খন্দকার রাক্বীব, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের ‘ওয়ার অন টেরর’ প্রকল্পের আওতায় গত বছর যে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন’ পাস করেছে তার ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী স্বরূপ দিন দিন উন্মোচিত হচ্ছে। ৭৪এর বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো এই কালো আইনকে রুখে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। এক্ষেত্রে জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রবর্তিত ‘মিথ অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’ আর সলিমুল্লাহ খান প্রবর্তিত সন্ত্রাসবাদ কেন্দ্রিক ‘ত্রাসনীতিঃ বিচার না বারোয়ারী’ এর পুনর্পাঠ জরুরী। জানার কথা যে, সন্ত্রাসবাদের এংরাজি প্রতিশব্দ ‘টেররিজম’এর উৎপত্তি মূলত ফরাসি দেশে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। সেকালে জনগণের বড় বড় আন্দোলন রোধ করার মতলবে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র বা সরকার সমাজে ভয়ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করতেন। এই ধরণের চেষ্টার নাম-ই এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল ‘টেররিজম। জগতখ্যাত ফরাসি বিপ্লবের বিশেষ এক বছরে ১৭৯৩-৯৪তে ডাক্তার গিয়োটিন প্রবর্তিত যন্ত্র তলোয়ারে যখন আনুমানিক বিশ হাজার লোকের মাথা কাটা হয়, তখনকার সময়কেই প্রথম বিবেচনা করা হয় ‘রেইন অব টেরর’ হিসেবে। যার বাঙ্গালায় সহজ বয়ান এখন ত্রাসের রাজত্ব।
সন্ত্রাসবাদের এই বয়ান জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার মূল দোসর জোসেফ কনরাডোর মত ঔপোন্যাসিকরা আর নীৎসেদের মত নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকরা। যার নজির আমরা বিংশ শতাব্দীতে আমাদের এই দেশে দেখেছি। যখন এখনকার মানুষদের অসহযোগ, অহিংস, খেলাফত আর সত্যাগ্রহের মত স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াইগুলোকে ত্রাস হিসেবে হাজির করা হয়েছে। যেমন এখন করা হচ্ছে জায়নিস্ট কর্তৃক ফিলিস্তিনি মুসলমানদের আর সিসি কর্তৃক মিসরীয় মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিতকরণ। দেশে দেশে সংঘঠিত জনগণের আন্দোলনকে এভাবেই সাম্রাজ্যবাদীদের ‘ওয়ার অন টেরর’এর আওতায় আনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্প্রতি নিজেকে এই প্রকল্পে জড়িয়ে ফেলছে, যার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ।
জানা কথা যে, টেররের সাথে টেরিটরি তথা ভূখণ্ডের এক ধরণের সম্পর্ক থাকে। দুনিয়া তাবত বর্তমান সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যুদ্ধরত একমাত্র গোষ্ঠী আল-কায়েদা যখন ৯/১১এর ঘটনায় অভিযুক্ত হল, তখন-ই এই সন্ত্রাস আর টেররের সংজ্ঞা নিয়ে গবেষক আর ভাষাতাত্ত্বিকরা বিপাকে পড়ে গেলেন। এক কালের নাস্তিক দেরিদা যখন থেকেই তাঁর অবিনির্মাণ তত্ত্ব নিয়ে জ্ঞানরাজ্যে হাজির হন, তখন থেকেই এই ‘টেররিজম’ ধারণার সমালোচনা করে আসছেন। কিন্তু এই জ্ঞানরাজ্যে আল কায়েদা প্রশ্ন হাজির হওনের সাথে সাথে তিনি নিজ অবস্থান থেকে কেমন করে উল্টে গেলেন।
এশিয় মুসলিমদের খেলাফতি পতনের পর হেজেমনিক পশ্চিমা কর্তৃক তৈয়ার করা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাওয়া ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘ইন্ড অব দ্যা হিস্ট্রি’র মত দেরিদা তাঁর ‘philosophy in the time of violence’এ পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন“ দুই দলের এক দলকে যদি আমার বেছে নিতেই হয় তো আমি আমেরিকা আর ইউরোপকেই বেছে নিব। আমেরিকা আর ইউরোপের বিরুদ্ধে, তাদের রাজনীতির চেহারা আর ‘সন্ত্রাসবিরোধি জোট’ নিয়ে আমার অনেক নালিশ। তবু আমি শত দোষ সত্ত্বেও আইন যাদের পক্ষে আর যারা শত সত্য সত্য বেঈমানি আর ওয়াদাভাঙ্গার বৈফল্য সত্ত্বেও গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক বিধি ও ব্যবস্থার পক্ষে একজোট শেষবিচারে সেই দলেরই পক্ষ নেব।”
সলিমুল্লাহ খানরাও এরকম ২০০৫সালে লেখা ত্রাসনীতির প্রশ্নে মজলুমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের জন্য কলম ধরেছিলেন, কিন্তু আজ শেষ বিচারের সময়গুলোতে আর মজলুমের পক্ষে রইলেননা, তাদের বিরুদ্ধেই নব নব তত্ত্ব হাজির শুরু করলেন।
জীবনের সায়াহ্ন বেলায় দেরিদার গুরু লাকা নিজেদের অবস্থান ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছিলেন, পশ্চিমা সভ্যতার কথিত অনুন্নত দুনিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ার অন টেরর বর্ণঘৃণা আকারে হাজির হবে। তাঁর বক্তব্য যথার্থতার দিকেই আগাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে সলিমুল্লাহ খানদের ‘মিথ অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’ আর নব সন্ত্রাসবাদের বয়ান জনগণের সামনে ঘৃণা আকারে সেরকম হাজির হতে পারে। যদি না তারা ওয়ার অন টেররের তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে না পারেন, বুঝতে না পারেন জনগণের মনের কথা, হাজির না করতে পারেন ‘মিথ অব ইন্ডিফ্যান্ডেন্স’এর বদলে ‘ফ্যাক্ট অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’এর বয়ান।
পাদটীকাঃ রাষ্ট্র মানেই সন্ত্রাস, তবে সন্ত্রাস মানেই রাষ্ট্র না (হেবারমাস, ২০০৩)।