মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
সমকালীন বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাধারণ-শিক্ষায়-শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘প্রগতিশীলতা’ ও ‘আধুনিকতা’র নামে একধরনের ইসলাম-বিমুখতা (এমনকি বিদ্বেষ) লক্ষ করা যায়। এই শ্রেণীর তরুণেরা পাশ্চাত্য এনলাইটেনমেন্ট চিন্তার প্রভাবে ইউরোপীয় ইহজাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শের প্রতি সাধারণত আকৃষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তুতারা ভুলে যায় যে ইউরোপীয় ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ ঘটেছিল সেখানকার ইতিহাসের একটি বিশেষ প্রেক্ষিতে। সেটা আসলে ঘটেছিল মধ্যযুগের খ্রিষ্টীয় চার্চের নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া উত্থানের বিশেষ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে।
অথচ বাংলার ইতিহাসে ইসলামের আবির্ভাব ও ভূমিকা মধ্যযুগের খ্রিষ্টান ধর্মের মত নয়। একটি তীব্র সামাজিক নিপীড়নমূলক হিন্দু বর্ণভেদ প্রথার বিপরীতে মুক্তিদায়ী চেতনা হিসেবে মধ্যযুগের বাংলায় ইসলামের আগমন। এই জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গ কৃষিজীবী শ্রেণী যাঁরা আর্য বর্ণভেদ সমাজব্যবস্থার অধীনে কোনও যথার্থ স্থান পাননি, তাঁরা প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মের সমতাভিত্তিক ব্যবস্থায় আশ্রয় খুঁজেছেন এবং পরবর্তী্কালে সুমহান ইসলামের আওতায় এসে সমতার মর্যাদা অর্জনে প্রয়াসী হয়েছেন।
পরবর্তীকালে ইংরেজ আমলে এই বাঙালি মুসলিম কৃষক শ্রেণীই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথার অধীনে পুনরায় শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বর্ণ হিন্দু জমিদার শ্রেণীর দ্বারা। এই বর্ণ হিন্দু জমিদার শ্রেণীর জুলুম থেকে ও ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে বাংলার মুসলিম কৃষক শ্রেণী ধারাবাহিকভাবে শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছেন। এক্ষেত্রেও ইসলাম একটি প্রগতিশীল ও ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। কাজেই মধ্যযুগের ইওরোপে খ্রিস্টান ধর্মের ভূমিকা নেতিবাচক হলেও বঙ্গদেশে ইসলামের ভূমিকা মধ্যযুগ থেকে আজ অবধি অত্যন্ত ইতিবাচক।
বাঙালি মুসলমান কৃষক শ্রেণী পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন ইসলামের এই ধারাবাহিক মুক্তিদায়ী চেতনা ও ভূমিকার আলোকেই। পাকিস্তান আমলে যখন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অব্যাহত রইল এবং গণতন্ত্রের চর্চায় ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো, তখন এই বাঙালি মুসলমানেরা ভাষা ও স্বাধীকারের সংগ্রাম থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির দিকে এগিয়ে গেলেন। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে বটে, কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও জাতীয় বিকাশে ইসলামের মুক্তিদায়ী ভূমিকা শেষ হয়ে গেছে? এর উত্তর হল – না, বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণে ও বাঙালি মুসলমানের জাতীয় বিকাশে ও অগ্রযাত্রায় ইসলামের সমষ্টিগত ভূমিকা এখনো অপরিসীম। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইসলামের গণ্ডি থেকে খারিজ হবার জন্য নয়। হ্যাঁ, ইসলামের যে ধারাবাহিক রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তিদায়ী ভূমিকা আমরা এই অঞ্চলে দেখে আসছি, মধ্যযুগে এর আগমন কাল থেকে, তা আজও বাংলাদেশে অতীব প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য।
তাই ‘আধুনিকতা’ ও ‘প্রগতিশীলতা’র নামে ইসলামের সমষ্টিগত মুক্তিদায়ী চেতনা থেকে বাঙালি মুসলমান তরুণ প্রজন্ম বিযুক্ত থাকতে পারে না। আর ইসলাম যেহেতু একাধারে ইহজাগতিক এবং পারলৌকিক, আবার ইসলাম যেহেতু অন্তর্নিহিতভাবে অসাম্প্রদায়িক ও সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই আলাদাভাবে ইউরোপীয় আদলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাও এখানে অপ্রয়োজনীয়।
বাঙালি মুসলমান তরুণ প্রজন্মকে আজ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সৃষ্টিশীল ও উদ্যোগী হয়ে উঠতে হবে। এটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য খুবই দরকার। তাঁদেরকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দৃঢ়ভাবে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই সঙ্গে তাঁদের আত্মসম্মানবোধ, আত্মবিশ্বাস ও চারিত্র্য সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য ইসলামী সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের অনুশীলন ও অনুসরণ করতে হবে। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার সঙ্গেসঙ্গে একই মাত্রায় ইসলামী আদর্শ, জ্ঞান ও সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। মনে রাখতে হবে মধ্যযুগে ও ইংরেজ উপনিবেশ থেকে মুক্তির কালে ইসলাম যেমন বাঙালি মুসলমানের দিকনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে, ঠিক তেমনি আজও বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলাম বাঙালি মুসলমানের জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎস ও পথনির্দেশিকা হতে পারে।
তাই আমাদের প্রত্যাশা এই যে, এই সময়ের বাঙালি মুসলমান তরুণ পাশ্চাত্যের জন লক্, টমাস হব্স, এডাম স্মিথ, জন স্টুয়ার্ট মিল, কার্ল মার্ক্স, জন কেইন্স, নোয়াম চমস্কি, মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদ্যা, এডওয়ার্ড সায়ীদ প্রমুখের লেখা ও চিন্তা চর্চার পাশাপাশি প্রাচ্যের মওলানা রুমি, আল গাজ্জালী, ইবনে তাইমিয়া, শাহ ওয়ালীউল্লাহ, আল্লামা ইকবাল, মওলানা মওদুদী, আকবর এস আহমেদ, মুহম্মদ আবদুহু, সাইয়িদ কুতুব, এল এফফেন্দি প্রমুখের রচনা ও চিন্তার প্রতিও সমান অভিনিবেশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে। শুধুমাত্র পশ্চিমা ধ্যান ধারণায় নিমগ্ন থেকে একধরনের উন্নাসিক আত্মশ্লাঘায় না ভুগে তাঁদের উচিত হবে নিজেদের মুক্তিদায়ী ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকেও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন উৎস ও উপাদান আহরণ করে সময়োপযোগী গতিশীল শ্রেয়তর ইসলামী চেতনা ও সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশ সাধন করা।
লেখক পরিচিতিঃ মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত। ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল স্কলাসটিকায় কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। তাঁর ইংরেজী ভাষায় রচিত ‘ডিসকভারিং বাংলাদেশ’ নামক একটি বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়ক গ্রন্থমালা বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে প্রচলিত। তিনি সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও শিল্প-সংস্কৃতির একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।
ই-মেইলঃ manwar.shamsi@gmail.com