সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে হামলা এবং একটা ঝুঁকিপূর্ণ আলোচনা।

1

কিস্তী- এক।।

মাহবুব মিঠু।।

বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর! বার্তাটা ঠিক মতো দিতে না পারলে সমস্যা। আবার না বললেও সত্যটা আড়ালে থেকে যাবে। বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে লেখাটা বড় হয়ে যাওয়াতে কয়েকটি কিস্তিতে দেব।

নির্বাচনের পরপর দেশের কিছু কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে। সেই সাথে সরকারী পক্ষ যেমন বিরোদলীয় জোটের নেতাকর্মীর বাড়ীতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করেছে। ঠিক তার বিপরীতটাও ঘটেছে। অর্থাৎ সরকারীদলের নেতাকর্মীরাও কমবেশী বিরোধীজোটের হামলার শিকার হয়েছে। মোটাদাগে এই হচ্ছে বাঙলাদেশে বর্তমান হানাহানির চরিত্র।

এবার একটা প্রশ্ন করা যাক।

এই হামলার মূল উৎস বা কারণ কি? তার আগে কিছু টুকরো টুকরো বাস্তব ঘটনা ছদ্ননাম ব্যবহার করে বিশ্লেষন করে দেখা যাক।

উদাহরণ- এক, আওয়ামিলীগের জব্বার বিএনপির মোবারকের বাড়ীতে হামলা করেছে, এটা কি সাম্প্রদায়িক নাকি রাজনৈতিক?

উদাহরণ- দুই,  বিএনপির সফুর মিয়া আওয়ামিলীগের গফুর মিয়াকে মেরেছে, এটা কি সাম্প্রদায়িক নাকি রাজনৈতিক?

যারা বাঙলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পকে ধারণা রাখেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বুঝেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, উপরের এক এবং দুই উদাহরণের ঘটনা অর্থাৎ হামলা বা পাল্টা হামলা রাজনৈতিক ডামাডোলের সময়ে অনাকাংখিত হলেও আমাদের দেশে খুবই স্বাভাবিক যেটা সাম্প্রদায়িক নয়। প্রথমতঃ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চরিত্র অনুযায়ী এটা তার মধ্যে পড়ে না। জব্বার কিম্বা মোবারক অথবা সফুর মিয়া কিম্বা গফুর মিয়া ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলেও একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক। অতএব, চরিত্র বিশ্লেষণে এটা রাজনৈতিক সংঘাত।

বিএনপি কিম্বা আওয়ামিলীগ কোন ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়। অতএব, এখানে যে যার ইচ্ছামতো যে কোন দলের প্রতি সমর্থন দিতে পারে। বিএনপিতে যেমন কম হলেও কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক আছে; ঠিক তেমনি কোন এক কারণে আওয়ামিলীগের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থনটা বরাবরই একটু বেশী। যদিও সত্যিকার সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রে আওয়ামিলীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠন কসাই লীগ এবং পাগল লীগ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই।

যে বিষয়ে কথা বলছিলাম। নির্বাচন পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংঘাতের টার্গেট উভয় প্রতিপক্ষের কর্মী সমর্থকরা হয়েছে এবং সংঘাত যেহেতু এখানো চলমান, কাজেই বলা যায় সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সেটা চলতেই থাকবে। যদি আক্রমণের কারণটা হয় রাজনৈতিক এবং সেই কারণে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা কর্মী যদি আক্রমণের শিকার হয়, তবে তাকে কি সংখ্যালঘু নির্যাতন বলা চলে? হ্যাঁ, যে কোন প্রকারের সংঘাতই কারো কাম্য নয়। সেটা রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন! গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল, সংঘাতের মূল কারণকে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ালে রেখে একে ভিন্ন রঙে রাঙানোর চেষ্টা হলে সংঘাত তো থামবেই না, বরং মূল সমস্যাটা আলোচনা থেকে হারিয়ে যাবে। আমরাও এক্ষেত্রে প্রায়শই সংখ্যালঘু নির্যাতনের পিছনের রাজনৈতিক কারণগুলোকে আমলে না নিয়ে আরেকটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মকে টেনে এনে বিষয়টাকে গুলিয়ে ফেলি। হ্যাঁ, পুরো ঘটনার সাথে ধর্মের সংযোগ আছে বৈকি, কিন্তু সেটা রাজনীতির গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র। এবারের হামলার অন্যতম নাটের গুরু আওয়ামিলীগের নেতা ওহাব কিন্তু কোন ধর্মীয় নেতা নন। অথচ তিনি ধর্মকে এখানে কৌশলে প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার করেছেন।

