Z Force
যে দেশে পুলিশের গুলিতে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন মৃত্যু বরন করে (আট বছরের শিশু থেকে বয়স্ক প্রৌঢ়, সাধারণ মানুষ থেকে বিরোধী দলের বড় নেতা পর্যন্ত ), প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নামে গুম হয় ৫-১০ জন (যাদের হয় আর কোনও হদিস মিলেনা, বা পাওয়া যায় কোনও নির্জন স্থানে), সেই দেশে ভুল রায়ে একজন কে মৃত্যুদণ্ড দিলে সেটা খুব বড় কোনও ব্যাপারনা।
দেশে আসলেই মানুষের জীবনের কোনও মুল্য নাই। বিরোধী দল তো ‘মানুষের জাত না’ এরকমও একটি তত্ত্ব দিয়েছেন জনৈক বিতর্কিত ভুঁইফোঁড় বিজ্ঞানী। কিন্তু যখন বিষয়টি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সঙ্ঘটিত অপরাধে কাউকে ফাঁসি দেবার ব্যাপারে হয়, তখন সেটি বিশেষ বিশ্লেষণের দাবীদার অবশ্যই। কারণ, এর সাথে জড়িত আমাদের সকলের আবেগ এবং ইতিহাসের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা।
১৮ দলীয় জোটে বিএনপি এর একটি শরীক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে দলটির রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত স্পষ্টতই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির বিরুদ্ধে। তাদের সেই অবস্থান তারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা করার চেস্টা করেছেন। তাদের সেইসব যুক্তি গ্রহন বা বর্জনের দায়ভারে সাধারণ জনগণের হাতেই ন্যস্ত। রাজনৈতিক এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিএনপি র করা ১৮ দলীয় জোটের অংশ দেশের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার্থে । কিন্তু তাতে দুই দলের কারও স্বকীয়তা বিন্দুমাত্র হারিয়ে জায়নি, বা একে অন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়নি। উদাহরণ স্বরুপ ইউকে তে কনজারভেটিভ দল এবং লিবারেল দল আদর্শিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও লেবার পার্টির অনেকদিনের অপশাসনের বিরুদ্ধে (তাদের ভাষ্যমতে) তারা একজোট হয়ে রাজনীতি করছে। এতে এই দুইদল একে অন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়নি। এরকম ভুরি ভুরি অসংখ্য উদাহরণ আছে, যা দিতে থাকলে পুরো পোস্ট ভরে যাবে।
যেই ব্যাপারে এই পোস্ট সেই ব্যাপারে আসি। আব্দুল কাদের মোল্লা নামে জামাতের এক শীর্ষ নেতার মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার শেষে এখন ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় পুরো জাতি। এই লোকটিকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন দিলেও, পরবর্তীতে হাইকোর্ট ফাঁসির আদেশ দেন। আইনজ্ঞদের মতে এরকম নজির বাংলাদেশ তথা গোটা উপমহাদেশে এই প্রথম। তবে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে অবশ্যই তার প্রাপ্য সাজা সে পাবে। আর ১৯৭১ এ কসাই কাদের নামের ঢাকায় একজন অতি পরিচিত মানবতা বিরোধী অপরাধী ছিল, সেটা ঐতিহাসিক সত্য। তবে এই দুই কাদের যে একই ব্যাক্তি সেটি নিরঙ্কুশ ভাবে প্রমাণিত হয়েছে কিনা সেটা একান্তই বিচারিক বিষয়। মহামান্য আদালতের মতে এই দুই কাদেরই এক। ট্রাইব্যুনালের পরে একজন প্রত্যক্ষদর্শী মহিলার সাক্ষ্যে তার সাজা যাবজ্জীবন থেকে ফাঁসি হয়, জিনি বলেন তার পিতাকে তাঁর সামনেই হত্যা করে কসাই কাদের। তো সেটি সত্য হলে তো ফাঁসি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তো এতো বাক্যব্যয় কেন করছি তাহলে ? কারণ সেই মহিলার আসল পরিচয় নিয়েও সন্দেহের গুঞ্জন উঠেছে। কাদের