টেন্ডুলকার আমার কাছে শুধু শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানই নন, আমার কৈশোরের সাথে শেষ যোগসূত্রও – যতোবার তাকে দেখি, মনে হয় কোনো এক অদ্ভূত কারণে, সোনার দিনগুলো আমার আছে মোহাফিজ। এই লোকটার ব্যাট দিয়েই আমি যেকোনো সময়ে চলে যাবো সেই নব্বুই এ – ইচ্ছে হলেই। ব্যাট হাতে টেন্ডুলকার মানেই আমার কৈশোরের সেই নানান রঙের দিনগুলো।
আজকে যারা কিশোর তাদের পক্ষে কল্পনা করা কঠিন হবে ৮০’র দশকে কী বোরিং ক্রিকেট খেলতো ভারত। শ্রীকান্ত আর আজহার ছাড়া ধুন্ধুমার কোনো ব্যাটসম্যান নেই। কপিল মাঝে মাঝে পেটাতে পারে এবং ওই একটি মাত্র বোলার – বাকী সব কে কার থেকে স্লো বল করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। ৮৮ সালে এশিয়া কাপ ক্রিকেট হয়েছিলো ঢাকায়, প্রথম বড় ধরনের আয়োজন। টিভিতে কমেন্টেটর ছিলো আলী জাকের, আজকের হিসাবে খুবই গরিবী আয়োজন কিন্তু ক্লাস ফাইভের এই ছেলেটার কাছে পৃথিবী বদলে যাওয়া ঘটনা (আজকের কিশোরদের কাছে কল্পনা করা হয়তো সম্ভবই না যে ৮৯ সালে ঢাকায় একটা আন্তর্জাতিক কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়েছিলো এবং সেটা লাইভ দেখানো হয়েছিলো টিভিতে। সেই বিজ্ঞ কমেন্ট্রি থেকেই জানতে পারি যে প্যাচ যেটাই হোক কমেন্টেটর সেটাকে বোস্টন ক্র্যাবই বলবেন। আমার কাছে সেটাও ওয়ার্ল্ড চেঞ্জিং ইভেন্ট) । মনে আছে আরশাদ আইয়ুব নামের এক অখ্যাত অফ স্পিনার (রাজেশ চৌহানের ঠিক আগে খেলতো ভারতের হয়ে) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নিয়ে বসে ২০ না ২১ রানে। কিন্তু গ্যালারিতে ভারতের একেবারেই সাপোর্ট নেই। মানে একটাও তালি পড়ে না, কিন্তু পাকিস্তানের জন্য দর্শকরা হাত ফাটিয়ে ফেলছে। আমার কাছে তখন মনে হয়েছিলো এটা মুসলমানির কারবার। কিন্তু এই একই মাঠে ১০ বছর পরে যখন পাকিস্তান ইন্ডিয়া ম্যাচ হোলো তখন বলা যায় সাপোর্ট ৬০-৪০ (পাকিস্তানের পক্ষে)। কারণটা আসলে ধর্ম ছিলো না, ছিলো টেন্ডুলকার। দশ বছর আগের এক বোরিং টিম শচিনের হাত ধরে হয়ে গেছে ফাইটিং আউটফিট।
আমাদের চেয়ে যারা দশ বারো বছরের বড় তাদের থেকে নিয়ে আমরাই শেষ – এ পর্যন্ত যে প্রজন্ম – তাদের কাছে ইমরান খান যে ড্যাশিং ফাইটার, আমাদের পর থেকে আজকের ছানাপোনা এই দীর্ঘ প্রজন্মের কাছে টেন্ডুলকার ঠিক তাই। ইমরান খানের সাপোর্টার থেকে আমাদের প্রজন্ম হয়েছিলো পাকিস্তানের সাপোর্টার, আর টেন্ডুলকারের সাপোর্টার থেকে আমাদের পরের প্রজন্ম হয়েছে ভারতের সাপোর্টার।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে ওল্ড ডিওএইচএসে – সেখানে ৮৯ সালেও প্রায় পুরো বছর ক্রিকেট খেলা হতো। কায়সার হামিদের ভাই সোহেল হামিদ সেখানে তখন ষ্টার ক্রিকেটার। জাতীয় দলের হয়ে খেলা পেস বোলার হাসিবুল হোসেন তখন উঠতি তারকা মাত্র ক্লাস সেভেন-এইটেই। ওখানেই মনে হয় প্রথম শুনি যে ইন্ডিয়ার একটা বাচ্চা ছেলে খুব ভালো খেলে। ৯০ এ চলে যাই ক্যাডেট কলেজ। ক্যাডেট কলেজগুলো এখন কী রকম জানি না তখন কিন্তু পুরোপুরি ফুটবল প্রধান ছিলো। তবে বহু ক্যাডেট খেলার খবর রাখার দিক থেকে প্রাণান্ত ছিলো। আশ্চর্যের বিষয়: প্রায় কেউই ইন্ডিয়ার ডাই হার্ড ফ্যান ছিলো না (আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ফাইয়াদ ভাই ছাড়া)। কিন্তু টেন্ডুলকার বিষয়ে সবারই খুব আগ্রহ ছিলো। ভিনোদ কাম্বলির সাথে ৬শ রানের পার্টনারশিপের কথা সবার মুখে মুখে।
অবস্থা বদলে যায় ৯২ এর বিশ্বকাপের পরে। ক্রিকেট দেখাটা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং খেলার পরিমাণও বাড়তে থাকে। মনে আছে পাকিস্তানের সাথে খেলায় কাম্বলি আর টেন্ডুলকার ব্যাটিং করছিলো (এই দিনটায় আমরা কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়ি আসছিলাম) আর বল করছিলো ইমরান খান। দুজনের মিলিত বয়স ইমরানের সমান না। কিন্তু কী দারুন ছিলো টেন্ডুলকার।
ওই বয়সের একটা বিশেষত্ব ছিলো কীভাবে প্রমাণ করা যায় আমি যে টিম সাপোর্ট করি সেটাই বেস্ট এবং অন্য টিম কেন ধর্তব্যই না সেটাও প্রমাণ করা। ইন্ডিয়া যে বাজে টিম পরিসংখ্যানের দিক থেকে প্রমাণ করা খুব সহজ ছিলো। ইন ফ্যাক্ট ইন্ডিয়া উইনিং টিম হয়েছে এই তো সেদিন – ২০০৩ এর দিকে এসে। কিন্তু একজন ব্যাটসম্যানকে প্রায় সবাইই সমীহ করতো- সেটা ছিলো টেন্ডুলকার।
কোনো swagger নেই এমন একটা স্পোর্টসম্যানকে সবাই ভালোবাসে তার বিনয়ের জন্য, বিষয়টা কল্পনা করা খুব কঠিন – শচীন সেটা করে দেখিয়েছে। সত্যিই আশ্চর্য এই মানুষটা। কোনো একটা কাজ ২৪ বছর ধরে সমান উদ্যমে মানুষ ভালোবাসে কী করে এটাই আমি বুঝে পাই না।
টেন্ডুলকারকে আর দেখা যাবে না এটা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার শৈশবের এই মানুষটাকে আর দেখা যাবে না খেলার মাঠে, ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বড় আমি হয়েই গেলাম তাহলে, শেষমেষ।