মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি, তবে…

1

অতিথি লেখক- খোমেনী এহসান 

আমি আগের কোনো একটা লেখায় বলেছিলাম যে দেশে ৬৯ এর মতো গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি আজকের লেখায় বলছি দেশে ১৯৭১ এর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতোই রাষ্ট্রের পক্ষের (পাকিস্তানের বদলে এখন বাংলাদেশ) হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা দেশের নানান জায়গায় স্বৈরশাসক ( ইয়াহিয়া খানের বদলে শেখ হাসিনা) বিরোধীদের বাড়িঘরে হানা দিচ্ছে। বিরোধীদের দেখামাত্রই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।এসবই ফ্যাক্ট। ঘটনা। বাস্তবতা। গণমাধ্যম প্রচার করুক বা না করুক। ঘটনা ঘটছে। মানুষ খুন হচ্ছে। গণহত্যা হচ্ছে। ক্লিনজিং চলছে। নির্মূলাভিযান। ১৯৭১ এও প্রচার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ধামাচাপা দিয়েছে গণমাধ্যম। কিন্তু হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি।
২.
আমি খুব বেশি আবেগতাড়িত থাকতে পারছি না। তাই বলছি, নাগরিকদের বিরুদ্ধে স্বৈরশাসকদের যে ভূমিকা তা শুধু শেখ হাসিনাই পালন করছেন না। এই ভূমিকা স্বাধীন বাংলাদেশের সব সরকারই কমবেশি পালন করেছে।এটা বুঝতে হলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের বদলে ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ দিয়ে গঠিত রাষ্ট্র মাত্রই জুলুমের রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের সব সরকারই স্বৈরশাসন চালায়। কেউ বেশি চালায় আর কেউ কম চালায়। মাত্রা কমবেশির কারণে আমরা স্বৈরশাসন নিয়ে আবেগ তাড়িত থাকি। শেখ মুজিবকে ভালোবাসি বা জিয়াকে গালি দেই। আবার জিয়াকে ভালোবাসি বা শেখকে গালি দেই। একইভাবে শেখ হাসিনাকে ভালোবাসি বা খালেদা জিয়াকে গালি দেই। আবার খালেদা জিয়াকে ভালোবাসি বা শেখের বেটিকে গালি দেই।

