by Jahid Islam
বাঙ্গালি জাতির নাটকপ্রিয়তা নিয়ে জ্ঞানীগুণী গবেষকরা হয়ত ইতিমধ্যেই বিস্তর লিখেছেন। নাটক ব্যাপারটি যে আমাদের মজ্জাগত-ছোটখাট কিছু উদাহরণ এর মধ্য দিয়ে এই পুরনো সত্যটিকে আবারও তুলে ধরার চেষ্টা থেকে এই লেখার প্রয়াস।
আমি যখন ছোট, আমাদের গ্রামের অনেক বাড়িতেই তখন টেলিভিশন ছিলনা। তবে আমাদের ঘরে একটা সাদা কালো টিভি ছিল। এতে রাতে সাপ্তাহিক বা প্যাকেজ নাটক দেখতে আসা উপচে পড়ার ভিড়ের কথা আমার এখনো মনে আছে। আমাদের যে রুমটাতে টিভি ছিল ঠিক সেই রুমের বিছানাটার মাঝখানের একটা তক্তা ভেঙ্গে গেছে একটা সময়। হয়ত ঘুণে ধরা কাঠ ছিল। তবু আমার বিশ্বাস এতে হাউসফুল দর্শকের একটা না একটা ভূমিকা না থেকে যায় না। “কোথাও কেউ নেই” নাটকে বাকের ভাইয়ের আসন্ন ফাঁসির কথা কল্পনা করে ভক্তকুলের মধ্যে যারা মহিলা দর্শক ছিলেন (আমি এবং আমার ভাই ছাড়া প্রায় সবাই এবং তারা বেশীর ভাগ ছিলেন আমার চাচি ও ফুপু সম্প্রদায়ের) কয়েক পর্ব ধরে তাদের সে কি মলিন চেহারা ! এমনকি এই নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে মিছিল এবং হুমায়ূন আহমদের বাসার সামনে ককটেল বিস্ফোরণের মত ঘটনা শুনেছি। ঘটনার সত্যতা যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে যদি সত্য নাও হয় তবু এই ধরনের জনশ্রুতি তৈরির ব্যাপারটি নাটকের প্রতি আমাদের ভালবাসাকেই নির্দেশ করে।
নাটকের এই প্রভাব গ্রামীণ সাদাসিধে মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চ শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষ,সবার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এমনকি এই দেশের আদালতে পর্যন্ত। যোদ্ধাপরাধীদের বিচারে আসামীর বিরদ্ধে অপরাধের প্রমাণ স্বরূপ যে সব ডকুমেন্ট সরবরাহ করা হয় তাতে স্থান পেয়েছে মুনতাসির মামুনের লেখা নাটক। হেরেসিম লেবেদেফ যিনি বাংলা নাটকের সূত্রপাত করেন বলে এক সময় মাধ্যমিক শ্রেণীর বইয়ে পড়েছিলাম আজ বেঁচে থাকলে তাকে হয়ত জিজ্ঞেস করা যেত, “ ভাইসাব আপনার উদ্ভাবিত জিনিসটির এই সাফল্য দেখে আপনার অনুভূতি কেমন” ? তিনি যে জিনিস চালু করেছিলেন তার প্রভাব যে একদিন একটা গোটা জাতির প্রাত্যহিক জীবনে পড়বে এবং এ দিক থেকে যে তিনি একদিন শেকসপিয়ারকেও ছাড়িয়ে যাবেন তিনি কি তা কখনো চিন্তাও করেছিলেন ?
