Rogue ইনসটিটিউশন এবং নাগরিক আনুগত্য

by  সায়নুল হোসেন

জিয়া হাসানের “ইনস্টিটিউশন এর পক্ষে থাকুন – আমার স্টেটাস এর সমালোচকদের সমালোচনার জবাব“ শিরোনামের পোস্ট-টিতে যে মত-বিনিময় হচ্ছে এবং তার উত্তর দিতে গিয়ে জিয়া হাসান যে স্ট্যান্ডার্ড দাঁড় করাচ্ছেন, তাতে একটি জিনিস পরিষ্কার,  স্বাধীন বাংলাদেশে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডই যেন একমাত্র স্ট্যান্ডার্ড।

 

   সম্মানিত সংসদ-সদস্য বা বিশিষ্ট সংস্ক্রৃতি-ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামানের গাড়ি-বহরের উপড় যে হামলা হয়েছিল, তা একটি নিন্দনীয় অপরাধ। জিয়া হাসান তুলে ধরতে চেয়েছিলেন কেন তা অপরাধ। তুলে ধরতে গিয়ে, ইনস্টিটিউটের ভায়োলেন্সের রাইট আছে বলেছেন। তাহলে কখন ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে ভায়োলেন্স জায়েজ হবে? তাঁর উত্তর অনুযায়ী, সোশাল মোরাল সেটি ঠিক করবে। সমাজ যখন মনে করবে, জায়েজ, তখন ভায়োলেন্স জায়েজ। জনতা যে আন্দোলনে  সম্পৃক্ত হবে, সেখানে আইন-বাহিনীর সব চেক-পোস্ট কর্পূরের মত উড়ে যাবে। এইটা তাঁর স্টান্স। এই জায়গাতে তাঁর সাথে আমার ভিন্নমত।

   তাঁর কথা যদি মেনে নিই, তবে নূরের গাড়িতে যদি কয়েকজন জামাতী আক্রমণ না করে কয়েক লক্ষ বাঙ্গালী আক্রমণ করত, তবে তা হত জায়েজ। আর আমি মনে করি, নূরের গাড়িতে লক্ষ লোক কেন, যদি ষোল কোটি লোকও আক্রমণ করত, তা-ও হত নিন্দনীয়, বিচারযোগ্য অপরাধ। কিংবা আরও সহজভাবে বলি, শাহবাগের লক্ষ লক্ষ জনতা যদি হাতের সামনে মাহমুদুর রহমানের গাড়ি পেয়ে সেখানে সামান্য একটা ঢিল দিত, সামাজিক নৈতিকতার আধিক্য বা প্রাধান্য দিয়ে সেটাকে জায়েজ ভাবার কোন কারণই নেই।

   জিয়া হাসান এই পোস্টটিতে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড যেখানে আমাদের একটিমাত্র সিংগল স্ট্যান্ডার্ড, সেখানে ইন্সটিউশনের ভায়োলেন্সের রাইট নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড লিখতে গেলে তাকে আরও কয়েকটা নোট লিখে যেতে হবে মনে হচ্ছে। তাঁর লেখাগুলোর অপেক্ষায় রইলাম। তবে, আমি কেন লিখতে বসেছি? কারণ, এই বিতর্ক আমার বড় কাম্য বিতর্ক। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড-এর যে ধুম্রজাল গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে, সে ধুম্রজালটি সরাতে হবে এখনই।

   এবং, এই ধুম্রজাল সরানোর জন্যে, চলুন, দবির-কবীর-এর উদাহরণের আশ্রয় নিই। ধরুন, দবীর তার প্রিয় সাইকেলটি হারিয়ে ফেলল (বা কেউ সেটাকে চুরি করে নিয়ে গেল)। একদিন দবীর দেখল, সাইকেলটি তার পাড়ার কবীর দিব্যি চালিয়ে বেড়াচ্ছে। সাইকেলটি রাখাও হচ্ছে কবীরের বাড়িতে। দবীর এখন কি করতে পারে?

(১) কবীরের কাছ থেকে জোড় করে সাইকেলটি তুলে নিয়ে আসতে পারে (কারণ, সাইকেলের আসল মালিক তো দবীরই)।

(২) পাড়ার সরকারী ছাত্রনেতাকে অনুরোধ করতে পারে সাইকেলটি উদ্ধার করে দেয়ার জন্যে (কারণ, ছাত্ররাই তো জনগণের অধিকার রক্ষার আদায়ে বারবার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছে)

(৩) দবীর নিজের সাইকেলের কথা ভুলে গিয়ে অন্য কোন নিরীহ সাবের-এর সাইকেলটি চুরি করে নিজেই চালাতে পারে (“যে রাষ্ট্রে যে নিয়ম”, সমাজের মোরাল হয়তো এখানে যেতে পারে)

(৪) উপড়ের সবগুলোই

   উপড়ের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে থাকুন। সে ফাঁকে, জাপানে ইন্‌জিনিয়ারের চাকুরি করেও ম্যানেজমেন্টে আইন নিয়ে সামান্য যে জ্ঞান নিতে হয়েছে, তার কিছুটা শেয়ার করি।

   গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় আইনের একটি মূল নীতি হল, ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্ত নিজের নেয়ার মৌলিক অধিকার অন্য কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আপনি দিনে ষাট টাকা রোজগার করে পঞ্চাশ টাকার চটপটি খাওয়ার ইচ্ছা করলে, আইন বলবে, আপনার সেটা খাওয়ার অধিকার আছে। “এত সামান্য উপার্জনের লোক-এর চটপটি খাওয়ার দরকারটি কি?”-এ নিয়ে নৈতিকতার বিতর্ক হয়তো করা যায়, কিন্তু ষোলকোটি লোক তাকে ছিঃ ছিঃ করলেও কোনভাবেই তার চটপটি খাওয়ার অধিকারকে বাধা দিতে পারবে না। এটাই গণতন্ত্রে আইনের অধিকার। একইভাবে ব্যক্তি তার পছন্দমত সাইকেল কিনবে, সেটা তার মৌলিক অধিকার।  আমার-আপনার বা রাষ্ট্র নামক কোন ইনস্টিটিউশনের ক্ষমতা নেই তার এই সাইকেলের স্বত্বাধিকার থেকে তাকে বঞ্চনা করার।

   আইনের আরেকটি মূল নীতি হল, আইন প্রয়োগের ক্ষমতা আম-জনতার নেই। উপড়ের দবীর-কবীর-এর উদাহরণে দবীরের সাইকেলটি কবীরের বাসা থেকে নিয়ে আসার ক্ষমতা আছে শুধু পুলিশের, এবং এই নির্দেশটি দেয়ার দায়িত্ব আছে শুধু বিচারকের। আপনার সাইকেল, তাই বলে আপনি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবেন, এই অধিকার আপনার নেই। এই অধিকারটি আছে শুধু সরকারের (বা পুলিশের)। জিয়া হাসান ভাই-এর এখানেই ভুল। রাষ্ট্রের ভায়োলেন্সের অধিকার আছে যে তত্ত্বটি দিয়েছে, তা সঠিক নয় । রাষ্ট্রের কেবল আইন প্রয়োগের অধিকার আছে।

   কথা হল, কবীর যদি বিচারপতির নির্দেশ সত্বেও সাগ্রহে সাইকেলটি পুলিশের বা রাষ্ট্রের হাতে দিতে রাজী না হয়, রাষ্ট্রের তো তখন ভায়োলেন্স প্রয়োগ করতেই হবে। আমি সেখানে একমত। তবে, বুঝতে হবে, এটি আইনের মধ্যে থাকা শক্তি-প্রয়োগ। কবীরকে গুলি করে সাইকেলটি নিয়ে আসার ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেয়া হয় নি। সাইকেলটি কবীরের কাছ থেকে নিয়ে আসার জন্যে “সমানুপাতিক” শক্তি-প্রয়োগের বাইরে রাষ্ট্র কোন ভায়োলেন্স-এ যেতে পারবে না। আর, রাষ্ট্র নিজেই ঐ সাইকেলটি নিজের বলে দাবী করতে পারবে না। দুটোই বে-আইনী।

   প্রশ্ন হল, পুলিশ বা বিচারক উভয়ই যদি আইনের বাইরে যায়, তাহলে কি হবে? বিচারক যদি বলে সাইকেলটা দবীরের হলেও সাইকেল চালাতে পারবে কেবল কবীরই কিংবা পুলিশ গিয়ে যদি দবীরকে বলে, সাইকেলটা দবীর নিজের দাবী করলেই দবীরকে জামাত-শিবির নামে আখ্যায়িত করা হবে, সুতরাং, অফ্‌ যাওয়াই ভাল, তাহলে দবীর কি করবে? তার অধিকার রক্ষার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা যাদের দেয়া হয়েছে, তারাই যদি সংবিধান বা আইন না মেনে চলে, তবে কে আইন প্রয়োগ করবে?

এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। ফুটবল খেলায় একটি বলের বদলে দুইটি বল দিয়ে খেললে কি হবে তার উত্তর যেমন আমার জানা নেই, ব্যাপারটিও তাই। একটি নৈরাজ্য তৈরি হবেই। সেখানে সন্দেহ নেই। এবং এই নৈরাজ্যের কারণে দবীর বা কবীর-এর চাইতে হাজারো গুণ বেশি দায়ী হবে বিচারক বা পুলিশ (সরকার) কারণ ক্ষমতা ও প্রিভিলেজ তাদেরকে বেশি দেয়া হয়েছিল।