কিন্তু ইয়াহিয়া খানের শাসন, পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র, পাকিস্তানী আর্মি-পুলিশের মতো হানাদার বাহিনী ও দালাল-রাজাকারদের চিনে নেওয়ার জন্য একটি বিষয়ই যথেষ্ট। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধায়নে নাগরিকদের হত্যা। ব্যস, চেনা হয়ে গেলে। লাশ দেখে আমরা রাষ্ট্রকে চিনে নিতে পারি। আমার ভাই ১৯৭১ এ না ২০১৩ এ খুন হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ কে খুন করছে। কে আমাদের বুকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। নিশ্চয় চূড়ান্ত ধান্দাবাজ জালেম ছাড়া কেউ এ কথা বলতে পারে না যে পাকিস্তানীদের হাতে খুন হতে কষ্ট লাগে, আর বাংলাদেশীদের হাতে খুন হতে আরাম লাগে। খুনের স্বাদ সব স্থান কাল পাত্র ভেদে একই। যেমন মায়ের দুধের স্বাদ, মা ইংরেজ না বাঙালী ভেদে আলাদা নয়।
৩.
মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজ করলেই যে সব সময় মুক্তিযুদ্ধ চলে এটা ঠিক নয়। দুনিয়া জুড়েই মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪২ বছর ধরেই মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।
শেখ মুজিবের সময় শহীদ কমরেড সিরাজ সিকদার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। জিয়ার সময় চেষ্টাও ছিল না। সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শুধু লাশ পড়েছে। এরশাদের সময় একটা চেষ্টা ছিলো। সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই। ছাত্ররা নতুন গঠনতন্ত্রের আওয়াজ তুলেছিলেন যদিও। কিন্তু গণতন্ত্রের লড়াই শেষ পর্যন্ত ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখায় এরশাদের শাসনের বৈধতা, ধারাবাহিকতার নামে বিদ্যমান সংবিধান বহাল রাখা ও সামন্ত প্রভুদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে পরিণত হয়েছে।
অত্যন্ত নোংরা কাজ হয়েছে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। এখানে জনগণের পক্ষে কোনো দাবি দাওয়া ছিল না। বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন হয়েছে। সরকারগুলান টিকে থাকতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে একবারই সুযোগ এসেছিল। এক এগারর সেনা-সুশীল শাসনের দুই বছরের সময়। কিন্তু ছাত্ররা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। রাজনৈতিক দলের ভাড়া খাটার দাস মানসিকতা আর নতুন রাষ্ট্র গড়ার বাসনার অনুপস্থিতিই এর কারণ।
৪.
মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যমান হওয়া নাগরিকদের রাজনৈতিকতার উপর নির্ভরশীল। এটা অবশ্য করতে হয় রাজনৈতিক দলকে। ১৯৭১ এ এটা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সম্ভব করেছিল।আজ আমরা স্বীকার করতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধটা সম্ভব হয়েছিল সত্যিকার অর্থেই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কারণে। ধরেন শেখ মুজিব ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি হলেন। তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ হতো? হতো না।কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে, কে গোটা পাকিস্তান শাসন করবে এই প্রশ্নের সুরাহা না হওয়ায় যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তা ঠিক না। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব তাকে ক্ষমতার জায়গার চেয়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব হিসেবে হাজির করতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। তারা শুধু এট হাজিরই করেনি। বরং তারা গোটা পাকিস্তানের মসনদে আওয়ামী লীগের বসতে পারা না পারারা প্রশ্নকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির প্রশ্নে পরিণত করেছিল।
আমরা দেখতে পেলাম পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাজনৈতিকভাবে সমঝোতার বৈঠকে এ প্রশ্নের সুরাহা করতে পারেনি। তারা বরং বন্দুকের জোরে এই প্রশ্নের জবাব দিতে চেয়েছে। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো। শেখ মুজিব কী পেলো, আওয়ামী লীগ কী পেলো এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ পেতে গিয়ে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপহার দিয়েছে। এখন এই স্বাধীনতাকে আমরা কতখানি অর্থবহ করতে পারি সেটার সাফল্য ব্যর্থতা আমাদেরই। আওয়ামী লীগ তার চাওয়ার মধ্যেই খাবি খাবে এটাই স্বাভাবিক।
৫.
তাহলে আমরা এ আলোচনার উপসংহারে পৌছাতে পারি। বিরোধী দলও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার দাবি তুলে আন্দোলন করেছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের প্রশ্নটি সরকার রাজনৈতিকভাবে সমঝোতার বৈঠকে সুরাহা করতে চায়নি। তারা ইয়াহিয়া খানের মতো বন্দুক বেছে নিয়েছে।ইয়াহিয়ার মতোই এ সরকারের তাকত। কারণ ইয়াহিয়ার পাশে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যেমন ছিল তেমনি শেখ হাসিনার পাশে ভারত আছে। তবে ভারত অপেক্ষাকৃত দুর্বল, শেখ হাসিনাও দুর্বল। তাই ১৯৭১ এর মতো বড় গণহত্যা হচ্ছে না। এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো বিরোধী দল নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিকে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নের বাইরে বড় পরিসরে হাজির করতে পারেনি। তারা বলতে পারছে না যে কেন শেখ হাসিনার বদলে তাদের ক্ষমতায় আনতে হবে। তাদের ক্ষমতায় আনলে শেখ হাসিনার চেয়ে আলাদা কী উপহার দেবে তারা?
দুঃখের বিষয় খালেদা জিয়া মাঝেমধ্যে নানা সংবাদ সম্মেলনে বা জনসভায় এই প্রশ্নের একটা গোজামিলের জবাব দেন। তিনি বলেন ক্ষমতায় গেলে শেখ হাসিনার চেয়ে কম মাত্রায় শোষণ জুলুম করবেন। তাই তো তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে তারা ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার সরকার করবেন। দুর্নীতি করবেন না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সব গণমাধ্যমকে সুযোগ দেবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কিন্তু একবারও বলেন না স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান বদলাবেন, র‌্যাব ভেঙ্গে দেবেন, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার করবেন, বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা বাতিল ও দুর্নীতিবাজ দলীয় বিচারপতিদের বিচার করবেন। এমনকি তিনি বলেন না যে সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী পদকে যেভাবে হিটলারের মতো নাৎসীগিরি করার সুযোগ দেয়া হয়েছে তা থেকে তিনি বিরত থাকবেন এবং তিনি এই অসহ্য ক্ষমতাকে তিনি হ্রাস করবেন। তিনি বলেন না যে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করবেন। তিনি বলেন না রাষ্ট্রের সর্বত্র না পারেন অন্তত ক্ষমতাসীন দলে তিনি গণতন্ত্র কায়েম করবেন।কাজেই মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতিতে অসংখ্য মানুষের খুন দুঃখজনক অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন আমাদের কাজ হলো এই সব খুন বন্দ করা এবং বিরোধী দল-সরকারের মধ্যে সমঝোতা করা।
মুক্তিযুদ্ধ হলে আমরা অবশ্য নিজেরাই মুক্তিযোদ্ধা হতে পাত্তুম।

One thought on “মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি, তবে…

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s