নেতারা খায় পোলাও কোর্মা, কর্মীরা খায় গুলি।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে আওয়ামিলীগের চেয়ে বিএনপির ঢাকাকেন্দ্রিক শীর্ষ নেতারাই ক্রমশঃ দলের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যেই মুহুর্তে একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ে নির্দলীয় সরকারের নামে নিজেদের নিয়ন্ত্রনাধীন ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন করতে যাচ্ছে তখন দরকার ছিল একটা শক্তিশালী গণআন্দোলনের। প্রাথমিকভাবে বলা যায়, বিএনপির নেতৃত্ত্বাধীন ১৮দলীয় জোট আন্দোলন সফল করায় উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যর্থ। দায়ভার স্বভাবতই জোটের বড় দল হিসেবে বিএনপির ঘাড়েই বর্তায়। এমনকি বিএনপির শক্তি নিয়ে সরকারীদল থেকে শুরু সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ঠাট্টা করতে ছাড়ছে না। বলাবলি হচ্ছে, রাজপথে জামাত ছাড়া বিএনপি এতিম। সেই নব্বই কিম্বা ছিয়ানব্বইয়ের বিএনপির সাথে আজকের বিএনপির তুলনা শুধুই হতাশার জন্ম দেয়। এই কি সেই বিএনপি, নাকি তার খোলস?

বিষয়টা খালেদা জিয়ারও নজর এড়ায়নি। তাই সম্প্রতি ঢাকাকেন্দ্রিক শীর্ষ নেতাদের প্রতি তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদেরকে হুঁশিয়ারী করে দেন। শোনা যায়, তিনি মির্জা আব্বাস, খোকাসহ ঢাকা মহানগরীর পাঁচ প্রভাবশালী নেতাকে শোকজ করেছেন।  তিনি বলেছেন, সারাদেশ যেখানে উত্তাল সেখানে ঢাকা নিরব কেন? ভীতু ও মোনাফেকদের জায়গা বিএনপিতে নেই। পলাতক ও আপসকামী নেতাদের দলে জায়গা হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ার ‍ুউচ্চারণ করেন।  তিনি আরো বলেন, সারা দেশের লাখ লাখ কর্মী যখন পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করছে, সেখানে কতিপয় নেতার পলায়নপরতা এবং আপষকামীতার জন্য আন্দোলন মাঠে মারা যাচ্ছে।

খালেদা জিয়ার উদ্বেগের কারণ যথার্থ। আজকে সরকার ঘোষনা দিক যে, তারা নির্দলীয় ব্যাবস্থায় নির্বাচন দেবে, কাল থেকেই বিএনপির এই সব নেতারা গোপন আস্থানা থেকে বের হয়ে বীরের বেশে (!) বড় বড় ব্যানার নিয়ে, নানা মোসাহেবী এবং বিপ্লবী শ্লোগান নিয়ে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

বিরোধীদল আন্দোলন করছে একটা ন্যায় সঙ্গত দাবীকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ কথা সত্য যে, কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চিরস্থায়ী হতে পারে না। কিন্তু সেটাকে বাদ দিয়ে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন সেটা কি হয়েছে? আস্থা তো দূরের কথা পারস্পরিক সম্মানেরও ছিঁটেফোটা নেই। নেতানেত্রীরা একে অন্যকে যে ভাষায় গালিগালাজ করেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর! সেদিনও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিপক্ষের পরচুলা নিয়ে মশকরা করলেন। তাছাড়া নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্টরা কি সরকারের প্রভাবের বাইরে গিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করার সামর্থ্য রাখেন? এখনো পুলিশের পাশে সরকারদলীয় অস্ত্রধারীদের প্রকাশ্যে দেখা যায়। নির্বাচন কমিশন চলে সরকারের মর্জি মাফিক। আদালত কি সরকারের প্রভাবমুক্ত? দা কুড়ালের কথা বলে খোকা আছেন দৌঁড়ের উপর, ফেইসবুকে অন্যের আইডি থেকে দেয়া ষ্ট্যাটাসের মাশুল দিচ্ছে পরিবেশবাদী অধ্যাপক একেএম ওয়াহিদু্জ্জামান এ্যাপোলো। অন্যদিকে, হরতালকারীদের ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যার হুমকীদাতা সরকারীদলীয় নেতা লতিফ সিদ্দিকী এবং ’নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের’ হত্যা করার ইচ্ছা পোষনকারী প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয়ের ব্যাপারে আদালত নিরব। এই সামগ্রিক বৈরী পরিস্থিতিতে এখনো আমাদের দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিকল্প নাই।  সেই সাথে বর্তমান সরকারের গত পাঁচ বছরে হাতে গোণা কিছু সাফল্যের সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ব্যার্থতা রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের কাছে একের পর এক দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নানা চুক্তি মেনে নেবার নয়।