মোল্লার পরিবার ও তার দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থাকা সেই মহিলার ছবির সাথে সাক্ষ্যদানকারীর মিল নেই। অবশ্য ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত অধিকাংশ আসামীই সবসময় নিজেকে নির্দোষ দাবী করে। কিন্তু এই সব অভিযোগকে বিন্দুমাত্র আমলে না নেওয়াটাও খুব স্বাভাবিক না। আর কোনও সুশীল মিডিয়াকেও দেখলাম না অনুসন্ধান করে সত্য উদ্ঘাটন করতে। এর আগেও কাদের মোল্লা তৎকালে মতিয়া, মেনন দের মতো সমাজতন্ত্রী ছিলেন বলে খোদ ক্ষমতাসীন ভারত লীগের সদস্যরাই বলেছে। এতো দুর্ধর্ষ গুন্ডা কিভাবে প্রেস ক্লাবে নির্বাচিত হয়েছিলো, বা ১৯৭২ এই কিভাবে সরকারী চাকরি পেয়েছিল, সেটাও বোধগম্য নয়। তবে, সেটা হয়তো আমাদের বোঝার ক্ষমতার অভাব, কারণ বিজ্ঞ আদালত নিশ্চয়ই এমন কিছু পেয়েছেন যাতে এসব কিছুকে একেবারে নিরঙ্কুশ ভাবে উড়িয়ে দিয়ে ফাঁসি বলবত করা হয়েছে। আবার তার রিভিউ পিটিশনও করার অধিকার নাই শুনলাম।
আমাদের ভয় হয় যে শেখ হাসিনা না আবার কাদের মোল্লাকে একজন মহানায়ক বানিয়ে দেন বাড়াবাড়ি করতে যেয়ে। কোনও একদিন যদি প্রমাণিত হয় এই দুই কাদের একছিলনা, সেইদিন হয়ত চূড়ান্ত ভাবে অপমান করা হবে স্বাধীনতার চেতনাকে। আর যাদের বিচার করা হচ্ছে তারা হচ্ছে পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়ক (auxiliary) শক্তি। এখানে মুখ্য (principal) শক্তি সেই পাকিস্তানীদের কে কিন্তু টোকাও দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। গত পাঁচ বছরে সেই চেষ্টাও কিন্তু করা হয়নি। সব প্রচেস্টা কেন্দ্রীভূত ছিল বিরোধী দলের কয়েকজন ‘হাই প্রফাইল’ নেতাদের অপরাধী প্রমাণ করার প্রতি। শেখ মুজিবুর রহমান কিসের জন্য ১৯৫ জন পাকিস্থানী যুদ্ধাপরাধী কে ছেড়ে দিলেন সিমলা চুক্তি করে, কিসের জন্য তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন সেই চুক্তিতে সই করেছিলেন তা আজও অজানা। আশা করি একদিন তিনি নিজেই সবাইকে বিস্তারিত বলবেন। মুজিবের সাথে টিক্কা খানের করমর্দন বা ভুট্টর সাথে সেই উষ্ণ আলিঙ্গনের কারণও অজানা এখনও।
তবে ১৯৭১ এ জামাতের ভূমিকা যেমন ছিল বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে, তেমনি বসনিয়ার জন্মের বিরুদ্ধেও ছিল সার্ব ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। তাদের প্রতিষ্ঠাতা নেতা Radovan Karadžić কিন্তু হেগের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের আসামী, অসংখ্য বস্নিয়ানদের হত্যার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে, প্রিন্সিপাল ফরস হিসেবে, অক্সিলারী হিসাবে নয় । কিন্ত তবুও, সেই দলটির বসনিয়াতে রাজনীতি করার অধিকার কেউ হরন করতে পারে নাই। সেই দেশের পারলামেন্টে তাদের প্রতিনিধি আছে আজ। গনতন্ত্র বোধ হয় এটাকেই বলে। জামাতের রাজনীতি করা নিয়ে বোধ হয় এখানে সরাসরি কিছু না বললেও আপনারা আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি।
পরিশেষে বলব ১৯৭১ আমাদের অহংকার। সেটাকে পুঁজি করে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থের কোনও চেষ্টাই কিন্তু বুমেরাং হবে। আশা করি কোনও অপশক্তিই সে সাহস দেখাবেনা। প্রকৃত অপরাধীদের অবশ্যই সাজা পেতে হবে। কিন্তু কেউ নিজ হাতে কাউকে হত্যা না করলে, বা নিজে কাউকে ধর্ষণ না করলেও সাজা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাও একটা অপরাধ। সেটা যদি কোনও হীন স্বার্থ চরিতার্থের জন্য হয়, তবে সেটা গুরুতর অপরাধ।