জনগণের নির্বাচন ও ‘সাংবিধানিক’ নির্বাচন

1

by মুহাম্মদ আব্দুল খালিক

 

১.

সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে মানুষ সমাজ থেকে রাষ্ট্রের পত্তন করেছে। প্রথমে ছোট ছোট নগর রাষ্ট্র, তারপর বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠেছে অধুনা রাষ্ট্রব্যবস্থা। সাম্য, সমানাধিকার, সমসুযোগ, স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিতকরণকে সামনে রেখে উদ্ভব ঘটেছে রাষ্ট্রব্যবস্থার। আর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ‘গণতন্ত্রকে’ বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও উত্তম ব্যবস্থা হিসেবে। এর মাধ্যমে নিজ নিজ রাষ্ট্রের জনগণ নির্ধারণ করে তাদের শাসক। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের জন্য জনগণ নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ‘ম্যান্ডেট’ দিয়ে থাকে। আর এসবই পরিচালনা করা হয় রাষ্ট্রের সংবিধানের আলোকে। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই ঐ রাষ্ট্রের সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। আমরা জানি যে, রাষ্ট্র গঠনের মূল উপাদান ৪টি- ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। এখানে লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রের মূল উপাদানের মধ্যে ‘সংবিধানের’ উল্লেখ নেই, তবে ‘সংবিধান’ অবশ্যই রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

পৃথিবীব্যাপী যা কিছু আছে সবই মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। রাষ্ট্রও গড়ে ওঠেছে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই। মানুষ রাষ্ট্রকে গড়েছে তাদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত ও শৃঙ্খলার সাথে পরিচালনা করতে, সম্মিলিতভাবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে। তাই সব ব্যবস্থাতে মানুষের কল্যাণই মুখ্য বিষয়। আর এ বিষয়টি পৃথিবীর সকল জাতিরাষ্ট্রের সংবিধানেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’-এই নীতিটি সন্নিবেশিত করার মাধ্যমে। তাই আপাত দৃষ্টিতে কোনো বিষয় সংবিধানসম্মত মনে হলেও যদি তা ‘জনগণের ক্ষমতাকে’ অবজ্ঞা করে তাহলে অবশ্যই তা পরিবর্তনীয়।

 

২.

গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসী শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ডেমোক্রেসিয়া থেকে, যার অর্থ ‘জনগণের শাসন’/ শব্দটির উৎপত্তি ডেমোস (জনগণ) ও ক্রাটোস (ক্ষমতা) থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে এথেন্স ও অন্যান্য নগর রাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার করা হয়। গণতন্ত্র হলো কোন জাতিরাষ্ট্রের (অথবা কোন সংগঠনের) এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান ভোট বা অধিকার আছে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে।

 

৩.

আন্তর্জাতিকভাবে যে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য মর্মে বিবেচিত হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণের আবশ্যকতা রয়েছে। যথা- (ক) নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হবে, (খ) নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হতে হবে এবং (গ) সর্বশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। দশম সংসদ নির্বাচনের সার্বিক কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, এ তিনটি শর্তের কোনোটিই পূরণ হওয়ার মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান নেই। তাই এ নির্বাচনটিকে কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য ও ‘জনগণের নির্বাচন’ বলে যায় না এবং এটি গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তাবলিও পূরণ করে না।

 

৪.

তবে সরকারদলীয় নেতা-নেত্রী ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের মাঝে এই নির্বাচনকে সংবিধানসম্মত বলে প্রতিষ্ঠিত করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বলতে চাচ্ছেন যে, সংবিধানের বিধান মেনে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই এটি সংবিধানসম্মত। এখানে কোনো দলের (এমনকি একমাত্র বিরোধী দল হলেও) অংশগ্রহণ করা না-করা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এতে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। তারা এমনকি এটাও বলে থাকেন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াটা জরুরি। তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারও একই কথা বলেছেন।

তাদের এ সব যুক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে খুবই বিস্মিত হতে হয়। লক্ষণীয় যে তারা খুবই খেলোভাবে এমন সব বিষয়ের মাধ্যমে দশম নির্বাচনকে ‘সংবিধানসম্মত’ বলার চেষ্টা করছেন যা সচেতন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কথা নয়। তারা বলছেন যে, সংবিধানে সরকার মেয়াদ শেষে নির্দিষ্ট সময়ের শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা আছে, তাই এর ব্যত্যয় ঘটাবার সুযোগ নেই; কিন্তু তারা এটা বলছেন না যে, সংবিধানের মূলনীতিতে জনগণের সমসুযোগ তৈরি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিতকরণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’।

 

৫.

যেখানে ১৫৪টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেল তাকে কি নির্বাচন বলা চলে? এছাড়া বাকী আসনগুলোতে ভোটারবিহীন নামমাত্র যে নির্বাচন হলো তা কি নির্বাচনের পর্যায়ভুক্ত? সেখানে কি যোগ্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল? ৫৩% ভোটার যেখানে তাদের ভোট প্রদানের সুযোগই পেল না তাকে কি গণতন্ত্র বলা যাবে? যেখানে কোনো আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক ছিল না সেটা কি সুষ্ঠু নির্বাচনের বৈধতা পাবে? বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল যে নির্বাচনে অংশ নিল না সে নির্বাচন কি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বলা যাবে?

বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থাকে এমনিতেই বলা হয় সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র; যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে সব রকমের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে (আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ)। দশম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কি তা ১৯৭৪ সালের বাকশাল বা স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে গেল? একদলীয় এই নির্বাচন দেশকে কোন বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায় তাই এখন দেখার পালা।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম অধ্যয়নরত।

One thought on “জনগণের নির্বাচন ও ‘সাংবিধানিক’ নির্বাচন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s