   একাত্তরে (সত্যিকার অর্থে, সত্তরের নির্বাচনে) পাকিস্তান নামক দেশ শাসনের ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন। আইনানুযায়ী বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। রাষ্ট্র (মিলিটারী জান্তা) নিজেই আইন ভঙ্গ করলো। উল্টো হানাদার হয়ে আক্রমণ করলো নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের। দবীর বা কবীর নয়, রাষ্ট্র নিজেই আইনের বাইরে চলে গেল। এখানে রাষ্ট্রের উপড় ভরসা করার আর কোন আইনগত ভিত্তি ছিল না। কাজেই, নতুন করে আইনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে এই  পাকিস্তান নামক হানাদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় ছিল না। একাত্তরে খানসেনাদের মারাটা জায়েজ ছিল কি-না, সরকার যেখানে নিজেই আইনকে তোয়াক্কা করে নি, সেখানে এই প্রশ্নটি অবান্তর। তখনকার জামাতী-মুসলিম লিগারদের মোরাল-এর বিচারে যাওয়ার আগে, আইনের জায়গায়ই এখানে ওরা নিজেদেরকে বে-আইনী হয়ে গেছে, সেটা উপলব্ধি করাটা জরুরী।

   আজকের অবস্থা কি একই রকম? আজকের আওয়ামী লীগের সরকার আর একাত্তরের ইয়াহিয়ার সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি? অর্থাৎ সরকার আইনের বাইরে নিজেকে নিয়ে গেছে কি? বিচারপতিরাও সংবিধান-রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নিজেদেরকে সংবিধানের উপড়ে ভাবা শুরু করছে কি? রাষ্ট্র (সরকার ও বিচার বিভাগ) যখন দবীর-কবীরের অধিকার রক্ষা না করে নিজেকে আইনের বাইরে নিয়ে যায়, তখনও দবীর-কবীর-রা কি আইনের খেলা খেলবে? আমি জানি, জিয়া হাসান কি উত্তর দেবেন। উনি বলবেন, জনগণ যদি বাঁধ-ভাঙ্গা স্রোতের মত বের হয়, তবে সব স্বৈরাচার বিদায় নেবে। কিন্তু, এই উত্তরে একাধিক সমস্যা আছে। প্রথমত, সব জনগণ বের হবে না (যেমন, কবীরের মত সুবিধাভোগীরা বা দবীরের মত নীরবে নিভৃতে ক্রন্দনকারীরা)/যারা ঘরে থাকবে তাদেরকে কি হিসেবে চিহ্নিত করবেন? বাধ-ভাংগার পক্ষে না বিপক্ষে? মোরাল হ্যাজার্ড যে চলে আসবে না তা কিভাবে বুঝবেন (অর্থাৎ, অসৎ উদ্দেশ্যের লোকেরাই যে জোর-গলায় শ্লোগান দেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?)/ দ্বিতীয়ত, এই বাঁধ-ভাঙ্গার কাজটি রমনার বটতলায় বসে বৈশাখীর গান শোনার মত ফ্রি হবে না, অনেক জীবন যাবে এখানে। তাহিরির স্কয়ারের জোয়ার আনতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই বার শ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। তার বদলে কোন এক বে-আইনী লোক হোসনী মোবারক-কে গুলি করে তাকে সরিয়ে দিলে ১১শ নিরানব্বই লোকের জীবন বাচতো। জিয়া হাসানের সমাধানে এই ১১শ নিরানব্বই লোকের জীবন বাঁচানোর অপ্‌শন নেই।

   উপসংহার হল, রাষ্ট্র স্বৈরাচারী হয়ে গেলে সবকিছু অমানবিক হয়ে যায়। আইনের সোপান ব্যর্থ হয়। এখানে ফল্ট্‌-টলারেন্ট সিস্টেম কাজ করে না। আমার-আপনার সবচাইতে পবিত্র দায়িত্ব আমাদের সরকারকে স্বৈরাচারী না হতে দেয়া। এখানে মোরাল-এর মত সাব্‌জেক্টিভ বিষয় আনতে গেলে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অনিবার্য ভাবে চলে আসবে। লক্ষ লক্ষ শাহবাগী দিয়ে মাহমুদুর রহমানকে ভয় দেখানো আর কয়েক ডজন জামাতী দিয়ে নূরকে আঘাত করা দুটোই বে-আইনী, কে করছে তা দিয়ে ন্যায্যতা যাচাই করার ব্যাপার এটা না। আমাদের এমন কিছুকে আস্কারা দেয়া ঠিক হবে না, যেখানে বে-আইনী হওয়াটা অনিবার্য আইন হয়ে উঠে।

   পুনশ্চঃ আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-কে অবরোধ করার কর্মসূচীর বিরুদ্ধে। দবীর-কবীর-এর উদাহরণে অবরোধ বা পিকেটিং-এর কোন ন্যয্যতা নেই। কেউ নিজেকে বঞ্চিত মনে করলে বিচারকের কাছে যান। বিচারক বঞ্চিত-এর বিরুদ্ধে রায় দিলে মেনে নিতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণ-আন্দোলন বলে কোন শর্ট-কার্ট নেই। স্বৈরাচার সরানোর কোন গণতান্ত্রিক উপায়ও নেই।

Sainul Hossain’s Blog is www.prottasha-bd.com

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s