধারণ জনগণকে তা অবহিত করবেনা।) সুতরাং আমরা নিজেরাই চলুন কষ্ট করে ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ বানাই।
এই লেখাটা দুটি পর্বে বিভক্ত হবে :
১। ষ্ট্র্যাটেজি এনালাইসিস কিভাবে করে?
২। এ দলের ষ্ট্র্যাটেজি এনালাইসিস।
একই পদ্ধতি ব্যাবহার করে বি দলের ষ্ট্র্যাটেজি এনালাইসিস করা সম্ভব, যা এই লেখার আলোকে আপ্নারা নিজেরাই করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ষ্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং প্রসেস
২৪০০ বছর আগে বিখ্যাত চীনা সামরিক চিন্তাবিদ সানযু(SunTzu) ষ্ট্র্যাটেজি নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা আর্ট অব ওয়ার রচনা করেন। আধুনিক যুগের উল্লেখযোগ্য ষ্ট্র্যাটেজিষ্টদের মধ্যে আছেন ক্লসউইটস(১৯ শতক), লিডেল হার্ট (২০ শতক) প্রমূখ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৭০ এর দশকে বিজনেস ম্যানাজমেন্ট এ ষ্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং এর প্রচলন হয়।
আধুনিক ষ্ট্র্যাটেজিক এনালাইসিস ও প্ল্যানিং এর একটি বহুল প্রচলিত প্রসেস হচ্ছে SWOT এনালাইসিস। এ পদ্ধতিটি বিজনেস ম্যানাজমেন্ট এ বেশ জনপ্রিয় এবং ইফেক্টিভ। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোও এই পদ্ধতি ব্যাবহার করে।এর মাধ্যমে নিজস্ব অর্গানাইজেশনের strength, weakness, opportunity and threat ক্রস এনালাইজ করে ষ্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।এ পদ্ধতিটি ডিফেন্সিভ ষ্ট্র্যাটেজি প্ল্যানের জন্য ভালো। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির পরিস্থিতি বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, আমাদের দলগুলো অফেন্সিভ ষ্ট্র্যাটেজি প্ল্যান করছে। তারা একে অপরকে সম্ভব হলে পুরোপুরি নিশ্চিনহ করে দিতে আগ্রহী। এজন্যেই তাদের কাজকর্ম আমরা সাধারন ছকে ফেলে মিলাতে পারিনা। আর এখানেই এই লেখার প্রধাণ গুরুত্ব।
অফেন্সিভ ষ্ট্র্যাটেজি প্ল্যানিং মূলত বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে, যার আধুনিক যুগের গুরু হচ্ছেন Clausewitz. তিনি এক্ষেত্রে যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটি দেন তা হচ্ছে সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি (http://www.clausewitz.com/readings/Bassford/StrategyDraft/#CoG)। এই তত্ত্বটি মূলত প্রতিপক্ষের শক্তির উতস খুজে বের করে সেটাকে ধ্বংস করার প্রয়োজনীতা ব্যাখ্যা করে। এ তত্ত্বটিকে বিজনেস এনালাইসিস এর জন্য উপযোগী একটি মডেলে রূপ দেন Dr. Joe Strange (http://www.vsente.com/comprct11.html)। পরবর্তীতে এই মডেলটি সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সাথে ব্যাবহার হয়।
আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ষ্ট্র্যাটেজি বোঝার জন্য Dr. Joe Strange এর CG-CC-CR-CV মডেল ব্যবহার করবো।
প্রতিটি ষ্ট্র্যাটেজিক প্লানের একটা আল্টিমেট উদ্দেশ্য থাকে, ষ্ট্র্যাটেজির ভাষায় যাকে বলে এন্ডস্টেট (End State)। এর অর্থ হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আমরা আসলে কি অর্জন করতে চাচ্ছি। এই এন্ডস্টেট অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় কিছু Means(বিভিন্ন কার্যকরি মাধ্যম, যেমন সাংগঠনিক ক্ষমতা, এলায়েন্স, ছাত্র সংস্থা, তৃণমূল সংগঠন, কুটনৈতিক সংযোগ ইত্যাদি) এবং Ways(পন্থা, অর্থাৎ কি পথে তা অর্জন করা হবে)।
এই পন্থা নির্ধারনের জন্য প্রয়োজন প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা। ডাঃ স্ট্রেঞ্জ এর মডেল আমাদের এটা করতে সাহায্য করবে।আসুন বোঝার চেষ্টা করি এই CG-CC-CR-CV বলতে কি বোঝায়!
