শাহবাগঃ আত্মপরিচয়ের সন্ধান বনাম আত্মপ্রতারণা — আমান আবদুহু

by Aman Abduhu

আমি শাহবাগকে অভিনন্দন জানাই। ওরা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে সফল। বাংলাদেশের রাম-বামপন্থী প্রগতিশীলের দল কিছু লাফাঙ্গা ছেলেমেয়েকে এক জায়গায় জড়ো করে বড় একটা কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে। বরং ওরা এমন একটা কাজ করতে পেরেছে, যে কাজের কোন কন্ট্রোল-অল্টার-ডিলিট বাটন নেই।

বর্তমান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বড় প্রসঙ্গ। একটা জাতি স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পরে এসে নিজের শেকড়ের সন্ধানে, নিজের ইতিহাস খননে, সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে। সাদা চোখে দেখলে খুব অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। সমস্যা হলো, এই পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষগুলো এতো জটিল যে সাদাচোখে কিছু দেখাটা নিরেট বোকামি। ঐ বোকামী না করতে গেলে দেখতে হয়, কারা এই আন্দোলন করেছে? কারা বাস্তবায়ন করলো বাংলাদেশে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’?

এ কলংকমুক্তির আন্দোলনের মূল শক্তি হলো পনেরো ষোল বছর বয়সী কিশোর কিশোরী থেকে শুরু করে ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বয়সী যুবক যুবতীর দল। এরা মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখা দূরের কথা, জন্মই নিয়েছে বহু বছর পরে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে, যুদ্ধের সময় বিভিন্ন কষ্ট করেছে, ঐ প্রজন্মটা চুপ করে বসে থেকেছে। কি চমৎকার? যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শীর ঘুম নাই।

তাহলে ঠিক কি কারণে এই নতুন প্রজন্ম হ্যামিলনের ইঁদূরের পালের মতো দলে দলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাস্তবায়ন করাটাকে তাদের জীবন যৌবনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়েছে? আমার মতে এ প্রশ্নের উত্তরে মাঝেই আছে বর্তমান বাংলাদেশ কে সঠিকভাবে বুঝবার উপায়।

মানুষ পৃথিবীতে শান্তির সাথে, আনন্দের সাথে বাঁচতে চায়। মানুষের বেসিক চাওয়া হলো নিরাপদে নিজ পরিবার বন্ধু সমাজের সাথে ভালোভাবে জীবনটা কাটানো। এরপর গিয়ে মানুষ ন্যায় অন্যায় হিসাব করে, নিজ মতপ্রকাশের অধিকার চায়। আব্রাহাম মাসলোর হায়রার্কি।

বাংলাদেশ একটা পশ্চাতপদ দেশ। পৃথিবীর অন্য দেশে, যেখানে মানুষের অধিকার আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি আছে, ওখানে গেলে বিষয়টা ভালোভাবে বুঝা যায়। বাংলাদেশে একটা নির্বোধ মানুষও কিশোরবেলাতেই বুঝে যায়, ভবিষ্যতে কি হবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। ন্যায় অন্যায়ের কোন বালাই নাই, সবজায়গাতে চুরি দুর্নীত ধান্দাবাজি আর শক্তির জয়জয়কার। ফলে মোটামুটিভাবে সবার ভেতরে অবচেতনে একধরণের বিক্ষুদ্ধ হতাশা গুমড়ে মরে। ঠিক এটাকেই কাজে লাগিয়েছে আওয়ামী ও বামপন্থীরা। নতুন প্রজন্মের সব হতাশা আর নপুংসকতার ক্ষোভের জন্য পত্র পত্রিকা আর জাফর ইকবালের দলদের দিয়ে বেশ কবছর ধরে স্কেপগোট বানিয়ে তুলেছে জামায়াতকে। সত্যিকার যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান আর্মিকে হাতে কাছে না পাওয়ার ক্ষোভ এই রাগকে আরো ভালোভাবে ফেনিয়ে তুলেছে।

নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করে, স্বাধীনতার মূল চেতনা হলো যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করা। নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করে, যুদ্ধাপরাধ করেছে জামায়াত। এ বিশ্বাসের আগুনে আগুনে লাকড়ির যোগান দিয়েছে জামাত নেতাদের নির্বুদ্ধিতা। এবং একটা মানুষ যখন কিছু বিশ্বাস করে, তার শক্তি অনেক বেশি। নতুন প্রজন্ম আরো অবচেতনে গিয়ে বিশ্বাস করে, এই রাস্তা ধরে হাটলে তারপরে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। নতুন সুর্য উঠবে, তার সোনালী রোদে হেসে খেলে নেচে গেয়ে ঘুরতে থাকবে বাংলাদেশীরা।

