মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
গত প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো গুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চে’র উত্থানের সময় থেকে এর শুরু। আর গত ৫ জানুয়ারীর সংসদ নির্বাচনের পটভূমিতে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছে তার বিভিন্ন রকমের বয়ানের মধ্য দিয়ে এই টক শো গুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে সম্প্রতি ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল সামাজিক মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তারের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।
সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ডিসকোর্স বা চিন্তাধারাগুলো এই টক শো গুলোতে নানা ভাবে উঠে এসেছে। সংবিধান এবং রাষ্ট্রীয়
আইন-কানুনের বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ভাষ্যে এই টক শো গুলো মুখর হয়ে উঠেছে। সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন চিন্তা-প্রণালী বা ডিসকোর্সের প্রতিফলন ঘটিয়ে নানান তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই টক শো গুলো।
টক অব দ্য টাউন এই টক শো গুলো এভাবে আমাদের জনমানসের চেতন ও অবচেতনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কাজেই আমরা এই টক শো গুলোকে নিছক বিনোদন হিসেবে দেখতে পারি না। এগুলো কীভাবে আমাদের সামষ্টিক মনঃস্তত্ত্বে এর নানাবিধ ছায়া-প্রচ্ছায়া ফেলছে তার একটি অনুসন্ধান আমাদের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
প্রথম পর্যায়ে আমরা এই টক শো গুলোতে উপস্থাপিত ডিসকোর্স বা চিন্তাধারা গুলোকে আমাদের বোঝার সুবিধার্থে বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় শ্রেণীবিন্যাস করতে পারি। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রত্যেকটি শাখা প্রশাখার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহ উন্মোচন করতে পারি। তৃতীয় পর্যায়ে শাখা প্রশাখা গুলোর পারস্পরিক মিল ও অমিল গুলো তুলনা করতে পারি। চতুর্থ পর্যায়ে শাখা প্রশাখা গুলোকে বিভিন্ন মানদন্ডে মূল্যায়ন ও বিচার করে কোনগুলো বেশি যৌক্তিক, সঙ্গতিপূর্ন এবং কল্যাণকর তা নির্ধারণ করতে পারি।
টক শো গুলোর এই চিন্তাধারা গুলোকে প্রথমে আমরা মোটা দাগে দু’টি শাখায় ভাগ করতে পারি। এটা আমরা করতে পারি কেবলমাত্র এগুলোকে বোঝার সুবিধার জন্য। মনে রাখতে হবে যে এই শ্রেণীবিভাগ যেন কোনোভাবে অতিসরলীকরণ হয়ে না যায়। কারণ অতিসরলীকরণ বিষয়ের বহুত্ব ও জটিলতাকে অনেক ক্ষেত্রে তরল করে পানসে করে ফেলে। তো সেই ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থেকে টক শো গুলোর চিন্তাধারা গুলোকে আমরা মোটা দাগে আওয়ামী-লীগ-সরকার-সমর্থক ও আওয়ামী-লীগ-সরকার-বিরোধী – এই দু’ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি।
আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থক ডিসকোর্স বা চিন্তাধারা – এই শাখা ডিসকোর্সটির দু’টি প্রশাখা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি।
-
প্রথম প্রশাখা ডিসকোর্সটি অনেকটা এরকম – বাংলাদেশকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র আলোকে বিনির্মাণ করতে হবে। এজন্য ১৯৭২ এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। ১৯৭১ সালে জামায়াত যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল; গণহত্যা, মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতা করেছিল; সেহেতু এদের বিচার এই মুহূর্তে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে এটাই প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার। তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এই পর্যায়ে গৌণ হয়ে গেছে।
