by মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত
বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত’ গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসেছে। আর প্রতিরোধ আন্দোলনের বন্ধ্যাত্ব সামষ্টিক মানসে এনেছে হতাশা আর নির্বেদ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক চেতনায় একটি উজ্জীবন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও তৎকালীন সার্বিক মাৎস্যন্যায় জাতির মানসে সেই উজ্জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে বয়ে এনেছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ ও ক্লেদ। জাতীয় মানসের সেই বিষণ্ণ নির্বেদ ও স্বপ্নভঙ্গজাত আত্মগ্লানি ও আত্মপ্রত্যয়রিক্ত দিকনির্দেশহীনতা থেকে বাংলাদেশকে পুনরায় জেগে উঠতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত।
কিন্তু ২০১৪ সালে এসে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রাণহীন খোলসসর্বস্ব গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। সংবিধান একটি অন্তর্বিরোধপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়ে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় সংসদ অকার্যকর একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের নামে দলীয় গোষ্ঠীতন্ত্র প্রবল হয়ে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নকে সর্বব্যাপী করে তুলেছে। গণতন্ত্রের যে একটি অনুসঙ্গ এতদিন জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে অন্তত একদিনের জন্য হলেও সম্ভবপর করেছে, সেই নির্বাচনকেও যাচ্ছেতাই রাজনৈতিক ব্যভিচারের মাধ্যমে একটি প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।
আর জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এই অধোগতির ধারাকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে রাজনৈতিক আন্দোলন ও নেতৃত্ব আমরা বর্তমানে দেখতে পাই তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত ও দুর্বল। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক দুর্বলতা যেমন রয়েছে, তার চাইতেও বেশী রয়েছে মতাদর্শিক, রণনৈতিক ও রণকৌশলগত অপরিপক্কতা ও অদূরদর্শিতা। মেধাবী, মননশীল ও সৃজনশীল নেতৃত্ব ও কর্মসূচির অভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম ও আন্দোলন গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ। জনসম্পৃক্ত মতাদর্শ, নেতৃত্ব, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপ্রয়োগের অভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধ্যাত্বের চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুধুমাত্র পেশিশক্তিনির্ভর ও ফায়দালোভী রাজনৈতিক পেশাদারদের দিয়ে ব্যাপক গণভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। ‘নির্বাচিত’ স্বৈরতন্ত্র এই সুযোগে ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে এবং দেশী-বিদেশী সমর্থক গোষ্ঠীর সহায়তায় আরও সুসংহত হতে থাকে।
জাতীয় চেতনায় মনঃস্তাত্ত্বিক শূন্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি সংঘবদ্ধ, সুসংহত, মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংগঠনের জনসম্পৃক্ত ব্যাপক প্রতিরোধ সংগ্রামের অনুপস্থিতির কারণে একটি জাতিব্যাপী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক শূন্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে। এই বাস্তব ও ব্যাপক নিটশীয় শূন্যবোধের প্রতিক্রিয়ায় জাতির সংবেদনশীল ও মননশীল চেতনা ও মানসে এক যন্ত্রণাকাতর, বিষণ্ণ মনোবেদনা ও ব্যর্থতাজাত অবসাদ অনুভূত হচ্ছে। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া অথবা সাফল্য ব্যর্থতা থেকে এই সামষ্টিক বেদনা ও যন্ত্রণা পরিমাণগত ও গুণগত উভয়দিক থেকেই আলাদা। জাতি, দেশ, রাষ্ট্র প্রভৃতি নিয়ে যেসব মননশীল ও সৃজনশীল নাগরিকেরা ভাবেন ও সক্রিয় হবার চেষ্টায় ও চর্চায় ব্যাপৃত থাকেন, তাঁরা যে সামাজিক শ্রেণী ও স্তরেই অবস্থান করুন না কেন, তাঁদের চেতনায় ও মননে এই জটিল ও কুটিল সংকটজাত সংবেদনা ও সংক্ষোভ প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হবেই। আর এই মনোবেদনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হল অসংগঠিত ও অসংবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত ব্যক্তি-নাগরিকদের একান্ত অপারগতাজাত অসহায়ত্ববোধ ও তৎসংলগ্ন আত্মগ্লানি ও অপরাধবোধ।
উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক জাহিলিয়া
এই বিষয়টি খোলাসা করতে মহামতি কার্ল মার্ক্সের একটি বিখ্যাত উক্তির আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন যে দার্শনিকেরা এ যাবৎ ইতিহাসের শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যেই নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছেন, কিন্তু যা আরো বেশী কাম্য তা হল ইতিহাসের পরিবর্তনের জন্য কাজ করা, শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়। বুদ্ধিবৃত্তির এই মহান দায় কাঁধে নিলে যে কোন মননশীল নাগরিক একধরণের বিদগ্ধ অপারগতার মনোযন্ত্রণায় আক্রান্ত হতে বাধ্য। জাতি-দেশ-রাষ্ট্র বিবর্তনের এমন এক বন্ধ্যা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যখন সামাজিক শুভশক্তিগুলো নিঃসঙ্গ, বিযুক্ত, অসংঘবদ্ধ ও নেতৃত্বহীন আর সামাজিক অশুভশক্তিগুলো দেশী-বিদেশী প্রেক্ষাপটে অনেক বেশী একাট্টা ও সক্রিয়। সর্বব্যাপী আঁধি, নেতি ও অকল্যাণের এই কৃষ্ণপক্ষকেই বোধকরি উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক জাহিলিয়া বলে বয়ান করা যেতে পারে। কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের মাধ্যমে যখন পৃথিবীব্যাপী একধরণের পণ্যসম্ভোগবাদী ও আগ্রাসী বিশ্বব্যাবস্থা কায়েম করেছে, তখন নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক ব্যক্তি, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতি হিসেবে স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো অনেকাংশেই অপসৃয়মান।
বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার নবজাগরণ ও বাংলাদেশ
এর সঙ্গে রয়েছে মহান এক আল্লাহর প্রতি সমর্পণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠাকামী আত্মিক শ্রেয়োবোধ ভিত্তিক বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার নবজাগরণকে নস্যাৎ করতে সদা সতর্ক ও প্রস্তুত পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন সভ্যতার একক অথবা যৌথ যুদ্ধাভিযান। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই আন্তর্জাতিক সমীকরণের বাইরে নয়। ‘জঙ্গিবাদ’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’ দমন বা নির্মূলের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রের ন্যূনতম পূর্বশর্তগুলোকে উপেক্ষা ও বিসর্জনের বিপজ্জনক ডিসকোর্স আমরা বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরেই শুনতে পাই। এই ডিসকোর্সের তাত্ত্বিক গুরুরা প্রকারান্তরে জুডিও-খ্রিষ্টান নব-ক্রুসেড ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকেই প্রমোট করে চলেছেন।
চাই আত্মিক চেতনায় বলীয়ান আদর্শভিত্তিক নতুন সৃজনশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি
কাজেই বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে এর যেমন একটি দেশী প্রেক্ষিত রয়েছে, তেমনি এর রয়েছে একটি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত। তাই ব্যক্তি, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতি হিসেবে উপনিবেশ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ক্রমাগত বিকাশ ও উত্তরণের যাত্রায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ হয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে স্বাধীনতা ও মুক্তির অভিযাত্রা, সেখানে একটি অভিজ্ঞতা বারবার বেঠোফেনের পঞ্চম সিম্ফনির বিখ্যাত থিমের মত বেজে উঠেছে। আর সেটা হল গণতন্ত্রকে দুর্বল করে ও স্বৈরতন্ত্রকে প্রবল করে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম হতে পারেনি। অন্যদিকে বন্ধ্যা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনর্গঠিত হয়ে, অথবা পরিবর্তিত হয়ে অথবা নতুন জনসম্পৃক্ত ও আত্মিক চেতনায় বলীয়ান আদর্শভিত্তিক শক্তির আগমনের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও প্রগতি বেগবান হয়েছে নানান পালাবদলের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং ব্যক্তির একক ও জাতির সামষ্টিক চেতনায় যে সর্বগ্রাসী অবসাদ, হতাশা ও নির্বেদ ইতিহাসের পর্ব-পর্বান্তরে নেমে এসেছিল তা যেমন নতুন সৃজনশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির অভিঘাতে কেটে গিয়েছিল, আশা করা যায় যে এখনকার বন্ধ্যা প্রতিরোধ সংগ্রামও নতুন উদ্যোগে, নতুন কৌশলে, নতুন নেতৃত্বে সফল হয়ে অচিরেই সামষ্টিক মননের তমসা ও স্থবিরতার অবসান ঘটাবে।