বর্তমানকালে কোন কোন দার্শনিক এ মত পোষণ করেন যে, Absolute truth বা প্রকৃত সত্য বলে কিছু নেই। এখন যা সত্য বলে অনুভূত হচ্ছে কালের বিবর্তনে তা আর সত্য নাও থাকতে পারে। এখন প্রশ্ন– মানুষ কি এতই সীমিত জ্ঞানের অধিকারী? সৃষ্টি লগ্ন থেকে মানুষ কি প্রতিনিয়ত অনিশ্চিতভাবে জীবন–যাপন করছে? প্রাকৃতিক বিধি–বিধান (Natural law) কি মানুষকে কোন নির্দেশনাই দেয় না? সভ্যতার বাহ্যিক চাকচিক্য, মানুষের উন্নতি ও সভ্যতার শীর্ষে আরোহণের সব লম্ফ–ঝম্ফ কি সবই মেকি? মানুষের দ্বারা জ্ঞানের এত শাখা–প্রশাখার বিকাশ কি মানুষকে নিশ্চিত কোন জ্ঞান দিতে সক্ষম নয়?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান সময়ে মানুষ তার মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করছে এবং এর বেশি ব্যবহার করতে গেলে মানুষের মানসিক অবসাদ বাড়বে, বেড়ে যাবে মানসিক রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ তার মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করার পরও কি কোন প্রকৃত সত্য খোঁজে পেল না? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজলে তাদের দেয়া Principle-এর দূর্বলতা পরিলক্ষিত হবে।
প্রকৃত সত্য অবশ্যই আছে। সৃষ্টি লগ্ন থেকে প্রাকৃতিক আইন (Natural law) একটাই আছে। আর তাই মানুষের পক্ষেও খোঁজে পাওয়া সম্ভব প্রকৃত সত্যের। তবে এজন্য প্রয়োজন– নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ, সত্যানুসন্ধানের সদিচ্ছা, প্রত্যয়, আর সর্বোপরি ভোগবাদী মানসিকতা পরিহার।
একজন মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির পরিপক্বতা আসার পর প্রথম এবং তার জীবনের সবচাইতে বড় যে দায়িত্ব তার কাঁধে চাপে তা হলো– সত্যের অনুসন্ধান। এ বিশ্বজগৎ কিভাবে সৃষ্টি হলো? কে এটা সৃষ্টি করেছে? নাকি আদৌ কেউ করেনি? মানুষের জীবন চলার পাথেয় কী হওয়া উচিত? কোন আদর্শ অনুসারে মানুষের জীবন পরিচালিত হবে? মানুষ কি নিছক প্রাণসর্বস্ব জীব? নাকি নৈতিক মানসম্পন্ন উন্নত জীব? মানুষের বাহিরের সত্ত্বার গুরুত্ব বেশি নাকি ভেতরের সত্ত্বার? পৃথিবীতে মানুষ কি “survival for the fittest” নীতিতে চলবে? নাকি পারস্পরিক সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের নীতি অনুসরণ করবে? মানুষ কি পশুদের মত অবাধে যৌনাচার করবে? নাকি নৈতিক সীমাবদ্ধতার নীতি মেনে চলবে? মানুষ কি শুধু নিজের স্বার্থ উদ্ধারেই ব্রত থেকে বৈধ–অবৈধ পথে টাকা–পয়সা ও সম্পদ উপার্জন করবে? নাকি সুষম বন্টনের নীতি অনুসরণ করবে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ও খোঁজে পাওয়া প্রত্যেক মানুষের জন্য আবশ্যক।
দু:খের বিষয় হলো– বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই এসব সম্পর্কে নিস্পৃহ। তারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বে হাতে গোনা কিছু মানুষের ইচ্ছা, চিন্তা ও মতবাদের কাছে তারা নিজেদের সত্ত্বাকে সপেঁ দিয়েছে। নেতাদের বক্তৃতা ও আলোচনা, অন্যের লেখনী এবং মিডিয়ার প্রচারণার মাধ্যমে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন চালনা করে থাকে।
বেশির ভাগ মানুষই প্রকৃত সদিচ্ছা নিয়ে জীবন চালনার মূলমন্ত্র খোঁজার জন্য সত্যানুসন্ধানী হওয়ার তাগিদ অনুভব করে না। নিজেদের ঘৃণ্য স্বার্থ চিন্তায় তারা এতই মত্ত থাকে যে, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। নিজেদের স্বার্থদ্ধোরে অন্যের অনিষ্ট সাধন করতেও পিছপা হয় না।
সত্যানুসন্ধানে এই অবহেলা ও নিস্পৃহতা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেনি। মানুষ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরাধীনতার বন্ধনে, দাসত্বের নিগড়ে। মানুষের অসচেতনতার সুযোগে রাষ্ট্রযন্ত্র আজ এমন এক ভয়ানক অক্টোপাসে পরিণত হয়েছে, যা গুটিকয়েক অসৎ ও স্বেচ্ছাচারী সম্পদশালী এবং ভ্রান্ত লোকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানকালে রাষ্ট্র এমন এক দানবীয় শক্তি যা মানুষের কন্ঠ রোধ করে থাকে নির্যাতনের স্টিম–রোলার চালিয়ে। কিন্তু সকল মানুষ যদি সত্য অন্বেষণে নিজেকে নিয়োজিত রাখত তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহৃত হতে পারত মানুষের প্রকৃত মঙ্গলের কাজে, কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) হিসেবে।
আমাদের জীবনকে সত্যিকারার্থে সুন্দর ও সফল করতে; আমাদের সমাজকে শান্তি, প্রগতি, আর ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনে আরো সুদৃঢ় করতে; মানবতার কাঙ্খিত বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে সত্যের সত্যিকার অনুসন্ধানই হোক সকলের ব্রতী।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম অধ্যয়নরত