আমেরিকার কংগ্রেসে বাংলাদেশ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ শুনানি এবং কিছু কথা

by Shafquat Rabbee

সম্প্রতি আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের উপর আমেরিকান কংগ্রেশনাল হেয়ারিং। দেশে এখন আর বাংলাদেশ বিষয়ে অবজেক্টিভ কথা বলার মানুষ বেশি নেই। দলীয় লেজুরবৃত্তি-উন্মাদনা আর ভয়ের এক বিশ্রি ককটেলে সচেতন-সুশীল সমাজ এখন ন্যায্য কথা বলতেই ভুলে গেছেন। এই রকম দমবন্ধকর অবস্থায়, কংগ্রেসনাল হেয়ারিং-এ বাংলাদেশের যে মোটামুটি একটা অবজেক্টিভ চিত্র ফুটে উঠেছে তা সবার দেখা উচিত।

বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকান ডিসিশন মেকিং করে থাকে কয়েকটি সংস্থা। নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ নিয়ে এনালাইজ করে স্টেট ডিপারটমেন্ট আর গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। আইন প্রণয়নকারি সিনেট ও কংগ্রেসনাল সাব-কমিটির ভুমিকা থাকে প্রয়োজন অনুসারে বাংলাদেশ বিষয়ক আইনগত পলিসি নির্ধারণ করা। আমেরিকান আর্মির প্যাসিফিক কমান্ড এর লোকজন মিলিটারি এঙ্গেল থেকে বাংলাদেশকে এনালাইজ করে। আর এর বাইরে প্রেসিডেন্ট এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিশেষ ভুমিকা থাকে বাংলাদেশ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ নীতি নিরধারনে। ১৯৭১ সালে আমেরিকান একজিকিউটিভ ব্রাঞ্চ উপরে উল্লিখিত একাধিক ব্রাঞ্চের কথা উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে থাকার ভুল সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। এক্ষেত্রে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিশেষ ভুমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়।

আমেরিকান কংগ্রেশনাল হেয়ারিং এর মুল্য অসীম। এটা আমাদের দেশীয় সংসদ সদস্যদের সময়-ক্ষেপণ, পদলেহন, আর একে অপরের পিন্ডি-চপকানোর সেশন না। বিশেষ করে ছোট খাটো দেশের উপরে চালানো হেয়ারিং-এ কংগ্রেসম্যানরা সাধারণত বেশ তাড়াতাড়ি ফাইনাল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। নিশ্চিত ভাবে ধরে নিতে পারেন, বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে আমেরিকান সিদ্ধান্ত আগামি দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই ফাইনাল হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে গত কালকের হিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।

গতকালকের হিয়ারিং এর পূর্ব প্রকাশিত মূল বিষয়বস্তু ছিল তিনটি। ১) নির্বাচনকালীন সরকার, ২) পোশাক কারখানা শ্রমিকদের নিরাপত্তা, আর ৩) মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনাল। তবে হিয়ারিং এর দিন হঠাৎ করে যোগ হয়ে যায় “হিন্দু জেনসাইড” এর বিষয়টি।

এটা উল্লেখ্য যে, আমার জানা মতে এর আগে কোন বাংলাদেশ বিষয়ক কংগ্রেশনাল হিয়ারিং হয়নি যেখানে একসাথে দু’জন বাংলাদেশী কথা বলেছেন। এটা এবারই প্রথম হয়েছে বলে আমার ধারণা।

শুনানিতে অংশ নিতে যাওয়া মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। আলি রিয়াজ আমেরিকাতেই থাকেন। উনার বইয়ের তালিকায় ইসলাম ও সন্ত্রাস নিয়ে অনেকগুলো বই আছে, তার সাথে আছে তসলিমা নাসরিনের উপরে লেখা একটি বই। উনি বাম কিংবা আওয়ামীপন্থী ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিত অনেকের কাছে। উনি প্রথম আলো সহ আরও কিছু আওয়ামী বান্ধব পত্রিকায় লেখেন। অপর আলোচক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন সিফটোন একজন আমেরিকান ব্যাক্তি। তরুন আইনজীবী তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে এই ভদ্রলোকের নামে একটি মামলা করা হয়েছিল কিছু দিন আগে।