হাসানুল হক ইনু, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, মোহাম্মদ আরাফাত থেকে শুরু করে আবেদ খান, শ্যামল দত্ত, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল প্রমুখ এই ডিসকোর্সের ধারক ও বাহক। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র এই বয়ানকারীরা বর্তমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ’ শক্তির দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখান। এমনকি পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধে পরিণত হতে পারে বলে প্রায়ই তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। আসলে একথা বলে তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে জামায়াতকে ‘নির্মূল’ করতে চান। জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ বিএনপির সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতায় এঁরা বিশ্বাসী নন। সংলাপের পূর্বশর্ত হিসেবে এঁরা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতায় এঁরা আসলে ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকতে চান। তাই এঁরা আসলে চরমপন্থী ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী’ বা ফ্যাসিবাদী।
-
আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থক ডিসকোর্সের দ্বিতীয় প্রশাখাটি হল এরকম – ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’য় বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। এ কারণে ১৯৭২ এর সংবিধানে ফেরত যেতে হবে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে কোনো আপোষ হবে না। জামায়াতের বিচার, শাস্তি ও নিষিদ্ধকরণে সোচ্চার ও আপোষহীন থাকতে হবে। তবে গণতন্ত্রের স্বার্থে সুষ্ঠ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে কোনোরকম পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপ ও সমঝোতা করা যেতে পারে। আর এখানেই এই নরমপন্থী বা মধ্যপন্থী ডিসকোর্সটি প্রথম চরমপন্থী ডিসকোর্স থেকে আলাদা। ড. আকবর আলী খান, সুলতানা কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ এই চিন্তা প্রশাখার প্রবল প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
যারা বাংলাদেশের ‘সুশীল সমাজে’র নেতৃস্থানীয় মুখপাত্র – যেমন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মাহফুজ আনাম প্রমুখেরাও মূলত এই দ্বিতীয় নরমপন্থী বা মধ্যপন্থী চিন্তা প্রশাখার অনুসারী। যদিও তাঁরা নিজেদেরকে একধরণের উন্নাসিক ‘নিরপেক্ষতা’র আবরণে আবৃত রাখতে পছন্দ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী ডিসকোর্স বা চিন্তাধারা – এই শাখা ডিসকোর্সটির তিনটি প্রশাখা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল।
-
আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী ডিসকোর্স বা চিন্তাধারার দ্বিতীয় প্রশাখাটি লক্ষ করা যায় ড. পিয়াস করিম, ড. আসিফ নজরুল, সাদেক খান, মাহফুজউল্লাহ প্রপ্রথম প্রশাখা ডিসকোর্সটি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র প্রচলিত বয়ানকে অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বলে বিবেচনা করে থাকে। যেমন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ – এই দু’টি জাতীয় মূলনীতি সম্পর্কে এই ডিসকোর্সের রয়েছে দার্শনিক ও আদর্শিক মতভেদ। এই জাতীয় মূলনীতি দুটিকে প্রতিস্থাপন করার জন্য এঁদের রয়েছে নিজস্ব উচ্চায়ত ও শ্রেয়তর চেতনা।
এঁরা বলে থাকেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মধ্যযুগের ধর্মান্তরের ইতিহাস, সেইসঙ্গে এদেশের ভৌগোলিক সীমানা ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে নগণ্য করে যে অসম্পূর্ণ ও একপাক্ষিক বাঙালি জাতীয়তার চেতনা উপস্থাপন করেছে তা সর্বজনগ্রাহ্য ‘জাতীয়’ চেতনা হতে পারেনি। এঁরা মনে করেন যে শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয় চেতনা বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে এঁরা মনে করেন যে দীর্ঘ ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইসলাম এই জনপদে এসেছে ও এখানে এর মূল প্রোথিত করেছে। সেই ইসলামের জাতি ও রাষ্ট্র গঠনমূলক চেতনা ধারণ করলে তা সর্বগ্রাহী হয়ে অসাম্প্রদায়িক ও পূর্ণাঙ্গ জাতীয় চেতনায় পরিণতি পেতে পারে।
এছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধারণা একটি ফিরিঙ্গি ধারণা বলে এঁরা মনে করেন। জাতীয় মনঃস্তত্ত্বে উপনিবেশ যুগের যেসব অবশেষ চেতন ও অবচেতনে রয়ে গেছে তার একটি হল এই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’।
মুসলিম ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা এই জনপদে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে ধর্মের নৈতিক ও আদর্শিক ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক হওয়ায় এখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ একটি বৈরী মতাদর্শ।
আধুনিক ইউরোপে চার্চ ও রাষ্ট্রকে আলাদা করতে হয়েছিল চার্চের নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবার জন্যে। এছাড়া খ্রিস্টান ধর্মে সিজারের জগত ও ক্ষমতাকে ঈশ্বরের জগত ও ক্ষমতা থেকে যিশু নিজেই আলাদা করে দিয়েছিলেন। ফলে খ্রিষ্টধর্ম প্রধান ইউরোপে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র জন্য একটি সহায়ক ও উপযোগী পরিবেশ বিরাজমান ছিল। অন্যদিকে মুসলিম ঐতিহ্যে ইসলামের ভূমিকা প্রথম থেকেই সর্বব্যাপী ও অখন্ডনীয়। এই কারণে ইসলামকে ইউরোপের আদলে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা হলে তা জাতীয় চেতনায় সর্বনাশা শূন্যতার সৃষ্টি করে। জাতি ও রাষ্ট্রের নৈতিক পতন ও স্খলন ডেকে আনে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নৈতিক উৎকর্ষের উৎস ও প্রেরণা হিসেবে ইসলাম ধর্মের সর্বোচ্চ অবস্থান ও ভূমিকা মুসলিম ঐতিহ্যে স্বর্ণালী অর্জনের মধ্য দিয়ে একটি অনন্য সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। বাংলাদেশের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় চেতনায় ইসলামের সেই একই গৌরবজনক ভূমিকা আবারো সম্ভব ও অতীব কাম্য। এছাড়া ইসলাম অন্তর্নিহিতভাবে অসাম্প্রদায়িক হওয়ায় অন্যান্য ধর্ম ও জাতিসত্ত্বার অনুসারীদের অধিকার এখানে সমমর্যাদায় স্বীকৃত।
এসব বিবেচনায় ১৯৭২ এর সংবিধান মূল্যায়নে এই চিন্তাধারা একে গণ-আকাঙ্খা পরিপন্থী বলে মনে করে থাকে। চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার এই চিন্তাধারা বা ডিসকোর্সের প্রধান প্রবক্তা হয়ে উঠেছেন। টেলিভিশন টক শো গুলোতে এই ডিসকোর্সটিই প্রধান প্রতিষ্ঠান বিরোধী ও বিপ্লবী ডিসকোর্স। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতা ও চেতনা কাঠামোকে আমূল রূপান্তরে বিশ্বাসী এই বিপ্লবী ডিসকোর্সটিকে টেলিভিশন টক শো প্রথম পর্যায়ে কিছুটা সহ্য করলেও বর্তমানে তা প্রায় সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ। কেননা এই চিন্তাধারায় জামায়াতের যুদ্ধবিরোধীতার সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ বিচার যেমন প্রত্যাশিত, তেমনি বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলামপন্থী রাজনীতি ও সংস্কৃতির একটি ইতিবাচক ভূমিকা ও গুরুত্ব-ও যথাযথভাবে স্বীকৃত।
বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি সমাবেশের পটভূমিতে এই ডিসকোর্স বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে অনেক বেশী কার্যকর ও ফলপ্রসু হতে পারে বলে উপস্থাপিত হয়। ড. শাহীদুজ্জামান-ও ইদানীং এই ডিসকোর্সের একজন শক্তিমান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। তিনিও ইসলামপন্থী দল ও মত নিয়ে কোনো শুচিবাই পোষন করেন না। বাস্তবতার নিরিখে ইসলামপন্থীদের অবস্থান ও ভূমিকাকে বিবেচনা ও মূল্যায়নে তিনি মুক্তমনা ও উদার।
-
আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী ডিসকোর্স বা চিন্তাধারার দ্বিতীয় প্রশাখাটি লক্ষ করা যায় ড. পিয়াস করিম, ড. আসিফ নজরুল, সাদেক খান, মাহফুজউল্লাহ প্রমুখের বিশ্লেষণ ও বয়ানে। ফরহাদ মজহারের চিন্তাধারার অনেক উপাদান এঁদের মধ্যে দেখা গেলেও, এঁরা উদার গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও ভূমিকায় অনেক বেশী আস্থাবান। নিয়মতান্ত্রিক, সাংবিধানিক আইনী কাঠামোর মধ্যেই এঁরা ভবিষ্যত বাংলাদেশকে প্রধানত দেখতে চান। তাই এঁদেরকে শেষ বিচারে সংস্কারপন্থী বা মধ্যপন্থী বলা যায়। বিপ্লবী বা আমূল পরিবর্তনপন্থী এঁরা নন। সেই বিচারে এঁরা হয়তোবা মূলধারার মুখপাত্র। তাই এঁরা বৃহত্তর সমাজে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য ও সহনীয়। এবং এই কারণে উপরোক্ত বিপ্লবী ডিসকোর্সের চাইতে এঁদের নরমপন্থী বা মধ্যপন্থী ডিসকোর্স টেলিভিশন টক শো গুলোতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী স্থান পায়।
-
এবার আলোচনা করবো এই ধারার তৃতীয় প্রশাখাটি নিয়ে। এই প্রশাখার ধারক ও বাহক নূরুল কবির টেলিভিশন টক শো-র একজন অনন্য তারকা হয়ে উঠেছেন। তাঁকে উপরে উল্লেখিত কোনো শাখা প্রশাখাতেই সম্পূর্ণভাবে বিরাজ করতে দেখা যায় না। তিনি এবং আনু মুহাম্মদ হয়তোবা এখনো ক্লাসিকাল কমিউনিস্ট। তবে এঁরা সিপিবি বা বাসদ মার্কা বামপন্থী, যেমন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বা খালেকুজ্জামান ভূইয়া-দের চেয়ে অনেকাংশে ভিন্ন প্রকৃতির। সেলিম বা ভূইয়া-রা শেষ পর্যন্ত জামায়াত বিরোধীতার জোশে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যান। জামায়াত বিরোধীতায় নূরুল কবির ও আনু মুহাম্মদ-ও সোচ্চার ও আপোষহীন। তবে এটা করতে গিয়ে তাঁরা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে মিশে যান না। এখানেই তাঁরা অন্য সবার চাইতে আলাদা। এছাড়া নূরুল কবির ‘সুশীল সমাজ’ ও সেনা-সমর্থিত এক এগারো সরকারের-ও ঘোর সমালোচক ছিলেন। আর আনু মুহাম্মদ জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তাঁর চিন্তা ও মতাদর্শের প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। এই দিক দিয়ে তাঁর চিন্তা ও কাজের মধ্যে সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। তবে নূরুল কবিরের সর্বব্যাপী সমালোচনা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা সর্বদা স্পষ্ট নয়। তাঁর সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠান বিরোধী সমালোচনার পাশাপাশি তিনি যদি তাঁর ইতিবাচক চিন্তার রূপরেখাটি উপস্থাপন করেন তাহলে তাঁর ভক্তেরা আরও ভালো করে তাঁকে বুঝতে ও অনুসরণ করতে পারবে।
টেলিভিশনের টক শো গুলোতে যেসব ডিসকোর্স সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি সেগুলোর শ্রেণীবিন্যাস ও অনুধাবনে এই প্রাথমিক প্রচেষ্টাটি নিবেদিত হল। এটি সম্পূর্ণভাবে করা গেছে, বা সকল চিন্তাধারা বা ডিসকোর্স গুলোকে এখানে চিহ্নিত করা গেছে – সেই দাবী নিশ্চয়ই করা ঠিক হবে না। তবে এই পদ্ধতিগত শ্রেণীকরণ ও মূল্যায়নের ধারাটি অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। আরো অনেকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। কারণ আমাদের জনমানস ও সামষ্টিক মনঃস্তত্ত্ব গঠনে ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল সামাজিক মিডিয়ার এই ডিসকোর্স গুলোর রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ও অপরিসীম ভূমিকা।
লেখক পরিচিতিঃ মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত। ঢাকার ইংরেজী মাধ্যম স্কুল স্কলাসটিকায় কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। তাঁর ইংরেজী ভাষায় রচিত ‘ডিসকভারিং বাংলাদেশ’ নামক একটি বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়ক গ্রন্থমালা বিভিন্ন ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে প্রচলিত। তিনি সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও শিল্প-সংস্কৃতির একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।
ই-মেইলঃ manwar.shamsi@gmail.com