এতো সব সহায়ক পরিবেশ পেয়েও বিএনপি কেন কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। এর কারণ হতে পারে মোটামুটিঃ

প্রথমতঃ নেতাদের পলায়নপরতা এবং আপষকামীতা কর্মীদের হতাশ করেছে।

দ্বিতীয়তঃ শুধু আন্দোলন করলেই চলে না, আন্দোলনের তাৎপর্যটা জনগণকে বুঝাতে হয়। বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতারা হয়তো বুঝতে অক্ষম যে, গত পাঁচ বছরের আগের বিশ্ব এবং আজকের বিশ্বের মধ্যে বিশাল ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। একটা সময়ে ছিল সংবাদপত্রই একমাত্র খবর সংগ্রহের মাধ্যম ছিল। এখন বাঙলাদেশে অগনিত টিভি চ্যানেল, অনলাইন পত্রিকা, ইন্টারনেট বিশেষ করে ফেইসবুক, ব্লগ ইত্যাদি নানা প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে। অঁজ পাড়াগায়ে থেকেও মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহুর্তেই তারা জানতে পারছে তরতাজা খবর। ফেইসবুক, ব্লগে সাধারণ মানুষ মূলধারার সংবাদপত্রের বাইরেও জানতে পারছে সাধারণের প্রতিক্রিয়া। জানাতে পারছে নিজের ভাবনার কথা। আগে সাধারণ মানুষ পত্রিকার খবর বা বিশ্লেষন পড়ে প্রভাবিত হোত। এখন তারাও অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প গণমাধ্যমের মারফত নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে। ভুলে যান আগের কথা। নতুন করে নতুন বিশ্বকে দেখুন।

তৃতীয়তঃ ’সাধারণ মানুষ কেন আন্দোলনে শরীক হয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করবে’- এই ভাবনাটা সেদিনও ছিল না, এখন হয়েছে। মানুষের মনোজগতের এই পরিবর্তনটা কি বিএনপির নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন? নিরব জনগণের সবাই যে সরকারের সমর্থক তা নয়। তারা শুধু আন্দোলনের ফলাফলের সাথে নিজেদের লাভালাভের হিসেবটা করছে। আন্দোলন থেকে নেতাদের পিছুটান একেবারেই ব্যাক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কিন্তু জনগণের একটা অংশের অসম্পৃক্ততা কিম্বা নৈতিক সমর্থন না থাকার পিছনে জনগণের স্বার্থ যতোটা না ব্যাক্তিগত, তারচেয়ে বেশী সামষ্টিক। সমষ্টির মধ্যে তারা ব্যাক্তিগত স্বার্থ খুঁজছে। অর্থাৎ আজ সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ যেমন, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব, দুর্নিতি, সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ইত্যাকার বিষয়ে আন্দোলনরত দলগুলো ক্ষমতায় এলে কি করবে? পরিবর্তনটা যদি সেই অর্থে না আসে তবে অযথা জীবন বিপন্ন করে কার লাভ কার ক্ষতি? বলতে গেলে সেই এরশাদ আমল থেকে একই খেলা চলছে। এর মধ্যেও বিএনপির সাথে আওয়ামিলীগের গুণগত পার্থক্য কি সেই এডুকেশনটা বিএনপি জনগণকে দিতে পারেনি।

