মুহাম্মদ জাফর ইকবালের পদত্যাগটা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির যে কাজ তিনি করছিলেন – সেটার বিরুদ্ধে বামপন্থী সংগঠন আর আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের
অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয়ে ।
তার পদত্যাগ পত্রে সেই অভিমান স্পষ্ট ।
আমার মনে হয় – সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আইডিয়া খুবই চমৎকার । নিজে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেবার কারনে জানি শুধু একটা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়া গেলে ব্যাপার কতো ভালো হতো আমার জন্য ।
একটা জেলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেই সেটার ৫০% কোটা সুবিধা সে জেলার লোক পাবে – এমন হাস্যকর দাবী শুধু সিলেটিদের পক্ষেই করা সম্ভব । বলাবাহুল্য
শিক্ষিত হিসাবে সিলেটিদের খুব সুনাম কোন কালেই ছিলো না । লন্ডনি পয়সায় লাফঝাপ দেয়া – আর মননে শিক্ষিত হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ।
(যদিও বাংলাদেশের সবচে প্রগেসিভ অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সিলেটি – তবে তাকে হিসাবের বাইরে রাখতে হবে – কারন মাল মুহিতের মতো ছাগল অর্থমন্ত্রী হয়ে – তাকে ক্যান্সেল করে হিসাব সমান করে ফেলেছে )
এইরকম একটা অযৌক্তিক দাবী করে – তারা দেশেবাসীর সামনে ভাড় হিসাবে নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরলেন ।
যদিও ৫০% কোটার সাথে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের পদত্যাগের কোন সুত্র খুজে পাচ্ছি না ।
তাই যারা প্রতিবাদ করছেন – সঠিক চ্যানেলে প্রতিবাদ করেন । প্রতিবাদটা মন্ত্রীদ্বয় আর বাম সংগঠন গুলোর বিরুদ্ধে হওয়া দরকার ।
=====
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন । তার রাজাকার বিরোধী অবস্থান তীব্র ছিলো সবসময়ই । আদর্শিক অবস্থানে তার মতো তীব্রতা না থাকলে তার অবস্থানকে যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা করতাম । মূলত আমাদের প্রজন্ম এবং পরের প্রজন্মকে রাজাকার ঘৃণা করানো শেখানোতে তার অনেক অবদান আছে । এই কারনে মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে
রাজাকাররা এবং রাজাকারপ্রেমীরা তীব্র ঘৃণার চোখে দেখে । যেটা খুব সহজেই আগে বোঝা যেতো – বিনা কারনে জাফর ইকবাল বিদ্বেষ দেখে ।
সম্প্রতি সময়ে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল নিজেই নিজের দেবতুল্য অবস্থান বিতর্কিত করেছেন – খোলাখুলি আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে । রাজাকারের বিচার আর জামাত নিষিদ্ধ করন নিয়ে আওয়ামী টালবাহানাকে উনি হালকা করতে চেষ্টা করেছেন । যেনো রাজাকার বিরোধী ঘৃণার রোষ আওয়ামী লীগের ঘাড়ে না বর্তায় ।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার অবাক লেগেছে – উনি বিএনপির সময় সব দূর্নীতি, কূটচাল, মানবাধিকার লংঘন , ষড়যন্ত্র দেখতে পান — কিন্তু আওয়ামী লীগের ডাকাতী , সন্ত্রাস , মানবাধীকার লংঘন , কূটচাল , ষড়যন্ত্র দেখতে পান না । সম্প্রতি সময়ে তার লেখা পড়ে মনে হয়েছে , যে কোন মূল্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতা যাক এটাই দেখতে চেয়েছিলেন ।
নিরপেক্ষ নির্বাচন হৌক , প্রধানমন্ত্রী দুনিয়ার সবচে বড়ো মিথ্যুক জোচ্চর হোক , যেকোন উপায়ে ক্ষমতা আকড়ে থাকুক – এসব তিনি এড়িয়ে গেছেন । রাজাকার বিরোধী ঘৃণা
তার এইপর্যায়ে গেছে – যে বর্তমানে আওয়ামী লীগের দেশ লুন্ঠনকে তিনি বৈধতা দিচ্ছেন ।
এটা আমার জন্য খুব কষ্টকর একটা ব্যাপার – যাকে রোল মডেল মনে করতাম – তার দলকানাত্ব শুধু আমার উপর না – দেশের উপরই নেগেটিভ ইফেক্ট ফেলে ।
====
কিন্তু যে দলই করুন না কেন – মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো মানুষ বাংলাদেশের দরকার আছে । তার প্রভাবের কথা বর্ণনা করে – আরো ৫০০০ লাইন যোগ করবো না এই লেখাতে।
যারা তার প্রভাব সম্পর্কে সচেতন তারা জানেন তিনি কি। রাজাকাররা আর রাজাকারপ্রেমীরাও তার প্রভাব সম্পর্কে সচেতন ।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। উনার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দিয়ে পরিচালিত মন আর মনন দরকার আছে – দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একটির ।
উনি পদত্যাগ পত্র বাতিল করে আবার তার অবস্থানে ফেরত যান এই কামনা করি । যদিও তিনি সরাসরি আওয়ামী লিগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষের মুখোমুখি দাড়িয়েছেন — আশা করবো – তিনি তার ঘৃণা শুধু রাজাকার বিরোধীতায় সীমাবদ্ধ রাখবেন –
গড়পড়তা সব মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবেন না ।
কারন হচ্ছেন – তার বিরোধীপক্ষ – যদি রাজাকার ধরি – তারাও শক্তিশালী । আর তিনি যে দলের জন্য অন্ধ – সে দলেও তার শুভাকাংক্ষী কম । ভালো মানুষের শুভাকাংক্ষী কম থাকে ।
তার দলের ভিতরে তার পিঠে ছুড়ি মারা মানুষের অভাব হবে না; কার্যত – এরা জামাতীদের চেয়ে কম নোংরা না ।
====
যদিও জানি এসব লিখে কোন ফল হবে না – কারন বাংলাদেশে ট্রেন্ডই আছে – জ্ঞানী গুণী মানুষদের কোন একটা ট্যাগ দিয়ে নোংরাতম ভাষায় তাকে আক্রমন করে অপদস্থ করার ।
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের দলই এই কাজ-এ সবচে দক্ষ এবং পাইওনিয়র ।
সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার দাবী মেনে তাকে তার পদে ফেরত দেয়ার – একটা
আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখতে পারি ।