এবার একটা ভিন্ন উদাহরণ দেই, যেটা সত্যিকার অর্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে। সরকারীদলের সংখ্যালঘু প্রার্থীকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা ভোট দেয়াতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর দ্বারা সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার। এটার চরিত্র এবং প্রকৃতি কেমন? আওয়ামিলীগের ঐ প্রার্থী কিন্তু শুধু বেছে বেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে হামলা করেছে। এমনকি ভোটের আগে তাদের শাসিয়ে গেছে, সম্প্রদায় দেখে ভোট দিলে খবর আছে। আওয়ামিলীগের ঐ সংখ্যালঘু (মাফ করবেন। ঘটনা বুঝাতে আমাকে সংখ্যালঘু শব্দটি বারবার ব্যবহার করতে হচ্ছে) প্রার্থীকে কি শুধু তার সম্প্রদায়ের লোকেরাই ভোট দিয়েছিল? যদি তাই না হয়ে থাকে তবে আওয়ামিলীগের বিদ্রোহী মুসলিম প্রার্থী কেন বেছে বেছে হিন্দুদের উপরে আক্রমণ চালাল? কারণ ওরা সংখ্যায় কম, তাই দুর্বল? এখানে প্রতিশোধের সহজ প্রতিপক্ষ হিসেবে যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বেছে নেয়া হয়, ঠিক তেমনি হয়তো ‘দুর্বলের অবাধ্যতার শাস্তি’ হিসেবেও হতে পারে সেটা। আরো নানা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণও থাকতে পারে। সুযোগে জমি দখল কিম্বা অন্যান্য।

এ কারণেই সংখ্যালঘুদের উপরে বর্তমানে চলা নির্যাতনের উৎস ভোটের রাজনীতি হলেও  এবং রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার সকল দলের, সকল ধর্মের লোকজন হলেও ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ বিষয়টা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবী রাখে। তাছাড়া অন্য রাজনৈতিক সহিংসতার বিস্তৃতি সীমিত। অর্থাৎ গোটা জনপদ জুড়ে সাধারণত চলে না। বেছে বেছে প্রতিপক্ষের উপরে হামলা হয়। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে কয়েকটি স্থানে বিরোধীজোটের আধিপত্য আছে এমন কিছু এলাকায় ব্যাপক ধ্বংশজজ্ঞ চালানো হয়েছে। সংখ্যালঘুদের বেলায় এর বিস্তৃতির স্বরূপ ভিন্ন। কোন দলকে সমর্থন দেয়া কারো ব্যাক্তিগত অধিকারের মধ্যে পড়ে। সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সমর্থন সাধারণতঃ আওয়ামিলীগের প্রতি।  তাই যখন রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয় তখন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গোটা জনপদ প্রতিপক্ষের টার্গেট হয়ে পড়ে। গোটা জনপদ টার্গেট হবার ফলে সেটা আলাদাভাবে মানুষের নজরে আসে। কিছু স্বার্থান্বেসী মহল বিভিন্ন স্বার্থ হাসিলের জন্য সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে হামলে পড়ে সংখ্যালঘুদের  উপরে।

সংখ্যালঘুর উপরে নির্যাতনের কিছু বাড়তি বেনিফিট আছে যেগুলো অনেক সময় সরকারের পক্ষে যায়। এরশাদের আমলেও এই ঘৃণ্য কৌশল নেয়া হয়েছিল। এরশাদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ঠিক সেই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিয়ে এরশাদ আন্দোলনের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। বর্তমান আওয়ামিলীগ সরকারও সেই কৌশল বেছে নিয়েছে। যখনই সরকার বিপাকে পড়ে তখনই এক একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। হারিয়ে যায় পুরাতন আলোচনা। এই মুহুর্তে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টা চাঙ্গা করতে পারলে দেশবাসী এবং বহির্বিশ্বের দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরিয়ে দিতে পারবে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাশ্ববর্তী দেশের নাক গলানোকে বৈধতা দেবার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোনভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাথে ইসলামি জঙ্গীবাদের সংশ্লিষ্টতা দেখাতে পারলে বন্ধুহীন বর্তমান সরকার বহিঃবিশ্বে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। এভাবেই তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়।

(পরবর্তী কিস্তিতে তথ্য প্রমাণসহ হামলার সঙ্গে জড়িতদের পরিচয় দেবার চেষ্টা করব।)

One thought on “সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে হামলা এবং একটা ঝুঁকিপূর্ণ আলোচনা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s