বলাই
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কার্যালয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের গতি-প্রকৃতির ওপর একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। হাইকমিশনের উদ্যোগেই ছিল এ আয়োজন। বাংলাদেশের সুপরিচিত লেখকদের অনেকেই সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন। সেমিনারে আলোচ্যসূচীর মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশের উপন্যাসের ভাষা কী রকম হবে।সেমিনারে সভাপতি ছিলেন সুনীল গঙ্গেপাধ্যায়। বাংলাদেশের লেখকরা একে একে তাদের বক্তব্য পেশ করার পর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পালা এল। তিনি ডায়াসে দাড়িয়ে কাটা কাটা কথায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা হবে বাংলাদেশের জনগণের মুখের ভাষার কাছাকাছি, তাতে করে যদি পশ্চিম বাংলার ভাষার চাইতে বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা, বিশেষ করে উপন্যাসের ভাষা যদি সম্পূর্ণ আলাদা খাতে প্রবাহিত হয়ে যায়, সেটা সকলের স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া উচিত।
ইলিয়াসের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ যে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যের মোড়লদের অনেকেরই ভালো লাগেনি সেদিন সন্ধ্যাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার গ্রান্ড হোটেলে বাংলাদেশের লেখকদের সম্মানে একটি ডিনারের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সব লেখককে সেখানে নিমন্ত্রণ করা হলেও ইলিয়াসকে ডাকা হয়নি। আনন্দবজারের এই অভদ্র আচরণে ইলিয়াস খুব ব্যাথিত হয়েছিলেন, অপমানিত বোধ করেছিলেন। দেশে ফিরে সমসাময়কি লেখকদের কাছে সে ক্ষোভের কথা গোপন করেননি তিনি। পরে তার জবাবটাও দিয়েছিলেন খাসা। বাংলাদেশের উপন্যাসের ভাষা কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার অনুবর্তী হয় খোয়াবনামা লিখে তার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখিয়েছিলেন তিনি।
হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রগঠনের গোপন বাসনা থেকে বঙ্কিম তার আনন্দমঠ উপন্যাসে যে সোশাল ডিসকোর্স তৈরি করেছিলেন ইলিয়াস তার খোয়াবনামায় সেটাকে ভেঙ্গে খান খান করে দেন। তবে ইলিয়াস আনন্দমঠের ডিসকোর্স ভাঙতে পারলেও আনন্দবাজার গোষ্ঠীর তাতে খুব সমস্যা হয়নি। কারণ এক ইলিয়াস প্রতিবাদ জানালেও বাংলাদেশের নামকরা অনেক জিনিয়াসই ততদিনে দাদাদের পকেটে ঢুকে গেছেন। আনন্দবাজার ভেতরে ভেতরে তার হিন্দুত্ববাদী আদর্শকে লালন করলেও উপরে উপরে অসাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা বুলি আউড়ে যাচ্ছে। আসলে আনন্দবাজারের চোখে বাংলাদেশ কখনই স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি। বরং তারা বাংলাদেশকে বরাবর ‘ছোটভাই’ হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। প্রযোজনে একে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে তারা।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখক। তার লেখার ধরন, মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন কারোরই নেই। এপার-ওপার মিলিয়ে সমসাময়িক লেখকদের তুলনায় জনপ্রিয়তায় তার অবস্থান ছিল শীর্ষে, এ নিয়ে দ্বিমত করলে বাজিতে হারতে হবে। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা বের করেছে। আর আনন্দবাজার হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদ ছেপেছে টুকরো খবরে। শিরোনাম ছিল ‘প্রয়াত কথাকার হুমায়ূন আহমেদ’। আনন্দবাজার গোষ্ঠী তাদের দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় হুমায়ূনের লেখা ছাপতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদ তাদের মনে শোকের ভাব জাগায়নি। কারণ জীবীত হুমায়ূনকে নিয়ে ব্যবসায় সুযোগ থাকলেও মৃত হুমায়ূনে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না।