বর্তমান বাংলাদেশ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর জার্মানীর মাঝে আশ্চর্যজনক সব সাদৃশ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটা যখন বিধ্বস্ত, চাকরি বাকরি খাবার নিরাপত্তা কিছুর গ্যারান্টি নাই, তখন হিটলার মানুষের সে ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করেছিলো। সেই একই সংঘবদ্ধ ক্ষোভকে শক্তিকে পরিণত করেছে রাম-বামপন্থী ফ্রগতিশীলরা। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে তাকে কাজে লাগাচ্ছে। সুতরাং জাতি এখন বিপুল ক্ষোভে বুকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ, যদিও ক্ষোভটা আসলে মুক্তিযুদ্ধের না, এদের তো যুদ্ধের সময় জন্মই হয়নাই, বরং ক্ষোভটা হলো নিজের অক্ষমতার। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কলংক মোচনের পথে যাত্রা শুরু করেছে দানবীয় একটা শক্তি। যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে।

সমস্যা হলো মুক্তিযুদ্ধের কলংকমোচনের পরও বাংলাদেশ সেই পশ্চাতপদ, অনুন্নত, সন্ত্রাসাক্রান্ত এবং নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করতে ব্যস্ত একটা দেশ হিসেবেই থেকে যাবে অবধারিতভাবে। বরং সংঘর্ষে সংঘর্ষে অবস্থা আরো খারাপ হবে। তখন এই শাহবাগিরা হতবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করবে, কামডা কি হইলো? এবং তখন এই ফ্রান্কেষ্টাইন দানবের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য দরকার হবে নতুন নতুন স্কেপগোটের।

তবে মুনতাসির মামুন আর জাফর ইকবালের দল আপনার আমার ধারণার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান। তারা ইসলামী জঙ্গিবাদকে সেই ভিকটিম হিসেবে ফর্ম করার জন্য এখন থেকেই কাজ শুরু করেছে। যারা বাংলাদেশের ভালো চান,তাদের উচিত দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা উন্নত করার জন্য কাজ করা। তা যদি না হয়, তাহলে এই জাতি আজীবন বিপ্লবী হিসেবে থেকে যাবে এবং দানবীয় একটা সাপের মতো নিজেই নিজের লেজ চাবাতে থাকবে।

জামাতের সাথে যা হয়েছে, তাতে জামাত পয়েন্ট অভ নো রিটার্ণে চলে গেছে। সরাসরি সংঘাত না হলেও, ঘৃণা আর বিভক্তির এই সীমারেখা বাংলাদেশে আর কোনদিন মুছবে না। এবং আগামী দিনগুলোতে একাত্তর নিয়ে আরো অনেক কথাবার্তা হবে। একাত্তরের যুদ্ধের মূল কারণ কি ছিলো? পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার? না কি গাদ্দার মুজিবের সাথে ভারতের ষড়যন্ত্র? এইসব প্রশ্ন আরো অনেক বেশি শোনা যাবে। আমার জন্ম একাত্তরের বহু পরে। এখন আমি যদি শর্মিলা বসুর মতো তথ্যনির্ভর একটা বই লিখে ফেলতে পারি অথবা একটা মুভি বানিয়ে ফেলতে পারি, তখন শাহবাগ প্রাণপণে চেষ্টা করবে যুদ্ধাপরাধ যেহেতু সম্ভব না, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে আমাকে ফাঁসি দিতে। শাহবাগ এমন একটা শক্তি, যার কাছে বিচারের অর্থ হলো ফাঁসি। শাহবাগের হাত ধরে বাংলাদেশের এই দেশপ্রেম এমনটা শক্তি হিসেবে বড় হবে, যার কাছে বিরোধী মতের একমাত্র প্রতিকার হলো ফাঁসি।

কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। সেই সীমা যখন পার হয়ে যাবে, তখন রাষ্ট্র হিসেবে এই বাংলাদেশের গর্ব করার আর কিছু থাকবেনা। তখন একাত্তরের সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নতুন ইতিহাসে লেখা হবে সাত বিশ্বাসঘাতকশ্রেষ্ঠ হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ হবে বেকুব,আর কেউ হবে এ মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকারী। এমনটা হলে তা হবে সেই আত্মত্যাগকারী মহান মানুষগুলোর চুড়ান্ত অবমাননা। তারা কেউ আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো কলকাতায় দলে দলে গিয়ে মদ মাংসের উৎসবে দিন কাটাননি। ঐ মানুষগুলোর ত্যাগের সত্যিকার মূল্যয়ন সত্য ইতিহাস দিয়েই সম্ভব, মিথ্যা আর গণউন্মত্ততা কোনদিন তাদের জন্য সম্মান আনবে না।

বরং বাংলাদেশ যদি স্বাভাবিক ও মধ্যআয়ের দেশ না হয়,রাজনৈতিক হানাহানি যদি চলতেই থাকে, তাহলে আমাদের পরের প্রজন্মকে আমরা বর্তমান বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ একটা জাহান্নামে রেখে যাবো। কলংকমোচন তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার জন্য চিৎকারই হবে ঐ বাংলাদেশের একমাত্র আকুতি।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s