by শাফকাত রাব্বী অনীকঃ
“আনলাকি থারটিন” কথাটি একটা কুসংস্কার। কিন্তু কোন একটা বিচিত্র কারণে এই ১৩ সংখ্যাটি অনেক ক্ষেত্রে আসলেই আনলাকি হয়ে যায়। বাংলাদেশের জন্যে ২০১৩ ছিল ঠিক তেমন একটা সংখ্যা। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৩ এর চাইতে বেশি মানুষ এর আগে কোনদিন পুলিশের গুলি খেয়ে মারা যায়নি। ২০১৩ সালে যতো রাউন্ড গুলি বিভিন্ন বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের উপরে ছুঁড়েছে এতো রাউন্ড গুলি যুদ্ধ ব্যাতিত এর আগে কোনদিন ছোড়া হয়নি।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক প্রতিবাদের বিচিত্র প্রয়োগে গাছ কাটার রেকর্ড হয়েছে, গাড়ি পুরানোর রেকর্ড হয়েছে, বাসে আগুন দেয়ার রেকর্ড হয়েছে (যে পক্ষই দিক), পুলিশের উপর সরাসরি আক্রমনের ও পুলিশ খুনের রেকর্ড হয়েছে। মানুষ গুমের রেকর্ড হয়েছে, কোন ব্যাক্তিকে ধরতে না পেরে মা-বাবা-শশুর-শাশুরি-ছেলে-মেয়ে ধরার রেকর্ড হয়েছে। রানা প্লাজায় একটি বিল্ডিং ভেঙ্গে, কোন একক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা যাবার রেকর্ড হয়েছে। ৫ই মের হেফাজতের রাত্রে কোন একক অভিযানে পুলিশের গুলির রেকর্ড হয়েছে, সিভিলিয়ান অপারেশনে গ্রেনেড ফাটানোর রেকর্ড হয়েছে। হেফাজতের এক রাত্রে সর্বাধিক সংখ্যক মিডিয়া বন্ধ করে দেয়ার রেকর্ড হয়েছে, অভিযান চালানোর অভিপ্রায়ে শহরের বাতি নেভানোর রেকর্ড হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির মাত্র দু’দিনে ১৫৬ জন মানুষকে গুলি করে মারা হয়েছে, দেলোয়ার হোসেন সাইয়িদির রায় পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোন একক ঘটনায় এতো অল্প সময়ে এতো মানুষকে গুলি করে মারা হয়নি। ২০১৩ এর শেষের দিকে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের বাসা-বাড়ী বুল্ডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া শুরু হয়েছে। আমাদের ৪২ বছরের ইতিহাসে এই ঘটনার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
২০১৩ সালে যতোজন মানুষের গুলি খেয়ে কিংবা লাঠির বাড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার লাইভ ভিডিও পাওয়া গেছে, তার কোন তুলনা এর আগে কোন ইতিহাসে নেই। যতোগুলো ক্যামেরা ডেথ হয়েছে, যতো মানুষকে ক্যামেরার সামনে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করার ভিডিও কিংবা ছবি পাওয়া গেছে, আমাদের ৪২ বছরের ইতিহাসে এতোগুলো ক্যামেরা-রেকর্ড নেই। দেশে মিডিয়া কিংবা ক্যামেরার সংখ্যা বৃদ্ধি এই রেকর্ডে কিছুটা ভুমিকা রাখলেও, রেকর্ড ব্রেকিং হানাহানির ঘটনাই এক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে।
অর্থাৎ সহজ বাংলায় বলতে গেলে, ন্যাক্কার জনক রাজনৈতিক নিপীড়নের ও হানাহানির রেকর্ডের পর রেকর্ড হয়েছে ২০১৩ সালে, যার লিস্ট উপরে প্রদত্ত রেকর্ডের থেকে আরও অনেক বড়।