হরতালের কারণ হিসেবে বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনপ্রতিষ্ঠা। আপাতদৃষ্টিতে আন্দোলনকে মনে হতে পারে, নির্দলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামিলীগের বদলে বিএনপির ক্ষমতায় যাবার প্রক্রিয়া হিসেবে। আসলে যে বিষয়টা এমন সাদাকালো নয়, বরং এর সাথে জনস্বার্থ তথা দেশের স্বার্থও জড়িত সেই বিষয়গুলো বিএনপি পরিস্কার করতে পারছে না। কেন নির্দলীয় ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন করা জরুরী, সরকারীদল কেন সেটা চায় না- ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জনগণের সামনে বিরোধীদল তুলে ধরতে পারেনি। শুধু হরতাল ডাকলেই হবে না। হরতাল কেন তা বুঝানোর জন্য এবং হরাতালে মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য যে গণসংযোগ দরকার সেটা দলের পক্ষ থেকে না করায় যৌক্তিক আন্দোলনটা কিছুটা হলেও জনণের বিরক্তের কারণ হয়ে পড়ছে।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, জীবন জীবিকার তাগিদে সাধারণ মানুষের বাইরে বের হতেই হবে। তাদের অফিসে যেতে হবে, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে হবে। আবার গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে, একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইলে এই পরিস্থিতিতে কঠোর কর্মসূচীরও অন্য বিকল্প নাই। এই দুই প্রয়োজনীয়তা পূরণের একটা কার্যকর ভারসাম্যতা সৃষ্টি করা জরুরী।

চতুর্থঃ কোন এক অজানা কারণে অধিকাংশ সংবাদপত্র কেন জানি বিএনপির প্রতি বিমাতাসুলভ। ফলে জনগণের কাছে মূলধারার সংবাদপত্র থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা ঠিকভাবে পৌঁছছে না।  মধ্যিখানে সহিংসতার শিকার হয়ে মারা পড়ছে সাধারণ মানুষ।

মোদ্দাকথা, আন্দোলন জোরদার করতে না পারা এবং আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারার পুরোটা দায়ভার বড় দল হিসেবে বিএনপির।  এর পিছনের কারণ হোল দলীয় পদ দখল করে রাখা কিছু সুযোগসন্ধানী নেতা। চিন্তা করুন, বিরোধীদলের নেতার বাসায় পানির লাইন, খাবার সরবরাহ কেটে দেয়া হোল। অথচ একজন নেতাকে দেখা যায়নি প্রতিবাদ করতে।

ক্ষমতায় আসলে যে সব রথী মহারথীরা মন্ত্রী এমপি হবেন দলের এই কঠিন সময়ে তাদের বাতি জ্বালিয়েও পাওয়া যায় না। এসি রুমে বসে পোলাও কোর্মা খেয়ে স্বপ্ন দেখছেন কেউকেটা হবার। ওদিকে রাজপথে কর্মীরা অকাতরে পুলিশের গুলি খাচ্ছে।  রাজপথে নেমে মামলা খেলে আপনাদের সামর্থ্য আছে তার মোকাবেলা করার। সরকার খুব বেশী নির্যাতনও করতে পারবে না। কারণ আপনারা বড় নেতা। ঝামেলা হয়ে গেলে দেশে বিদেশে সরকার নানামুখী চাপের মধ্যে পড়বে। এতোগুলো সেফটি নেট থাকা সত্ত্বেও হরতালের ডাক দিয়ে আন্দোলনের মাঠে অনুপস্থিত থেকে মীর জাফরের মতো কর্মীদের সঙ্গে বেঈমানী করছেন। নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন, রাজপথে ওনারা আন্দোলনে নামবেন আর সরকারীদল তাদের বরনের জন্য ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেটা তো হবার নয়।

সত্যি কথা কি, মাহমুদুর রহমান, পিয়াস করিম, তুহিন মালিক, নুরুল কবির, আসিফ নজরুল, ওয়াহিদুজ্জামান এ্যাপোলো, এদের হাঁটুর গোঁড়ায় যতোটুকু সাহস আছে, বিরোধীদলের নেতাদের ততোটুকু হিম্মত থাকলেও সরকারের এতোদিন টনক নড়ে যেত।

Mahalom72@msn.com

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s