সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র – dark side of the moon। পর্ব-

By Watchdog BD

সাল ফাল মনে রাখার ধৈর্য্য কোন কালেই ছিলনা। জীবনের কোন পর্যায়ে এ নিয়ে লেখালেখি করব তার কোন প্ল্যান না থাকায় লিখে রাখার কথাও মনে আসেনি। যে ঘটনার কথা লিখতে যাচ্ছি তার সালটাও মনে নেই। সময়টা তখন ভাঙ্গা গড়ার সময়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে। উপর হতে নির্দেশের বাণ বইছে, আর নীচে তা বাস্তবায়ন করতে হিমসিম খাচ্ছে স্থানীয় নেত্রীবৃন্দ। খবরের জোয়ারে হঠাৎ করেই মস্কো হতে খবর এলো খোদ গর্ভাচেভ আসছেন আমাদের ইউনিভার্সিটিতে। পার্টি প্রধান হওয়ার পর মস্কোর বাইরে এটাই তার প্রথম ভ্রমণ। রবোট টেকনোলজির উপর নতুন একটা ফ্যাকালটি খোলা হবে এবং তা উদ্বোধন করবেন শক্তিশালী সোভিয়েত দেশের প্রেসিডেন্ট ও পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিখাইল সের্গেইভিচ গর্ভাচেভ। লিওনিদ ইলিচ ব্রেজেনেভের মৃত্যুর পর সোভিয়েত সাম্রাজ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে এ নিয়ে বাইরে যতটা জল্পনা কল্পনা ছিল ভেতরের মানুষ ছিল ততটাই নির্বিকার। দিন শেষে ৩ রুবেল ১৫ কোপেকের একটা ভদকা বোতলের সহজলভ্যতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকত কোটি কোটি মানুষ। সাধারণ জনগণের জন্যে রাজনীতি শব্দটা ছিল অনেকটা কালো রাতের, কালো শব্দের, কালো বন্যার মত। দেশটার ইহুদি সম্প্রদায় এ নিয়ে কিছুটা মাথা ঘামাত নিজেদের প্রয়োজনে। শেষ ঠিকানা স্বপ্নের ইসরাইলে পালানোর কায়দা কানুন আবিস্কার করতে গিয়ে রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত অনেকটা বাধ্যবাধকতা হিসাবে। বাকি কোটি কোটি মানুষের জন্যে রাজনীতি ছিল ওয়ান ম্যান শো; যথাক্রমে ব্রেজনেভ হয়ে চেরনেঙ্কো, চেরনেঙ্কো হয়ে আন্দ্রোপভ এবং আন্দ্রোপভ হয়ে গর্ভাচেভ। জোযেফ স্টালিনের আমল হতেই চলে আসছিল এ ঐতিহ্য, যা স্বগৌরবে সমুন্নত রেখে গেছেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ভদ্‌কা স্টকের ওঠানামাকেই ধরা হত দেশটার রাজনৈতিক ব্যারোমিটার হিসাবে। এ ক্ষেত্রে লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ ছিলেন সর্বকালের সেরা চ্যাম্পিয়ান। তার আমলে ৪ ঘন্টা লাইন দিয়ে এক কিলো মাংস পাওয়া ছিল অনেকটা এভারেস্ট জয়ের মত। অথচ ভদকার প্রবাহ ছিল নদীর মত। খেটে খাওয়া সোভিয়েত জনগণকে কি করে খুশি রাখা যায় তা ভাল করেই জানা ছিল সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের নায়কদের। ভদকা ছিল তার অন্যতম কার্যকরী উপাদান। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা এই ধারায় প্রথম ধাক্কাটা আসে গর্ভাচেভের আগমনের সাথে। পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্তের মাধ্যমে মধ্য বয়সী এই নেতা নতুন কিছু বানী পৌছানো শুরু করেন জনগণের দুয়ারে। কলকারখানা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, হাসপাতাল জেলখানা সহ গোটা সোভিয়েত জনগণকে বলা হল পার্টি পূজায় বিরতি দিয়ে সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। ঘুণে ধরা সোভিয়েত সমাজকে ঢেলে সাজাতে জনগণের অংশগ্রহনের প্রয়োজনীয়তার কথা এই প্রথম উচ্চারিত হয়ে সোভিয়েত দেশে। কথা বলার স্বাধীনতা নামের জিনিসটা কি সোভিয়েত জনগণ প্রায় ভুলে গিয়েছিল, তাই কোত্থেকে এর শুরু হবে তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক জল্পনা কল্পনা। এমন একটা প্রেক্ষাপটে খোদ গর্বাচেভের আগমন ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে আমাদের ক্যাম্পাসে।

