-
পলিটিক্যাল ওরিয়েন্টেশনে উল্টো মেরুর হলেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি, বিশেষভাবে নিও-কনদের ব্যাপক মিল লক্ষ্য করা যায়। রিপাবলিকান পার্টির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যদলের তৈরি স্থিতিশীল ও বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির কাঁধে চড়ে ক্ষমতায় এসে সবকিছু ফেলে রেখে যুদ্ধের দামামা বাজানো শুরু করা। হাওয়া থেকে পাওয়া, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের তৈরি করা খবরের উপর ভিত্তি করে পায়ে পা বাঁধিয়ে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করা বা যুদ্ধ লাগিয়ে ছাড়া। তাদের পালে ক্রমাগত হাওয়া দিতে থাকে হেরিটেজ ফাউন্ডেশন বা ফক্স চ্যানেলের মতো আশীর্বাদপুষ্ট ঘৃণাজীবি থিংকট্যাঙ্ক ও মিডিয়া – ব্যাপারটা যেন, এ মুহূর্তে আমেরিকা বা বিশ্বের জন্য এটাই সবচেয়ে জরুরী কাজ, বাকি সব গৌণ। অন্য সকল ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে কৃত্রিম ভাবে যুদ্ধাবস্থা তৈরির এই কৌশল রিপাবলিকান পার্টির সিগনেচার মুভ। পেছন থেকে মদদ যোগায় AIPAC এর মতো যায়োনিস্ট লবি এবং ডিক চেনির হ্যালিবার্টনের মতো সংস্থাগুলো যারা যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ ও সার্ভিস পৌঁছানোর বিলিয়ন ডলারের কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, যুদ্ধ যাদের কাছে শুধুই ব্যবসা। চতুর্মাত্রিক প্রচারণায় বিভ্রান্ত জনগণ পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ।
আমেরিকার জনগণের বৈশিষ্ট্য হোল এরা যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্টের পাশে থাকে, অন্তত বেশ কিছু সময়ের জন্য। জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে অনায়াসে পার করে দেয়া যায় দুই টার্ম। কিন্তু ততদিনে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা যুদ্ধে উদরপূর্তি হয়েছে হ্যালিবার্টন সমগোত্রের, ফলস্বরূপ জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড গেছে ভেঙ্গে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ জনগণ যখন অনুধাবন করে পরের বেলার অন্ন সংস্থানই এ মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা – বিশাল কোন মতাদর্শিক সংকট বা গায়ে পড়ে বিশ্বের মোড়লগিরি নয়, পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে। অন্য দল ক্ষমতায় আসার পর আর সব ছাপিয়ে তাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে বা উঠতে বাধ্য হয় ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার। ভুল এ দলটিও যে করে না, তা নয়। তবে পায়ে পা বাঁধিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় তাদের উৎসাহ কম, আর সে সুযোগই বা কোথায়? বন্ধ হয়ে যাওয়া অর্থনীতির চাকা রাতারাতি চালু হচ্ছে না কেন, এ নিয়ে জনগণ ও বিরোধী দলের কাছে ক্রমাগত জবাবদিহি করতেই নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। একসময় অর্থনীতির চাকা ঘোরে, স্থিতিশীল ও বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির কাঁধে বন্দুক রেখে রিপাবলিকানরা জনগণকে বুঝিয়ে চলে Clash of Civilization এর সংকট এবং তাতে আমেরিকার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা। হালে সবখানে তারা দেখতে পায় মৌলবাদ ও ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের উত্থান, কেউ না চাইলেও তারা দেখতে পায় আমেরিকায় বসে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের অবাস্তব দাবী এবং তার মারাত্মক কুফল! শুরু হয় তাদের সিগনেচার ট্যাক্টিক্স – fear and hate mongering. মৌলিক চাহিদা পূরণ হবার পর উদ্বৃত্ত অর্থনীতিতে বলীয়ান জনগণ মনে করে, তাই তো! দেখাতে চাওয়া জুজু তারা আবার দেখতে শুরু করে। অতীত-অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে তারা চেতনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!
ডিটেইলস ও পরিসরে পার্থক্য ছাড়া আমেরিকার জায়গায় বাংলাদেশ এবং রিপাবলিকান পার্টির জায়গায় আওয়ামী লীগকে প্রতিস্থাপন করুন – ঘটনাপ্রবাহ খুব চেনা মনে হয় কি?
তবে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এ খেলায় তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলে আর কিছু না হোক, চার বছর পরপর অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্যান্য চেক-অ্যান্ড-ব্যালান্সের সুযোগ নিশ্চিত রাখার কথা বাদই দিলাম। অন্যদিকে কেবল নামে গনতান্ত্রিক হয়ে ওঠার দাবিদার বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টিও নেই!