উপরের রেকর্ডগুলো সারাটা বছর জুড়ে ধীরে ধীরে গড়েছে। স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করলে, দেশের মানুষকে অনেক বিচলিত করার কথা ছিল উপরের রেকর্ডগুলোর। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ উল্লিখিত খুনাখুনিকে মেনে নিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্য উল্লাস প্রকাশ করেছেন। ২০১৩ সালে বিভিন্ন ঘটনায় যতো মানুষ মৃত্যু-উল্লাস করেছেন, আমার দেখা গত ৩০ বছরে, মৃত্যু-উল্লাসের এতো অধিক সংখ্যক পারটিসিপেশনের কোন রেকর্ড আমার জানা নাই।
একটি বড় জনগোষ্ঠীর উপরে সরকারী বাহিনীর আগ্রাসন, আর পুরো ঘটনায় সরকার সমর্থকদের নিদারুণ বিনোদন ২০১৩ সালকে ইতিহাসের পাতায় নিয়ে যাবে পুরো জাতিকে পরিপূর্ণভাবে বিভাজিত করে রাখার বছর হিসেবে। সেই ১৯৫১ সাল থেকে বাংলাদেশী-বাঙ্গালি জাতিকে একটি বিশেষ বিভাজনে বিভাজিত করার প্রবল প্রচেষ্ঠা চলে আসছিল। সেটা হচ্ছে ইসলাম বনাম ইসলাম বিদ্বেষের বিভাজন। সকল প্রচেষ্ঠাকে ভেস্তে দিয়ে, বাংলাদেশী বাঙ্গালিদের এই বিভাজনে বিভাজিত করা যায়নি গত ৫০টি বছর। ব্রিটিশরা পারেনি, পাকিস্তানিরা পারেনি। কিন্তু ২০১৩-এ এসে, মাত্র হাতে গোনা কিছু ছেলেমেয়ে এই অসাধ্যকে সাধন করেছে। বাংলদেশিদের আস্তিক-নাস্তিকের বিভাজন কমপ্লিট হয়েছে, চেতনা বনাম ধর্মের লড়াইয়ের আড়ালে।
তবে এতো হতাশার মাঝেও ২০১৩ নিয়ে এসেছে অনেক আশার আলো, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ও স্বাধীনতাকে করবে সুসংহত অদুর ভবিষ্যতে। এই পজিটীভ বিষয়গুলোকে নিচে তুলে ধরছিঃ
– ২০১৩ সালে এসে গত ৪২ বছরের অনেক মিথ ভেঙ্গে গেছে। চেতনা চর্চার আড়ালে গত ৪২ বছরে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল ঘৃণার ব্যাবসা, প্রতিহিংসার ব্যাবসা, ধর্মীয় অনুভুতিকে ভোতা করবার ব্যাবসা, আর একটি বিশেষ দেশের নির্লজ্জ স্বার্থ রক্ষার ব্যাবসা। এই কথাগুলো এতোদিন ডানপন্থীদের কন্সপিরেসি থিউরি হিসেবে উড়িয়ে দিতেন অনেকেই। ২০১৩ এর নানান ঘটনাবলী দেশের বিশাল বড় একটি অংশের মনে এই উপলব্ধিটুক জাগ্রত করেছে, প্রমাণিত করেছে।
– দেশের মেইন স্ট্রিম থিঙ্কিং-এ অনেকগুলো টাবু বা নিষিদ্ধ বিষয় ছিল, যা নিয়ে শংশয় পোষণ করার, কিংবা নির্দোষ তাত্ত্বিক বিতর্কে জড়ানোরও কোন উপায় আগে ছিল না। ২০১৩ এ এসে এধরনের অনেক মেইন স্ট্রিম ডগমাই প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেক ডগমাই ভেঙ্গে চুরে চুরমার হয়ে গেছে।
– জাতির থিঙ্কিং জগতে চেইঞ্জ ওব গার্ড বা প্রহরীর পরিবর্তন হয়েছে। গত ৩০-৪০ বছর ধরে রাজত্ব করা থিঙ্কারদের আড়াল করে দিয়ে, নতুন নতুন অনেক লেখক ও কমেন্টেটর এসেছেন, যাদের অনেকের পাঠকের সংখ্যা অতীতের অনেক রথি মহারথির পাঠকের সংখ্যার চাইতে বেশি। রাজনৈতিক মতাদর্শের উভয় পার্শ্বেই নতুনদের এই ভিড় চোখে পড়ার মতো। