মুহাম্মদ আব্দুল খালিক
সামাজিক বৈষম্য নিরসন, জনগণের ক্ষমতায়ন, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পালাবদলের আধুনিক সংস্করণ। বিভিন্ন মনীষী একে সংজ্ঞায়িত করেছেন ভিন্ন ভিন্নভাবে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো একে আখ্যায়িত করেছেন মুর্খের শাসন হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন একে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার’ হিসেবে। এছাড়াও গণতন্ত্রের পক্ষে বিপক্ষে নানা রকম বক্তব্য পেশ করেছেন মনীষীরা।
২.
এখন আমাদের সামনে যে মৌলিক প্রশ্নটি এসে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো, গণতন্ত্র নিজে কতটা গণতান্ত্রিক? এটা কি অধিকাংশ মানুষের মতের বহিঃপ্রকাশ? এর মধ্য দিয়ে কি জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটে? কিংবা এটা জনগণের জীবন-মান উন্নয়ন, সাম্য ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা ভূমিকা রাখে?
বাস্তব চিত্র হলো গণতন্ত্র স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। কখনো পায় পরিবার তন্ত্রের আদল, কখনো কতিপয়তন্ত্রের, আবার কখনো বা একনায়কতন্ত্রের। কতিপয় কর্পোরেট শক্তির স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় গোটা ব্যবস্থাটি। এরা বিশেষত প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করে জনমত গঠন করে থাকে। এছাড়া এরা লালন করে ক্যাডার বাহিনী, যারা শক্তির জোরে স্বার্থোদ্ধারের পাশাপাশি সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখে।
৩.
আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে নির্বাচনে জনগণের মতামতের বাস্তব প্রতিফলন কতটা ঘটে তা বোঝার চেষ্টা করবো। ধরি, কোনো এক দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ১০টি (এছাড়াও সতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে)/ যদি নির্বাচনে কাস্টিং ভোটের সংখ্যা ৭০% হয়, তাহলে ভোট প্রদানকারী মোট ভোটারের সংখ্যা হবে ৭০ লাখ। এখন, প্রধান ৪টি দলের প্রাপ্ত ভোটের পার্সেন্টেজ যথাক্রমে ৪০%, ৩০%, ১২% ও ১০%/ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সতন্ত্রপ্রার্থী মিলে প্রাপ্ত ভোটের পার্সেন্টেজ ৮%। সুতরাং ১ম দল পেল ৪০% = ২৮ লক্ষ ভোট, ২য় দল পেল ৩০% = ২১ লক্ষ ভোট, ৩য় দল পেল ১২% = ৮ লক্ষ ৪০ হাজার, ১০% = ৭ লাখ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সতন্ত্রপ্রার্থীরা পেল ৮% = ৫ লক্ষ ৬০ হাজার।
লক্ষণীয় যে, ১ম দল ২৮ লক্ষ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে। আর আমরা জানি যে, মোট ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি। যার মধ্যে ১ম দল পায় ২৮ লক্ষ, আর তাদের না পাওয়া ভোটের পরিমাণ ৭২ লক্ষ। মাত্র ৪ ভাগের ১ ভাগ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে তারা সকল প্রকার ক্ষমতা ভোগ করে থাকে এবং তাদের বৈধ-অবৈধ সকল কাজের জবাব দেয় এ কথা বলে যে, তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করছে জনগণের স্বার্থে। মাত্র ১ ভাগ লোকের ম্যান্ডেট পাওয়া সরকারকে কি আমরা জনগণের সরকার বলতে পারি? কিংবা গণতন্ত্রের পরিভাষায় তাদেরকে বলতে পারি বৈধ সরকার? আইন প্রণয়নসহ সার্বিক ব্যাপারে তাদের হাতে কি ন্যস্ত করা যায় রাষ্ট্রের সব রকম ক্ষমতা?
৪.
গণতন্ত্র বলতে যদি অধিকাংশ লোকের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে আমাদের দেশে নির্বাচিত এমপিদের ক্ষেত্রে সে মতামত কতটা প্রযোজ্য হয়ে থাকে। যেখানে আমাদের দেশের ২৪ শতাংশেরও বেশি লোক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, যেখানে আরও কমপক্ষে ২৬ শতাংশ লোক নিম্ন মধ্যবিত্তের অন্তর্ভুক্ত; সেখানে আমাদের দেশে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৬৯ জন ব্যবসার সাথে এবং আরো ৪৪ জন আইন পেশার সাথে জড়িত (রিপোর্ট, প্রথম আলো)/ বলার অপেক্ষা থাকে না যে, এদের সবাই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির অধিকারী। যদি সত্যিকার গণতন্ত্রই হত তাহলে এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে কিন্তু আমরা দেখতে পাই এখানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় উচ্চবিত্ত থেকে। তাই গণতন্ত্র না বলে একে কি আমরা ধনিকতন্ত্র বলতে পারি না?