আলোচনার শুরুতেই মার্কিন কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট অল্প সময় ধরে শুনানির একটি ভুমিকা দেন। তার ভুমিকাতে মুলত নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন, শ্রমিক নিরাপত্তা, আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বক্তব্য ছিল। উনার কথার ডিটেইল থেকে এটা নিশ্চিত বুঝা যাচ্ছিল যে উনি বাংলাদেশের নির্বাচন আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন।

স্টিভ শ্যাবটের স্পিচে মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনির একটা কথা উল্লেখ করা হয়। শ্যাবট বলেন যে বাংলাদেশে এসে উনি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যুদ্ধপরাধী ট্রাইবুনাল আন্তরজাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলছে না কেন? উত্তরে মাননীয় মন্ত্রী নাকি বলেছিলেন যে তারা “নতুন আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করছেন”! বলাই বাহুল্য এই কথাটি উল্লেখ করে স্টিভ শ্যাবট তার কলিগদের বুঝাতে চেয়েছেন ট্রাইবুনালের বর্তমান অবস্থা।

পুরা আলোচনায় মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামানের কথা বলার স্টাইল আর প্রেজেন্টেশন যেকোন বাংলাদেশীকে গর্বিত করবে বলে মনে করি। উনি যেভাবে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে, এবং বর্তমান সংকটকে নির্মোহভাবে বর্ণনা করেছেন, তা শুনে অনেকেই আশ্বস্ত হবেন। বিশেষত রাস্ট্রের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সেনাবাহিনীর উপর আমেরিকানরা সহ দেশের সংখ্যাগরিস্ট মানুষের আস্থা বজায় রাখার কাজটি মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান খুব ভালো ভাবে করতে পেরেছেন।

জন সিফটোনের কথা ছিল একজন সত্যিকারের প্রফেসনাল মানবতাবাদীর মতোই। উনি একবারের জন্যেও বাংলাদেশ সরকারের হাতে তার সংস্থার হেনস্তা হবার কথা বলেননি। শাহাবাগের আইনজীবী তুরিন আফরোজরা হয়তো এই ভদ্রতা থেকে কিছুটা হলেও শিখতে পারবেন। আলোচনায় মাত্র একবার মুহাম্মদ ইউনুসের প্রসঙ্গ উঠেছিল, তবে কোন ফলো-আপ আলোচনা হয়নি।

হেয়ারিং-এ উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোকজন ছিলেন অনেকে। জামাতের কেউ কেউ ছিলেন। অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য হারে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকান হিন্দু এসোসিয়েশনের লোকজন। এদের অনেকেই নিয়ে গিয়েছিলেন একাধিক রঙিন কাগজ পত্র, যেখানে দেখানো হচ্ছিল বাংলাদেশে “হিন্দু নিধন” হচ্ছে, যাকে তারা তাদের ভাষায় হিন্দু জেনোসাইড বলেছেন। দেশে জেনসাইড হচ্ছে কি হচ্ছে না সেই তর্কে না গিয়ে এটুক বলা যেতে পারে যে, হিন্দু এসোসিয়েশনের বিলি করা কাগজপত্রে বর্তমান সরকারের বিশেষ কোন লাভ হয়নি। বরং কংগ্রেসম্যানরা হয়তো ভেবেছেন বর্তমান সরকারের হাতেও হিন্দু জেনসাইড হচ্ছে। তার উপর মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান যখন বলেছেন যে পাবনাতে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করেছে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিদের লোকজন, তখন বর্তমান সরকারের বিপদ আসলেই বেড়েছে।