- CG (Centre of Gravity). এটা হচ্ছে প্রতিপক্ষের শক্তির মূল কেন্দ্র যা তাকে তার তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় বাহ্যিক/শারীরিক ও আভ্যন্তরীন/সাইকোলজিকাল ক্ষমতা প্রদান করে। এর উপরেই সবকিছু নির্ভর করে এবং একে নিস্ক্রীয় করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়।
- CC (Critical Capability). সেইসব মাধ্যম/যোগ্যতা যেগুলো প্রতিপক্ষের CG কে কার্যকর রাখতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে এবং তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেগুলো তাকে কার্যকর রাখতে হবে। এইসব CC প্রতিপক্ষের CG কে রক্ষা করে।
- CR (Critical Requirements). প্রতিপক্ষের প্রতিটি CC এর কয়েকটি “critical requirements” থাকে —এগুলো হচ্ছে সেইসব অবস্থা, মাধ্যম ও সম্পদ যেগুলো প্রতিটা CC কে সম্পূর্ণ কার্যকর রাখার জন্য আবশ্যক।
- CV (Critical Vulnerabilities). Critical vulnerabilities হচ্ছে প্রতিপক্ষের CC এর সেইসব দূর্বলতা যেগুলোকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আক্রমণ করে সহজেই তার CC কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করা যায়। এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে যে CV কে অবশ্যই এমন বিষয় হতে হবে যা CG এর উপরে সূদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
Critical vulnerabilities কে আরো গভীরভাবে বুঝার জন্য আমরা একটা গ্রীক ঊপকথার এনালগির সাহায্য নিবঃ
Thetis the goddess took her son Achilles and dipped him in the River Styx, to make him immortal. The current was so fast she was forced to hold him by the heel, which remained untouched by the magic waters. So by the heel alone could Achilles be wounded by ordinary mortals. ( Ancient Greek Legend)
ট্রোজান যুদ্ধের গ্রীক লিজেন্ড একিলিস এর বীরত্বকাহিনী সবারই জানা। সে অসাধারন যোদ্ধা ছিল এবং সম্মুখ মল্লযুদ্ধে তাকে পরাজিত করার মত কোন যোদ্ধা ছিলনা, কারন সে দেবী থেটিস এর সন্তান ছিল। থেটিস তাকে অজেয় করার জন্য বরদান করেছিল, শুধু একটা দুর্বলতা বাদেঃ তার পায়ের গোড়ালী ছিল তার একমাত্র দুর্বলতা।
ট্রোজান যুদ্ধের একটা পর্যায়ে একিলিস হয়ে দাঁড়ায় গ্রীক CG (Centre of Gravity)। তাকে প্রতিরোধ করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করার জন্য ট্রোজানরা চেষ্টা করে। একিলিসের গোড়ালী ছিল তার একান্ত আভ্যন্তরীন দুর্বলতা (নিঃসন্দেহে একটা Critical Vulnerability) , কিন্তু তার নাগাল পাওয়া সহজ ছিলনা। তাই প্রয়োজন ছিল আরও কিছু Critical vulnerabilities। যেমন যদি তাকে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত রাখা যেত, তাকে বহন করা জাহাজকে ধংস বা বিলম্বিত করা যেত, কিংবা ট্রয় শহরের প্রবেশদ্বারকে সুরক্ষিত রাখা যেত তাহলেও একিলিসকে তার উদ্দেশ্য (ট্রয় বাহিনীর ধংস) সাধন থেকে বিরত রাখা সম্ভব ছিল। এগুলোও তাই একিলিসের পরোক্ষ Critical vulnerabilities। এই এনালগি থেকে আমরা পাই যে CG কে নিস্ক্রীয় করার প্রধাণত তিনটা মাধ্যম আছেঃ
ক। CG কে আপ্রাসংগিক করে দেওয়া (একিলিস এর জাহাজ ট্রয় এ আসা প্রতিরোধ করা)।
খ। CG কে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা (একিলিস যদি ট্রয় এ পৌছে, তবে তাকে শহরে ঢুকতে যারা সাহায্য করবে, অর্থাৎ প্রবেশদ্বার ভাংতে সাহায্য করবে, সেইসব সৈন্য ও উপকরণ ধংস করা)।
গ। CG কে তার একান্ত আভ্যন্তরীন দুর্বলতায় আঘাত করে ধংস করা (অর্থাত শেষ পর্যন্ত যদি একিলিস এর সাথে যুদ্ধ করতেই হয়, তবে তার গোড়ালীতে আঘাত করে ধ্বংস করা)।
এই তিনটা পদ্ধতি স্মরণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আমাদের প্রতিপক্ষের Critical Capabilities নির্ধারণে সাহায্য করবে, যা ষ্ট্যাটেজি নির্ধারনের একটা গুরূত্বপূর্ণ নিয়ামক। নিচে একটা চিত্রের মাধ্যমে CG-CC-CR-CV এর মধ্যে সম্পর্ক দেখানো হলোঃ
লাল রঙের বৃত্তগুলো দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে একটি CV কে ধ্বংস করলে চেইন রিএকশনে তা গিয়ে CC ও CG কে প্রভাবিত করে ।এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে যে কিছু CV একাধিক CC কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে, তাই সেগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশিষ্ট
এই পর্বে আমরা অফেন্সিভ ষ্ট্র্যাটেজি এনালাইসিস এর প্রাথমিক ধাপ সম্পর্কে একটা ধারণা প্রদানের চেষ্টা করলাম। আশা করি এই ধারণাগুলো পরবর্তী দুই পর্বে আপনাদের দুই প্রধাণ দলের ষ্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনা বুঝতে সহায়ক হবে। আসলে এটা বেশ জটিল একটা পদ্ধতি। আমি পদ্ধতিটির একটি অংশ সাধারণ ভাষায় লিখার চেষ্টা করলাম। পরবর্তী পর্বগুলোতে প্রাকটিকাল উদাহরণ দিলে আপ্নারা আরো পরিষ্কার ধারণা পাবেন। যারা আরো গভীরভাবে বুঝতে আগ্রহী তারা নিচের লিঙ্কগুলোর সহায়তা নিতে পারেনঃ
http://www.clausewitz.com/readings/Bassford/StrategyDraft/#CoG
http://www.vsente.com/comprct11.html
http://twoscenarios.typepad.com/maneuver_marketing_commun/files/dr_strange_article_part_2.pdf
http://www.campaignstrategy.org/articles/12basicguidelines.pdf