খোমেনী ইহসান:
বাংলাদেশ সিকিম নয়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি দেশ। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ শুধু ঔপনিবেশিক পাকিস্তানকে পরাস্ত করেনি, ভারতকেও হারিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে বাংলাদেশতে নিয়ে অনেক কুবাসনাই করেছিল ভারত। এজন্য মুক্তি বাহিনীর বাইরে মুজিব বাহিনীর মতো একটি স্বশস্ত্র গ্রুপেরও জন্ম দিয়েছিল তারা। যেই বাহিনীকে ভারত সামরিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, যেন তারা ৭১ এর পরেও পাঁচটি বছর ভারতের হয়ে বাংলাদেশে সক্রিয় থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশের মু্ক্তিযুদ্ধের রিয়েল ফাইটারদের কারণে এটা সম্ভব হয়নি। মুজিব বাহিনীকে ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা, যারা বেশির ভাগই ভারতে আশ্রয় বা প্রশিক্ষণ নেননি এবং দেশটির মতাদর্শিক দীক্ষা নেননি, সফল হয়েছিল। তারাই সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী হানাদারদের একের পর এক পরাজয় ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
খোদ ভারতে যাওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের বেশির ভাগও ভারতীয় রাজনীতির গুটি হননি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে আমরা দেখতে পাই প্রবাসী সরকারের বেশির ভাগ সদস্য ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে যেন ভারত নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে দখলে নিতে না পারে এজন্য তাদের সচেতনতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের।
আমরা দেখেছি ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার স্বীকার করেও কিভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভারতীয় আধিপত্য এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। শেখ মুজিব তাই ২৫ মার্চ রাতে ভারতে পালিয়ে না গিয়ে গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানে নীত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়েল পর পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি প্রথমে লন্ডনে গেছেন। পরে ভারতে গেছেন। সেক্যুলার রাষ্ট্র পরিগঠনের পরেও তিনি মুসলিম দেশগুলোর সাথে দ্রুত সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এমনকি ১৯৭১ এর গণহত্যার অন্যতম খলনায়ক ভুট্টোকে বুকে টেনে নিয়েছেন। লালগালিচা সম্বর্ধনা দিয়েছেন।
আমরা ভুলে যাই যে শেখ মুজিব স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দরে দাড়িয়েই ভারতকে বলেছেন তার সৈন্য-সামন্ত ফিরিয়ে নিতে। অথচ ভারত চেয়েছিল অনেক বছরের জন্য সৈন্য মোতায়েন রাখতে। ভারত বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসনেও নিজস্ব লোক বসাতে চেয়েছিল। এমনকি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থাও চেয়েছিল। বুড়ো-বুড়িরা নিশ্চয় মনে করতে পারবেন যে স্বাধীনতার পর কিছু দিন ভারতীয় মুদ্রা চলেছিলও বটে।
ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত টানতে পারি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই ভারতের ব্যাপার অসতর্ক ছিলোনা। তারা ভারতের সহযোগিতা নিলেও বাংলাদেশের স্বাধীন সত্ত্বা কায়েমের প্রতি জোর দিয়েছেন। তবে স্বাধীনতাকে পুঁজি করে একটি দল, গোষ্ঠী ও শ্রেণীর ক্ষমতা লিপ্সা চরিতার্থ হওয়ার কারণে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরিগঠন হয়নি, যার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্ত্বা পুরোপুরি বিকশিত হতে পারেনি।
কিন্তু আমি অন্য একটি জায়গা ফোকাস করতে চাই। বিশ্ব বাস্তবতা ও নিজস্ব সক্ষমতার প্রশ্নে ভারত ১৯৭১ এ বাংলাদেশকে দখল করে নেয়নি এটি সত্য। কিন্তু ভারত যদি চাইতো তবে কি এটি অসম্ভব ছিলো? ভারত কি কিছু দিনের জন্য, কয়েক মাস বা বছরের জন্যও এটা পারতো না?