অথচ একই বছরের ২৩ অক্টোবর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর আনন্দবাজার আট কলামে ব্যানার শিরোনামে সংবাদ ছেপেছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠতে পারে, একই অঙ্গনের জনপ্রিয় দুই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে পত্রিকায় কাভারেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বৈষম্য কেন? এক কথায় এর উত্তর হলো, ব্যবসায়িক স্বার্থ। সঙ্গে সাম্প্রদায়িক চেতনা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আনন্দবাজার এমন একটি ভাব দেখায় যেন তারা বাংলা সাহিত্যের একমাত্র ধারক ও বাহক। অভিভাবকও। তাই বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজারটাও তাদের দখলে থাকাটাই বাংলা সাহিত্যের জন্যই মঙ্গলজনক। এ বাজারটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা নানারকম কূটকৌশল নিয়ে থাকে। সেগুলোর প্রকাশও নানারকম। কখনো বাংলাদেশের কোনো লেখক-লেখিকার বই ছেপে বিতর্ক সৃষ্টি করে পয়সা রোজগারের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে, কখনো এ দেশের লেখকদের একাংশকে সম্মাননা দিয়ে নিজেদের স্বার্থরক্ষার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আনন্দবাজার গোষ্ঠী। আর কোনো ব্যক্তিকে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ সিদ্ধির অন্তরায় মনে করলে তাকে সমূলে ধ্বংস করতেও কখনো কুণ্ঠিত হয় না তারা। আন্দবাজারের ষড়যন্ত্রের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি লাঞ্ছিত হয়েছে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমেই এসে যাবে তসলিমা নাসরিনের কথাও। ভারতে মৌলবাদীরা যখন বাবরি মসজিদ ভাঙলো এবং তার জেরে ধরে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সপ্তাহখানেক সময়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার মানুষ খুন হয়ে গেল তখন পৃথিবীজুড়ে মানুষ ভারতের দিকে সমালোচনার আঙ্গুল তুলেছিল। তারা বলেছিল ভারত একটি নিপীড়নকারী রাষ্ট্র, সেখানে সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা নেই। এ নিয়ে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীমহল যখন চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল, ঠিক তখনই তাদের সামনে ‘আলোর রেখা’ হয়ে হাজির হয়েছিল তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’। ‘লজ্জা’ দিয়ে নিজেদের অপরাধবোধ চাপা দেওয়ার মস্ত সুযোগ পেয়েছিলেন তারা। আনন্দবাজার তসলিমার একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে টানা তিন বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছে। এপার-ওপার বাংলায় তাদের পোষা বুদ্ধিজীবীরা তসলিমাকে নিয়ে অব্যাহতভাবে কলম চালিয়ে গেছেন। লজ্জাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল সেদিকে বিশ্বের নজর ঘুরিয়ে দেওয়াই ছিল তাদের মূল কাজ। যাতে ভারতের সংঘটিত দাঙ্গার ওপর থেকে বিশ্ববাসীর নজর ঘুরে যায়। বাস্তবে তা হয়েছিলও বৈকি! বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠেছিল।লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রয়োজন শেষে আনন্দবাজার কিন্তু তসলিমাকে ঠিকই ছুড়ে ফেলেছে।
সাহিত্য ছেড়ে খেলার মাঠের দিকে এগুলেও একই চিত্র পাওয়া যাবে। ক্রিকেটে আজ বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত শক্তিই বলা যায়। আজ এ খেলায় বাংলাদেশকে বলে-কয়ে হারানোর দিন শেষ। কিন্তু ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো সাফল্যই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর বাহবা পায় না। গত ৪ নভেম্বরে এক-দিবসী ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। পরদিন বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো এ নিয়ে প্রধান বা দ্বিতীয় শিরোনামে খবর ছাপলেও আন্দবাজারে একটি লাইনও লেখা হয়নি। ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল ঢাকায়। টেলিগ্রাফ, বিবিসি, ক্রিকইনফো, সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের রিপোর্টে বলা হল, ঢাকায় দুর্দান্ত অনুষ্ঠান হয়েছে। অথচ একই অনুষ্ঠান কাভার করে আনন্দবাজারের গৌতম ভট্টচার্য্য যে লেখা লিখলেন তাতে মূল বিষয় বাদ দিয়ে সাংবাদিকদের একটু হেটে প্রেসবক্সে ঢোকার কষ্টটাকে ফুটিয়ে তোলাতেই নজর ছিল বেশি। অথচ গৌতমরা ভুলে যান, ১৯৯৬ সালে কলকাতা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ওপেনিং করতে গিয়ে লেজার শোর নামে কেলেঙ্কারি করে ফেলেছিল। সেদিন সারা পৃথিবীতে ‘ছি ছি’ পড়ে গিয়েছিল। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ একযুগ পার করলেও আজ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে তাদের দেশে খেলার আমন্ত্রণ জানায়নি। এ নিয়ে কিন্তু আনন্দবাজারের কোনো রা নেই।
সাহিত্য, খেলা ছাপিয়ে যদি রাজনীতির কথা ওঠে তো দেখা যাবে সেখানে আরেক কাঠি এগিয়ে আছে আনন্দবাজার গোষ্ঠী। যে পত্রিকায় হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয় টুকরো খবরে, নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশের খবরই ছাপা হয় না, সেই একই পত্রিকায় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে খবর ছাপা হয় হর-হামেশা। যেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তাদের আগ্রহ অসীম। যদিও সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বেশিরভাগ খবরেই বস্তুনিষ্ঠতার ধার ধারে না। বরং নিজেদের মতো করে একপাক্ষিকভাবে খবর প্রকাশের দিকেই মনোযোগ বেশি। সম্প্রতি প্রায় প্রতিদিনই আনন্দবাজারে বাংলাদেশ নিয়ে খবর থাকছে। খালেদা, হাসিনা, এরশাদ, জামায়াত কবে কখন কী করল, কী বলল তার সবই নিজেদের মতো ছাপছে তারা।কিছুদিন আগে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই তারেক রহমানকে আইএসআইয়ের সহযোগী বানিয়ে সংবাদ ছাপিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল তারা। জামায়াত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোপনে নাশকতার চেষ্টা করছে, জঙ্গি দল গঠন করছে বলে খবর ছড়াচ্ছে তারা। অথচ আগামী লোকসভা নির্বাচন ঘিরে বিজেপির মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল যে কংগ্রেসকে চোখ রাঙাচ্ছে সেদিকে যেন চোখ নেই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে বলে আনন্দবাজারের যে উদ্বেগ সেই একই উদ্বেগ ভারতের বেলায় দেখাচ্ছে না তারা। মূল কথা হলো বাজার দখলে রাখা। সেটা সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে, রাজনীতি, অর্থনীতি সবখানেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের বাজার দখলে রাখতে সুবিধা হয়, তাই বিএনপির উত্থান ঠেকাতে তারা মরিয়া।
জামাতের জঙ্গি আচরণেকে ইঙ্গিত করে আসলে তারা বিএনপিকে দমিয়ে রাখতে চায়। তাই আওয়ামী লীগ আমলে ফেলানি হত্যা, তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি না হওয়া কিংবা স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে মমতার অনাগ্রহ নিয়ে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে।তবে বাজার দখলে রাখার ক্ষেত্রে বিএনপি বেশি সুবিধা দিলে আওয়ামী লীগকে ছুড়ে ফেলতে এক মুহূর্তও ভাববে না তারা। যে বাঙালী জাতিয়তাবাদের কথা আনন্দবাজার বলে বেড়ায় সেটা আসলে সাম্প্রদায়িক চেতনায় ধারণ করা জাতীয়তাবাদ। বস্তুত আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনার সঙ্গে তাদের জাতিয়তাবাদের ধরন মেলে না। ব্রিটিশ আমলে দ্রুত ইংরেজী শিখে ইংরেজের দালালি করে কাচা পয়সা রোজগার করে যে মধ্যবিত্ত বাঙালী হিন্দু শ্রেণী বিকাশ লাভ করেছিল সেই শ্রেণীর বানানো হিন্দুত্ববাদী জাতিয়তাবাদেকই ধারণ করছে আনন্দবাজার।
এখনো মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া আতরাফ জনগোষ্ঠীর অংশ ভাবতেই পছন্দ করে তারা। আর নিজেদের ভাবে আশরাফ। নিজের অঞ্চলে নিজেদের ভাবনা প্রতিষ্ঠা করলে সমস্যা ছিল না, সমস্যা তখনই বাধে যখন তাদের ভাবনা তারা জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে বাণিজ্য করে যায়।