৫.
নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার আমাদের দেশের সর্বজনবিদিত একটি বিষয়। এখানে যার যত কালো টাকা রয়েছে সেই তত নির্বাচনী দৌরাত্ম দেখিয়ে ভোটযুদ্ধে জয় লাভ করতে পারে। সামান্য একশ’ দু’শ টাকা দিয়ে এখানে ভোট কেনা যায়। সুতরাং যার টাকা রয়েছে সে-ই না নির্বাচিত হবে? তবে শুধু টাকা থাকলেই হবে না, প্রধান কোনো দলের মনোনয়নও পেতে হবে। আর সেজন্য আপনাকে ইনভেস্ট করতে হবে লাখ লাখ (ক্ষেত্র বিশেষে কোটি কোটি) টাকা। কারণ নেত্রীর সুনজর পাওয়া তো আর সহজ কথা নয়!
৬.
কোনো দলই এখানে কারো ওপর আস্থাশীল নয়। কারণ, সবাই এখানে ক্ষমতার মোহে হয়ে পড়েছে হিংস্র পশুর ন্যায়। ক্ষমতাকে কিভাবে পাকাপোক্ত করা যায়- এই হলো তাদের নিত্য দিনকার ভাবনা। যদিও তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এ কথা জানে যে, তাদের বিবিধ কুকর্মের কারণে পরবর্তী টার্মে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে না তারপরও কিভাবে, কোন পেছনের দরজা ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসা যাবে তা নিয়েই থাকে ব্যতিব্যস্ত। কারণ, গণতান্ত্রিক (?) এই সিস্টেমে ক্ষমতায় থাকলেই কেবল লাভ। ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল কালো টাকার অধিকারী হওয়া যায়, খোলা যায় সুইস ব্যাংকের লোভনীয় এ্যাকাউন্ট। ক্ষমতায় থাকলে চাঁদাবাজি করা যায়, করা যায় খুন-হত্যা-গুম; যার জন্য দিতে হবে না কারো কাছে জবাবদিহি। ক্ষমতায় থাকলে করা যায় ধর্ষণ, ব্যভিচার; কারণ এছাড়া কি আর এলিট ক্লাবে ঢোকা যাবে?
৭.
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য অনেকগুলো শর্ত পূরণ করা জরুরী। যেমন, শিক্ষার আলো প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, জনগণকে মানবিক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা ও সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি যে, দেশে শিক্ষার হার এখনো অনেক কম এবং সরকারীভাবে মানবিক শিক্ষা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু তাই নয়, জনগণ যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারে সেজন্যই যেন সব আয়োজন। কারণ, জনগণকে অজ্ঞতার মধ্যে রাখতে পারলেই রাজনীতিবিদদের স্বার্থদ্ধোর হতে পারে! তাছাড়া যেখানে দলীয় কর্মকাণ্ডেই গণতন্ত্রের কোনো ছোঁয়া নেই, সেখানে তারা কীভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে?
৮.
গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা নিছক প্রহসনের নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি যদি বিদেশি আধিপত্যবাদীদের চাহিদা পূরণ করতে পারেন, যদি পারেন তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে। আপনি যদি বৈধ-অবৈধ উপায়ে কালো টাকার অধিকারী হতে পারেন, কিংবা পারেন দেশের প্রখ্যাত কোনো নেতার সন্তান হতে তাহলেই আপনি পারবেন জনপ্রতিনিধি হতে। আপনার মেধা বা সৃজশীলতা কখনোই এখানে নেতৃত্বের মাপকাঠি নয়।
কেউ কেউ বলে থাকেন পাশ্চাত্যেই একমাত্র গণতন্ত্র আছে। গণতন্ত্রের জন্য পাশ্চাত্যই হচ্ছে উত্তম মডেল। কিন্তু আপনি তো আর পাশ্চাত্য হতে পারবেন না। কারণ, আপনার নেই বিপুল ও অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের অধিকারী সামরিক বাহিনী। আপনি পারবেন না গরিব কোনো দেশকে শোষণ করে তাদের সকল সম্পদ আপনার দেশে নিয়ে আসতে। আপনি পারবেন না তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে। আর সেজন্যই আপনি পারবেন না আদর্শ গণতন্ত্রের মডেল হতে। কারণ শোষণ আপনাকে করতেই হবে। হয়তো নিজ দেশের লোককে, নয়তো ভিনদেশীদেরকে। এটাই গণতন্ত্রের অন্তরালের কথা!
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম অধ্যয়নরত।