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশে চিন্তা-চেতনা বিকাশের সত্যিকারের গণতান্ত্রিকায়ন হয়েছে ২০১৩-তে এসে। এই গণতন্ত্রায়নে, মেসেঞ্জারের চাইতে মেসেজের গুরুত্ব অনেক বেশি হয়ে গেছে। আগে মেসেঞ্জারের গুরুত্বই বেশি ছিল, উনারা যা বলতেন মানুষ তাই শুনতো। যার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ মানুষের কাছে আড়াল করা যেতো। ২০১৩ পরবর্তী গণতান্ত্রিক মেধা ভিত্তিক মার্কেটে এখন আর কোন ভ্রান্ত মিথলজিকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। একারণে ইতিহাসের খাতায় ২০১৩ হয়ে যাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ জংশন।
– শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে কোন কথা না বললে ২০১৩ এর রিভিউ সম্পূর্ণ হবে না। ২০১৩ এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ছিল শাহবাগ আন্দোলন। সারা বছর জুড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, জেল, জুলুম, ও পালিয়ে থাকার চিয়ার লিডার ছিল এই শাহবাগ। জাতীয় জীবনকে বিভাজিত করার এবং মানুষে মানুষে ঘৃণার যে লালন-পালন শাহাবাগ আন্দোলন করেছে, তার ফল আরও অনেকদিন ধরে পেতে হবে বাংলাদেশকে।
তবে শাহবাগ যদি হয় একটি বিপ্লব, তাহলে এর প্রতিক্রিয়ায় যে প্রতি-বিপ্লব হয়েছিল, আমার মতে তা ছিল মূল বিপ্লবের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকরী। এ বিষয়ে উল্লখ্য, প্রথম আলোতে প্রকাশিত একমাত্র বৈজ্ঞানিক জরিপ অনুযায়ী দেশের ২২ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল শাহবাগ আন্দোলনে। মজার কথা হলো, শাহাবাগিরা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, তাদের ২২ শতাংশের সমর্থনের তিন গুন বেশি মানুষকে তারা একত্রিত করে ফেলেছেন তাদের প্রতি-বিপ্লবে। দেশের মানুষের মাঝে ৩০-৭০ কিংবা ৪০-৬০ এর একটি ঐতিহাসিক বিভাজন আগে থেকেই ছিল। গত ৩০ বছরের ইলেকশন রেজাল্ট ঘাটা ঘাটী করলে এই বিভাজন স্পষ্ঠ হয়ে যাবে। এই বিভাজনের বৃহৎ অংশটির লোকেরা এর আগে কোনদিন একত্রীত হতে পারেনি, সব সময় বিভাজিত থেকেছেন। শাহাবাগ আন্দোলন তার ম্যাজিক দিয়ে সেই ৬০ কিংবা ৭০ শতাংশ মানুষের বিভাজন দূর করেছে। শাহবাগ এই ৬০ কিংবা ৭০ শতাংশ মানুষকে একটি “মাদার অব অল এলাইন্সের” দারপ্রান্তে এনে দাড়া করিয়েছে। এই অসাধ্য সাধিত হয়েছে ২০১৩ সালে, তাও আবার মাত্র নয় মাসে।
এই “মাদার অব অল এলাইন্স” — যা ২০১৩ সালে সৃষ্টি হয়েছে, তার সুদীর্ঘ সুফল পাবে বাংলাদেশ। আর এই গ্র্যান্ড এলাইন্স-ই হলো শাহাবাগের বুমেরাং, যার কারনে ভেস্তে যাবে একাধিক দেশের কূটনীতি ও তাদের দেশীয় ক্রিড়ানকদের গেইম প্ল্যান।
সরি জাফর স্যার, ২০১৩ সালে আপনাদের স্বল্প সময়ের জন্যে চৌরাস্তা ছেড়ে দিয়েছিল মানুষ। কিন্তু তাদের সত্যিকারের স্বাধীনতার স্পৃহা, স্বাধীন ও মুক্ত বাংলাদেশের বাসনা আপনাদের হাতে দিয়ে দেয়নি। আর একারণেই বলতে হচ্ছে, ২০১৩ সালে আপনাদের বিজয় নয়, পতনের শুরু হয়েছিল। প্লিজ, “মাদার অব অল এলাইন্স” এই শব্দটি মনে রাখবেন।
Yes