পুরো শুনানিতে অনেক প্রশ্ন এসেছে। কিন্তু একটি ব্যাপারে কেউ কথা বাড়াননি। সেটা হলো তত্তবাবধায়ক সরকারের ইস্যু। কংগ্রেসম্যানরা সহ প্রতিটি বক্তা এই পদ্ধতির সমর্থন করেছেন। একাধিক বক্তা বলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কোন নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে না। এই ইস্যুতে কেউ কোন দ্বিতীয় প্রশ্নও করেননি। মনে হয়েছে এই ইস্যুটা এতোটাই কমনসেন্স ইস্যু ছিল যে কেউ প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করতে চাননি। এতে করে তত্বাবোধায়ক ইস্যুতে আমেরিকানদের কংগ্রেসম্যানদের মনোভাব কিছুটা হলেও বুঝা গিয়েছে।

একাধিক বক্তাদের কথা বার্তায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনটি পথের ধারণা পাওয়া গেছেঃ ১) সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন, যার সম্ভাবনা দিনে দিনে কমছে, ২) একক নির্বাচন ও ব্যাপক হানা হানি, এবং ৩) সামরিক শাসন।

পুরো আলোচনায় ভারতের বাংলাদেশ বিষয়ক অতি-উৎসাহ নিয়ে কেউ কোন আলোচনা করেননি। এটা কেউ করলে খুব ভালো হতো। আলি রিয়াজ তার বক্তব্যে বাংলাদেশের নিরাপত্তার কথা না বলে, ভারতের নিরাপত্তার কথা আগ বাড়িয়ে বলেছেন। শুনানির আলোচকদের উচিত ছিল আমেরিকানদের জানানো যে ভারতের সর্মথনে বাংলাদেশে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যেখানে বাংলাদেশতো বটেই, খোদ ভারত ও আমেরিকার স্বার্থও এখন হুমকির মুখে। যদিও জন সিফটন একবার বলেছেন যে, ভারতের উচিত হবে না বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দলের সাইড নেয়া।

শুনানিতে একাধিক বক্তা বর্তমান সরকারের সংবিধান সংশোধনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সকল সমস্যার মূল হিসেবেও এই সংশোধনকে বলা হয়েছে। একাধিক বক্তা বলেছেন যে দেশে হিংসা হানাহানি হলে ইসলামপন্থীদের উত্থান ঘটবে।

বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে মেজর জেনেরাল মুনিরুজ্জামান সামরিক বাহিনীর লোক হয়েও সিভিল সোসাইটির একাধিক ইস্যু তুলে ধরেছেন, যা আলি রিয়াজ তুলে ধরেননি। যেমন, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, টিভি চ্যানেল বন্ধ করার মতো ইস্যুগুলো আলি রিয়াজের মতো লেখক কাম অধ্যাপকের বলার কথা ছিল, একজন মেজর জেনেরালের না।

শুনানির দিন সকাল বেলায় প্রভাবশালি আমেরিকান পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটা অত্যন্ত ডাইরেক্ট এডিটোরিয়াল এসেছে। যেখানে শেখ হাসিনাকে বর্তমান অচলাবস্থার জন্যে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। যুদ্ধপরাধিদের বিচারকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। কংগ্রেস হেয়ারিং ও নিউ ইয়র্ক টাইমসের এডিটরিয়ালের টাইমিং খুবই গুরুত্ববহ। এর আগে ইন্ডিয়ার দৈনিক হিন্দুতেও একই সুরের একটি এডিটরিয়াল এসেছে।

পরিশেষে বলতে চাই, এভাবে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেশের সিভিল সোসাইটি/মিডিয়া যদি ক্ষমতাসীন সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে, তাহলে তা দেশের জন্য কতটুকু মঙ্গল বয়ে আনবে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

যারা হেয়ারিং-টি দেখেননি, দেখে নিন নিচের লিঙ্ক থেকে- (৫০ মিনিট থেকে দেখুন)

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s