আমি মনে করি বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি জানে ভারত। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে সবচেয়ে ভালো জানে বলেই ১৯৭১ সালে এদেশকে বাগে পেয়েও দখলের সাহস করেনি। কুবাসনা তাদের মধ্যে থাকতেই পারে। কিন্তু সাহস দৃশ্যমান করেনি, এটাই বাস্তবতা।
কেন দখল করেনি ভারত? তারা জানে বাংলাদেশকে দখল করলে খবর আছে। মানে ১৯৪৭ এর সীমানা মুছে দিলে বাংলাদেশীরা সাবেক সুবে বাংলা এবং অরুনাচল ও সেভেন সিস্টার নিয়ে আবার স্বাধীন হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে দেবে বলে ভারতের একটা সন্দেহ আছে।
বৃটিশ উপনিবেশ ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের জনগণ কী আচরণ করেছে এটা তো ভারত দেখেছে। ভারত ভালো করেই জানে যে ভারতবর্ষের অন্য জায়গার লোকেরা যখন ইংরেজদের গোলামি করাকে নিয়তি মেনে নিয়েছিল তখনও সুবে বাংলার মানুষেরা লড়াই করেছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত বৃটিশের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র সংগ্রাম চলেছে। ভারতবর্ষের অন্য এলাকার মানুষেরা ইংরেজি শিখেছে, মদ খেয়েছে, ফর্সা মেয়েদের সাথে শুয়েছে। কিন্তু হাতে গোণা কিছু উচ্চ বর্নের হিন্দু-মুসলমান ছাড়া অন্যরা এসব করেনি।
অনেককেই দেখি বদরাজনীতি করতে গিয়ে ইতিহাস-নৃতত্ত্বও গুড়িয়ে দিতে চান। সুবে বাংলার বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ইতিহাসও বৃটিশের দালালির ইতিহাস নয়। ফকিরদের সময় থেকেই তারা লড়াই করেছে। এই যে পাকিস্তান হয়েছে তার পক্ষেও তারা লড়াই করেছে। দুই পাঞ্জাবের স্থানান্তর আর পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার স্থানান্তর সম্পর্কে খোঁজ নিলেই বুঝা যাবে এখানকার হিন্দুরা মাতৃভূমির সাথে কিভাবে সম্পর্কিত।
যাই হোক বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এখনো আতঙ্ক আছে। তাই তারা বাংলাদেশ দখল করতে চায় না। তারা ভালো করেই জানে বাংলাদেশ সিকিম, আসাম-ত্রিপুরা, কাশ্মীর বা আহমেদাবাদ নয়। এই সব দেশের স্বাধীন সত্ত্বা, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, স্বাধীনতা টেকানোর সক্ষমতা ও জনগণের রাজনৈতিক অবস্থান বাংলাদেশের মতো ছিলো না। এই সব দেশের ভারতের সাথে মিশে যাওয়ার কিছু বাস্তবতাও ছিল।
আর বাংলাদেশ মানে বাংলাদেশ। এটি এমন একটি দেশ যার স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস আছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশের বিজয় দিবস নেই।
আমি বলছি না যে ভারত বাংলাদেশকে সকাল বিকাল চুমো খেতে চায়। বলছি না যে, ভারত প্রতিনিয়ত সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করে না। আন্তর্জাতিক নদীতে ফারাক্কাসহ অন্যান্য বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করছে না। ফেন্সিডিল ও চোরাচালান দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষতি করছে না। বাংলাদেশের মেয়েদেরকে ভারতীয় ব্রোথেলগুলোতে পাচার করছে না। অন্তর্ঘাতমূলক নানা কর্মকাণ্ড করছে না।
আমি এই সব ঘটনাঘটন স্বীকার করেও বলছি যে ভারত অবশ্যই বাংলাদেশকে দখল করতে চেষ্টা করছে না। তাহলে ভারত কী করছে? তারা এমন কিছু করছে যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্বাভাবিক ও অস্বীকৃত নয়। ভারত অবশ্যই বাংলাদেশে আধিপত্য করছে।
বাংলাদেশে ভারত নিজেদের নিয়ন্ত্রণন কায়েম করতে চায়। এজন্য তারা এখানে বশংবাদ সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পদে নিজের নাগরিকদের, নিদেনেপক্ষে ভারতীয় দালালদের বসাতে চায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ও পুলিশিংয়ে ভারত আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। আরো অনেক কিছু চায় এবং তার জন্য ভারত কাজ করে।