ভাবতে পারি মুহাম্মদ জাফর ইকবাল – শুধু আওয়ামী লীগের জন্য না লিখে – দেশের সবার জন্য লিখবেন ।
ভাবতে পারি – বিএনপির লোকজন – রাজাকারপ্রেম বাদ দিয়ে – মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ট্যাগবাজিতা থেকে বের হয়ে আসবে ।
একটা পারফেক্ট বাংলাদেশের মনে হয় আমরা এই স্বপ্ন সফল করে ফেলতে পারবো ।
কিন্তু বাস্তব অনেক কঠিন ।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/83308/%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%97_%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A8_%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%B0_%E0%A6%87%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B2
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের পদত্যাগ পত্রঃ
প্রিয় শা বি প্র বি
শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশী সময় এক জায়গায় কাটিয়েছি, আমরা দুজনেই এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছি । আমাদের ছাত্র-ছাত্রী এবং সহকর্মীরা আমাদের এই জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আমাদের কোন ভাষা নেই ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই দীর্ঘ সময়ে আমরা নানা ধরণের ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছি । নিজেদের বিশ্বাসের প্রতি আমাদের আস্থা ছিল বলে আমরা সবকিছু সহ্য করেছি-এমনকী আমরা আমাদের শিশু সন্তানদের বছরের পর বছর ঢাকায় রেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে কাজ করেছি । আমরা সব সময়েই জেনে এসেছি কিছু মানুষ আমাদের বিরোধীতা করেছে, এর সাথে সাথে এটাও জেনে এসেছি এখানকার অসংখ্য মানুষ আসলে আমাদের পাশে আছেন ।
দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি যখন একেবারেই শেষ পর্যায়ে তখন হঠাৎ করে আমরা দেখতে পেলাম যারা এতোদিন সবসময়ে আমাদের পাশে ছিলেন- তারা আমাদের পাশে নেই । সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বকীয়তা পুরোপুরি বজায় রেখে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবে । শুধুমাত্র একদিনে এক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে এবং দেশের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের ছুটোছুটি করতে হবে না । এই চমৎকার পদ্ধতিটি নিয়ে কারো কোন দুর্ভাবনা থাকতে পারে- সেটি আমরা কখনো কল্পনাও করিনি । আমরা পুরোপুরি অবিশ্বাস এবং বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম বামপন্থী এবং জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে বিরোধীতার সূচনা করল এবং স্বাভাবিকভাবে সেটি অন্যরা গ্রহণ করল । মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যখন এই পদ্ধতিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন- তখন আমাদের মনে হয়েছে আমাদের সবকিছু নতুন করে ভেবে দেখার সময় হয়েছে । যারা সবসময়েই আমাদের সবকিছুর বিরোধিতা করে, আমরা তাদের বিরোধিতার বিরুদ্ধে এতদিন কাজ করে এসেছি । কিন্তু যারা আমাদের স্বজন, যাদেরকে পাশে নিয়ে কাজ করে এসেছি- তারা যদি আমাদের পাশে না থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে ।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন মেনে সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও অতীতে শুধুমাত্র আমাদের উপস্থিতির জন্যে অনেকবার বিশ্ববিদ্যালয়কে জিম্মি করে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে । এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নয়- সারা দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়েকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হল । আমাদের মনে হয় আমরা যদি বিদায় নেই তাহলে ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আর এধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে না ।
৬০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসর নেয়ার কথা ছিল- আমরা সেভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম । সম্প্রতি শিক্ষকদের অবসর নেয়ার সময় ৬৫ বছর করার কারণে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, এখন মনে হয় সেটি আবার গুছিয়ে নেয়া যাবে । আমাদের একজনের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছে, সেটিতে হাত দিতে পারব । যে শিশুকিশোরেরা চিঠিপত্র লিখে, সময়ের অভাবে তাদের উত্তর দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না- এখন থেকে সেটে সম্ভব হবে । আমাদের অন্যজনের নির্যাতিত মহিলাদের জন্যে কাজ করার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল,- এখন সেই পরিকল্পনার জন্যে কাজ করতে পারবে । এছাড়াও আমাদের শিক্ষা-গবেষনা ও উদ্ভাবনীমূলক কাজ নিয়ে আরো অনেক স্বপ্ন রয়েছে- আমরা এখন তার জন্যে কাজ করতে পারব ।
এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে নিয়ে পরিপূর্ণ একটি জীবন উপহার দিয়েছে । এই অপূর্ব অভিজ্ঞতাটি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছি, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা-এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন এই দেশ এবং পৃথিবীর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে তখন আমরা গর্ব করে বলতে পারব আমরা এক সময়ে এখানে আমাদের শ্রম দিয়েছিলাম ।
স্বাক্ষর
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল- ইয়াসমীন হক