দেশীয় রাজনীতিতে নাটকের প্রভাব আরও প্রকট। আর তাই নাট্যকাররা জনপ্রিয় পলিটিক্যাল কমেনট্রিও লিখে থাকেন দৈনিক পত্রিকায়। এমনকি টিভি টকশোতও রয়েছে তাদের প্রাধান্য। তাদের যুতসই বিশ্লেষণ পড়ে পাঠক চলে যান কল্পনার রাজ্যে। দর্শক বা পাঠকের উদ্ভাবনী শক্তিকে উসকে দেন এই নাট্যকাররা। ঘোরতর সঙ্কট হতে জাতিকে রক্ষা করার জন্য জাতীয় পতাকা দিয়ে রেকর্ড করার মত নাটকীয় বিষয়টি খুঁজে বের করেন সমঝদার পাঠকবৃন্দ। এখানেই শেষ নয়। এই নাটকের অভিনেতারা অনেকেই দেশের সেবায় নিয়োজিত সাংসদ। তাঁরা যে কোন সঙ্কটে দেশকে রক্ষা করবেন ঠিক সেভাবে যেমনটা সিনেমাতে প্রিয় গোথাম নগরীকে রক্ষা করেন ব্যাটম্যান।
পিছিয়ে নেই মঞ্চ নাটকও। সমানতালে এর প্রভাবও রয়েছে দেশের রাজনীতিতে। মঞ্চ নাটকে যেমন জোরে জোরে সংলাপ বলা হয়, আমাদের রাজনীতিবিদরাও বক্তৃতায় অনেকটা সে কাজই করেন। যিনি যত জোরে সংলাপ বলবেন তিনিই এই মঞ্চে তত ভাল বক্তা বা অভিনেতা। এমনকি নাটকের আদলে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজানোও ত আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যেরই অংশ।
নাটকের দৃশ্যে কাহিনীর প্রয়োজনে দৃশ্যপটে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া পুরনো চরিত্র। এমনটা আছে আমাদের রাজনীতিতেও। কয়েকদিন আগে দেখলাম শামীম ওসমান সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং জনতা এই মহান বীরকে তুমুল করতালি দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। ঠিক যেন রোমান বীর জুলিয়াস সিজারের মত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তার ভোট না গণনা করেই যে প্রতিপক্ষের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা সম্ভব এ সত্যটিও এই মহান নেতা খুব ভাল করেই জানেন। কিন্তু তবু তিনি জনপ্রিয় নেতার ভূমিকায় অভিনয় করবেন এবং বাজারে এই অভিনয়ের সমঝদার দর্শকও কাছে। আওয়ামি লীগ যদি সত্যিই অনেক দিন ক্ষমতায় থাকে তখন তিনি আসবেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যেমনটা আসতেন জয়নাল হাজারি । মানুষ তাকে নতজানু হয়ে সালাম দিবে। আর ভাব করবে এমন – “ আহা আপনাকেই ত জাতি চায়। এতো দিন কোথায় ছিলেন ? ”/ জাতির ক্রান্তি লগ্নে জাতিকে মূল্যবান পরামর্শ দেবার জন্য তিনি টকশোতেও হাজির হবেন। কিংবা “সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূল” শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে তিনি আসতেই পারেন অতিথি বক্তা হিসেবে।
শাহবাগ আন্দলনের অন্যতম নায়ক ইমরান এইচ সরকার পুলিশের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনিও এ জাতির আরেকজন দক্ষ নেতা (পড়ুনঃ অভিনেতা)/ ছোট বেলায় পড়েছিলাম দক্ষ নেতারা নাকি উপদেশের বদলে উদাহরণ দেন। তিনি যে সরকার দলের সমর্থক নন তা তিনি জাতিকে উদাহরণ দিয়ে (অভিনয় দিয়ে) বুঝিয়ে দিতে চাইলেন। আর তাই তিনি গুলশান নাটক মঞ্চস্থ করলেন। শুয়ে শুয়ে শ্লোগান দিয়ে (ডায়ালগ দিয়ে) যে নাটকে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করা যায় এখানেই বিশ্ব এই অভিনব কলার সাথে প্রথম পরিচিত হল।