ভারতের এই আচরণকে আমরা স্বাভাবিক ও স্বীকৃতি ব্যাপারই মনে করি। কারণ এটি দুনিয়ার সব শক্তিশালী দেশ তার দুর্বল প্রতিবেশীর সাথে করে থাকে। আমাদের কাছে বিষয়টি পষ্ট হবে যদি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিাকোর, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক রাষ্ট্রগুলোর সাথে রাশিয়ার, সিরিয়ার সাথে লেবাননের, সৌদির সাথে বাহরাইন ও ইয়েমেনের, কেনিয়া ও ইথিওপিয়ার সাথে পাশের দেশগুলানের সম্পর্ককে বিচার করে দেখি।
এখন কথা হচ্ছে রাজনীতি করতে চাইলে তো কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সব দুর্বল দেশেই হায় হায় করার রাজনীতি আছে। সিকিম টাইপের সিনড্রোম আছে। কিন্তু প্রতিবেশী শক্তির আধিপত্য যদি খর্ব করতে হয় তবে হায় হায় করার কিছু নাই। সিকিমের জিগির তোলারও প্রয়োজন নাই। কিভাবে, কোথায়, কেন আধিপত্য তৈরি হচ্ছে কিভাবে হচ্ছে তাকে বুঝে ঠিক কাজটি করাই দরকারি।
ঠিক কাজ হলো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠা। সক্ষমতা অর্জন করা। সমৃদ্ধি অর্জন করা। কেন আমার দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশের দালালি করছে, তার কারণ খুঁজে সমাধান দেওয়া। কেন ৫৮ সিট পাওয়া বিরোধী দলটি বাধ্য হয়ে ভারতের বশংবদ হয়ে গেছে তার জন্য কার কতখানি দায়-দায়িত্ব আছে তার প্রতিকার করা।
ঠিক কাজটি না করে শুধু শুধ কথা খরচ করলে কী লাভ হবে যে ভারত বাংলাদেশের সব কিছুর মালিকহয়ে গেছে? কী লাভ এ কথা বলায় যে সেনাবাহিনীতের র’র পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলছে? কী লাভ এ কথা বলায় যে গণভবন পাহাড়া দিচ্ছে ভারতীয় অফিসাররা? কী লাভ এ কথা বলায় যে বাংলাদেশে কে ক্ষমতায় বসবে, না আসবে তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দিল্লীর সাউথ ব্লক?
আমি মনে করি প্রতিবেশী দেশ সব নিয়ে গেল, নিয়ে গেল বলে চিৎকার করাটা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। বাংলাদেশে এই রাজনীতির কোনো সফলতা নাই। বরং এই রাজনীতি আত্মঘাতী।
১৯৭১ এও ভারতকে নিয়ে বাড়বাড়ন্ত ভীতি ছড়ানো হয়েছিল। যেই ভীতির চোটে জামায়াত-মুসলিম লীগ আত্মহত্যা করেছে। ভারতের ব্যাপারে তাদের সতর্কতা ঠিক থাকলেও একে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা, হানাদারকে সমর্থক হওয়াটা ভালো কোনো ব্যাপার নয়।
যাই হোক বাংলাদেশের পরিণতি সিকিমের মতো হচ্ছে মনে করে খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার দরকার নাই। আতঙ্কের রাজনীতির বদলে তার উচিত সাহসের রাজনীতি করা। দেশ দখল হয়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করার বদলে তার উচিত জিয়ার মতো ভাবা কিভাবে দেশকে গড়ে তোলা যায়, কিভাবে প্রতিযোগীকেও টেনশনে রাখা যায়।
বেগম খালেদা জিয়া, আপনি জিয়ার রাজনীতি করেননি। এবং করছেন না। দেশ ভারত দখল করবে মনে করে অপশক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শের ফাঁদে পড়া আর দেশকে স্বাধীন করতে জিয়ার মতো এগিয়ে যাওয়া এক ব্যাপার নয়।
আপনার কাছে অনেক যোগ্য লোক, সাহসী ও সৃজনশীল এক সমর্থক বাহিনী আছে। তাদের নিয়ে আপনি রাজনীতি পুনর্গঠন করুন। প্রতিষ্ঠান গড়ুন। যারা সৃজনশীল তাদের কাজের সুযোগ দিন। যারা এখন আপনাকে ভুল রাজনীতি করিয়ে অসহায় করে তুলছে তাদের তাড়িয়ে দিন। তারা আপনাকে ব্যবহার করছে, নিরাপদে থেকে ব্যবহার করছে, কিন্তু আপনার বিপদের সময়ে পাশে দাড়াচ্ছে না।