সেকশন অফিসার আবুল হোসেনের হাতে নারায়ণ ধরিয়ে অথবা বিভিন্ন কমরেডদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোভিয়েত দেশের স্কলারশীপ বাগানোর ট্রাডিশন চালু হতে তখনও বেশ কবছর বাকি। সেরা ছাত্রদের অনেকেই সাড়া দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সোভিয়েত দেশের আমন্ত্রণে এবং ছড়িয়ে পরেছিল রাশিয়া, ইউক্রেন, মোলদাভিয়া,বেলারুশ সহ দেশটার বিভিন্ন রাজ্যে। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশি ছাত্রদের জ্ঞান ও মেধার দাপট অনুভব করতে সময় নেয়নি সোভিয়েত দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো। আজকের দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও বিনায়ক সেন ছিল সেই সোনালী সময়ের প্রতিনিধি। একাডেমিক ফলাফল ও সদ্য স্বাধীন হওয়া বন্ধু প্রতীম দেশের প্রতিনিধি হিসাবে মনে মনে আশা ছিল হয়ত দেখা হবে গর্বাচেভের সাথে। আমার নিজস্ব কিছু কথা ছিল সোভিয়েত সমাজ নিয়ে, অভিযোগ ছিল তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতার। হেমন্তের এ সময়টা পাতা ঝরার সময় ইউরোপে। রাতারাতি রং বদলায় প্রকৃতি। আমাদের ক্যাম্পাসের ব্যাপ্তি ছিল তিন তিনটা সাবওয়ে ষ্টেশন জুড়ে। বিশাল আয়তনের এই ক্যাম্পাসকে পাতামুক্ত করার দায়িত্ব ছিল আমাদেরই। বছরের এ সময়টায় কাজটা করতে হত অনেকটা বার্ষিক রুটিন হিসাবে। এ নিয়ে কারও কোন ক্ষোভ ছিলনা। প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষে নতুন মাত্রা যোগ হয় বাৎসরিক পরিচ্ছন্নতা অভিযানে। চারদিকে উৎসবের আমেজ। হাজারও জল্পনা কল্পনা। আগমনের দিন প্রথম তুষারপাত হয় শহরে। পরিচ্ছন্নতার সব প্রচেষ্টা এক লহমায় তলিয়ে যায় বরফের নীচে। গোসল সেরে পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে প্রয়োজনের চাইতে বেশকিছুটা আগে হাজির হই পরিচিত ক্যাম্পাসে। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। আমরা যারা বিদেশি তাদের সবাইকে বলা হল কেমেস্ট্রি বিল্ডিংয়ে জমা হতে। ৭০টা দেশের প্রায় ২৫০ জন ছাত্র ছাত্রীর অধ্যয়ন আমাদের ইউনিতে। কেমেস্ট্রি বিল্ডিংয়ে জমা হয়ে ভাবলাম হয়ত গর্বাচেভ আলাদাভাবে দেখা করবেন আমাদের সাথে। সবাই আশান্বিত, উদগ্রীব। দশটার ভেতর খবর পাওয়া গেল নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই এসে গেছেন তিনি। তখনই ঘটল ঘটনাটা। দালানের মূল ফটক আটকে দেয়া হল। আমরা যে রুমটায় জমা হয়েছিলাম তার দরজায় ঝুলানো হল বিশাল এক তালা। আমাদের বন্দী করা হয়েছে। একজন এসে বলে গেল যতক্ষণ গর্বাচেভ ক্যাম্পাসে আছেন কেউ বের হওয়ার চেষ্টা করলে এক কাপড়ে ফেরৎ পাঠানো হবে স্বদেশে। থ হয়ে গেল সবাই। সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থার আসল চেহারা নেংটা হওয়ায় অনেকের মত আমি যে খুব একটা অবাক হয়েছি বলা যাবেনা।

লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভকে যেদিন দাফন করার কথা মস্কো হতে এক বড় ভাই এসেছিলেন আমাদের ডরমিটরিতে। হলের বাংলাদেশিরা মিলে আমার রুমে আড্ডা দিচ্ছি। সাথে খাওয়া দাওয়ার বাংলাদেশি আয়োজন। হঠাৎ করে দরজায় অপরিচিত নক। ইউনির যুব কম্যুনিস্ট পার্টির একটা দল ছাত্র রুমে রুমে ঘুরছে। কেন ঘুরছে কেউ জানেনা। আমার রুমে এত ছাত্র দেখে বন্য শুয়োরের মত চীৎকার করে উঠল। এন্টি সোভিয়েত একটিভিটির অভিযোগ আনল। মুখ খুলতে যাব এমন সময় এক লাথিতে ভাতের হাড়িটা উড়িয়ে দিল শূন্যে। বোবা হয়ে শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলনা আমাদের। মস্কো হতে বেড়াতে আসা বড় ভাইকে ধরে নিয়ে গেল খাবার টেবিল হতে । একদিন একরাত ষ্টেশনে কাটিয়ে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় তাকে ফিরতে হয় মস্কোতে। কাহিনীর কিছু অংশ শেয়ার করার ইচ্ছা ছিল গর্বাচেভের সাথে। তিনি নিজ হতে এসব জানতে আগ্রহী ছিলেন। নেতার প্রস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর মুক্তি দেওয়া হয় সবাইকে। ততক্ষণে নেতা জেনে গেছেন একটা সুখী সমৃদ্ধ আধুনিক সোভিয়েত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাফল্যের কাহিনী।

গর্বাচেভের সাথে দেখা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তবে তা ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। নিউ ইয়র্ক শহরের ল্যা গুয়ারডিয়া এয়ারপোর্টে। বস্টন যাচ্ছেন একাকী। ততদিনে ঢাল তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার বনে গেছেন তিনি। মার্কিন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। না বলা কথার অনেক গুলোই বলে ফেলেছিলাম সেদিন। পালটা মন্তব্য না করে কেবল রুশ ভাষা জ্ঞানের প্রশংসা করে বস্টন গামী প্লেনের যাত্রী হয়েছিলেন এক কালের পরাক্রমশালী এই নেতা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s