থেমে নেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীও। তিনি থেমে থাকলে চলবে কেন, তিনিই যে এ সময়ে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ! বর্তমান নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল যে কেবল আদালতের রায় ও সংবিধান সমুন্নত করার জন্যই এবং এটি যে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভ থেকে নয় গোটা জাতির সামনে কান্নার অভিনয়ের মাধ্যমে তা তিনি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে মৃত মানুষের পরিবারকে বা আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তিনি যত দ্রুত কান্না করতে পারেন, তা দেখে বিজ্ঞজন মাত্রই স্বীকার করবেন যে সঠিক সময় এমেরিকায় জন্ম হলে তিনিই হতেন রোণাল্ড রিগ্যান কিংবা আর্নল্ড শোয়ারজনিগার এর মত অভিনয়ে পারদর্শীদের সবচেয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রতিযোগী।
বর্তমান পরস্থিতিতে বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিশ্চিতভাবেই জয় লাভ করবে। এই নির্বাচন করা না করা সমার্থক। কিন্ত না, যে কোন মূল্যে এই “নির্বাচন-নির্বাচন” নাটকটি মঞ্চায়িত করতে হবে। এটিত আসলে ১৯৯৬ সালে মঞ্চায়িত নাটকটিরই দ্বিতীয় পর্ব। একদলীয় হলে কি ! সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে কোন ছাড় নেই। তাই সেনা মোতায়েনও করা হবে । এটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে কিনা তা দেখতে সদা তৎপর রয়েছে “৭১ টিভি” / সকাল হতে বিকেল তারা এর লাইভ কাভারেজ দিবে।
হাসিনা এই নির্বাচন না করেই ক্ষমতায় থাকতে পারতেন, যেমনটা স্বৈর শাসকরা করে থাকেন। একজন স্বৈর শাসকের সাথে তার গুণগত পার্থক্য না থাকলেও এই অভিনয় তিনি করবেন। সহ অভিনেতা হিসেবে এই নাটকে তিনি বেছে নিয়েছেন রাজনৈতিক নাটকের অন্যতম থ্রিলার কিংবদন্তী এরশাদকে। পার্শ্ব অভিনেত্রি হিসেবে রওশন বরাবরের মত এবারেও ভাল।
আমরা যে সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপিদের হলফনামা দেখে শোকে মুহ্যমান হবার ভান করি, তারা যে এরকম এই ব্যাপারটা কি আমাদের অজানা ছিল, নাকি তাদের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের যে ধারনা এই ঘটনা তার সাথে একেবারেই বেমানান ? তাও আমরা অবাক হবার ভান করি।কেননা এতে নাটকীয়তা বজায় থাকে।
নাটক যে আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে সেটা আরও ভাল বুঝা যায় যখন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতিরা (সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে নরম মনের মানুষেরা এই পদ অলংকৃত করেন) ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত আসামিকে মাফ করে দেন। তারা আবার পুনর্জীবন লাভ করে। দণ্ড মাফ প্রাপ্ত কৃতী সন্তানরা দেশ জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। কেউ কেউ তাই এম পি মন্ত্রী হয়ে জাতির সেবায় মগ্ন হন। আবার যাবজ্জীবন দণ্ড পেলেও হয়ত অনেকের মুক্তি নেই। কেননা দর্শকদের চাহিদা মাথায় রেখে তৈরি হয় নাটক। প্রয়োজনে চাহিদা অনুসারে কাহিনীর পরিবর্তন ঘটে। দর্শকের কাঙ্খিত ভিলেনের ফাঁসি হয়। দর্শক এবং নির্মাতা সকলেই নির্মল আনন্দ লাভ করেন।
তবে কেউ যেন ভাবতে না পারে যে দেশে সুবিচারের ব্যত্যয় হয়েছে সেই দিকেও রয়েছে সরকার বাহাদুরের কড়া দৃষ্টি। আর তাই সরকার দলীয় এমপি মন্ত্রী পর্যন্ত ন্যয় বিচারের দণ্ড থেকে রেহাই পান না। টাকার ব্যাগ সহ ধরা পড়লেও কে যে নির্দোষ, বিদেশী লবির অপপ্রচারনার শিকার কোন দেশ প্রেমিক নেতা কিংবা নিপাট ভদ্রলোক সেজে থাকেলও কে যে আসলে সাংবাদিক পেটান তার সব রহস্যই ভেদ করে সরকার। অনেকটা ডিটেকটিভ নাটকের সুক্ষ্ণদর্শী ডিটেকটিভের মত।
পরিশেষে, বলা যায় নাটক আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিছেদ্য অংশ। দেশের রাজনীতির তুলনা হতে পারে কোন জনপ্রিয় থ্রিলার নাটকের সাথে যার প্রতিটি মুহূর্তে আছে নাটকীয়তা। সমঝদার দর্শকই হয়ত সময়মত ব্জানিয়ে দেবেন যে তাঁরা ভবিষ্যতে কাকে মঞ্চে দেখতে চান আর কাকে চান না।