by মুহাম্মদ আব্দুল খালিক
‘মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন, তবে (বেড়ে ওঠার পর থেকে) সে সর্বত্র (বিভিন্নভাবে) পরাধীনতার শৃঙ্খলে থাকে আবদ্ধ।’ যুগে যুগে বিভিন্ন সমাজে-সম্প্রদায়ে, রাজ্যে-রাষ্ট্রে, সভ্যতায়-মতাদর্শে এর প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করি।
সমাজে আমরা কোনো না কোনোভাবে শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই। বাল্যকালে আমরা আমাদের পিতা-মাতা ও শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকি। আমাদের পিতা-মাতা ভুল মতবাদ বা প্রথা শিক্ষা দিয়ে সহজেই আমাদেরকে বিপথগামী করতে পারেন, শিক্ষকমন্ডলী ভুল আদর্শ বা জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে ভারী করে তুলতে পারেন। আর আমাদেরকে তাই করতে হয় যা তারা বলেন বা যে নির্দেশনা তারা দেন। বড় হলে জীবিকার তাগিদে আমাদের বেছে নিতে হয় কোনো পেশা বা কর্মকে। সেখানে আমাদেরকে হুকুম মেনে চলতে হয় আমাদের উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের। এমনকি চাকুরি বাঁচাতে তাদের অন্যায় আদেশও মানতে থাকি আমরা বাধ্য। রাষ্ট্রে বসবাস করতে যেয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত মেনে চলতে হয় হাজারো আইন-কানুন। রাষ্ট্রের কর্তারা তাদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য কিংবা তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য এসব আইনে রেখে দেন প্রয়োজনীয় ফাঁক-ফোঁকর। আমাদের এতে বলার থাকে না কিছুই। তাদের স্বার্থের কাছে আমাদের স্বাধীনতার জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের সাজতে হয় সুনাগরিক। নইলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর হাত তো রয়েছেই।
‘মানব ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস’ বা ‘মানব সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে সত্য-মিথ্যার মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস’, যাই বলি না কেন; যুগে যুগে মানুষ যে শক্তিমানদের দ্বারা নির্যাতন, নিষ্পেষণ, বঞ্চনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছে এ কথা বলা যায় অনায়াসেই। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাই আমরা খুঁজে পাই ভয়ানক যুদ্ধ, রক্ত নিয়ে হুলি-খেলা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, ধর্ষণ আর পেশী শক্তির আধিপত্য।
আমাদের জানা-শুনা সভ্যতাগুলোর মধ্যে মেসোপটেমিয়া, সুমেরিয়, মিশরীয়, গ্রীক, রোমান, পারস্য, ইনকা, আজটেক ও মুসলিম সভ্যতা উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি সভ্যতার মধ্যে ছিল ক্ষমতা দখলের অসুস্থ লড়াই। পর রাষ্ট্র আক্রমণে প্রতিটি সভ্যতাতেই ছিল সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের উপস্থিতি। মানবাধিকার লঙ্ঘনে কোনো কোনো সভ্যতা এতই নীচে নেমে গিয়েছিল যে, ঐ সময়টাকে ইতিহাসে অভিহিত করা হয়েছে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে।
গ্রীক সভ্যতায় জ্ঞানচর্চা ও সত্য প্রচারের জন্য ইতিহাসশ্রেষ্ঠ মনীষী সক্রেটিসকে শিকার হতে হয় মৃত্যুদন্ডের, প্লেটোকে জীবন বাঁচানোর জন্য এথেন্স থেকে রাতের আঁধারে পাড়ি জমাতে হয় স্পার্টায়। রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন লোকদের দ্বারা জ্ঞান ও সত্য প্রচারকারী লোকজন এভাবে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারীদের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। পতিতাবৃত্তি ও পুরুষের সেবা দাসে পরিণত করা হয়েছিল নারীদের। প্রচলন ছিল জঘন্য দাস প্রথার। শক্তিমান মানুষরা (?) আবির্ভূত হয়েছিল দুর্বল মানুষদের প্রভু হিসেবে।
রোমান সভ্যতাও নির্যাতনে পিছিয়ে ছিল না কোনোদিকেই। শহরকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছিল অভিজাত শ্রেণী যাদের দ্বারা পরিচালিত হতো সাম্রাজ্যের শাসনকার্য। প্রচলন ছিল ঘৃণ্য দাস প্রথারও। তারা এতটাই নীচে নেমে গিয়েছিল যে, ঐসব দাসদের দ্বারা আয়োজন করতো ‘গ্লাডিয়েটর’ নামক বর্বরোচিত ক্রীড়ার, যেখানে তাদেরকে পরস্পর অবতীর্ণ হতে হতো মৃত্যু পর্যন্ত জীবন সংহারী লড়াইয়ে। আর রক্তের এ হুলি-খেলা দেখে আনন্দ পেত অভিজাত (?) নামীয় ক্ষমতাবানরা। সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে তারা আক্রমন করতো বিভিন্ন রাজ্য ও সম্প্রদায়ের উপর। সাম্রাজ্য সম্প্রসারণবাদী উন্মাদতা তাদের মধ্যে এতটাই শিকড় গেড়েছিল যে, বিনা অপরাধে ও বিনা প্ররোচনায় দুর্বল সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর তারা হামলা করতো। রোমানরা এতটাই যুদ্ধবাজ ছিল যে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকল পুরুষকেই সামরিক বাহিনীতে সেবা দিতে হতো। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা তখন রাষ্ট্রের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল। নিরীহ জনপদের ওপর আক্রমনে ব্যবহৃত হতো ধর্ম প্রচারের ছুঁতো। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বিস্তার ঘটেছিল ব্যাপকভাবে। নারীকে পরিণত করা হয়েছিল পুরুষের মনোরঞ্জনের উপকরণ হিসেবে। বেশ্যাবৃত্তি, বহুমাগামিতা, অবাধ যৌনাচার তখন অভিজাত শ্রেণীর সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।
পারস্য সভ্যতায় ক্ষমতাসীন শ্রেণী জনগণের ভাগ্য নির্ধারকের আসনে সমাসীন হয়েছিল। তাদের নির্দেশ ও বিধিই ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। তারা ছিল অগ্নি উপাসক। অন্য কোনো ধর্ম বা আদর্শ মেনে চলার কোনো এখতিয়ার জনগণের ছিল না। নারীদের অবস্থাও ছিল নাজুক। তাদেরকে পরিণত করা হয়েছিল পুরুষের ভোগের পণ্যে। প্রচলন ছিল দাসত্বপ্রথারও। যেখানে শক্তিমানরাই ছিল প্রভু, আর দুর্বলরা পরিণত হতো তাদের দাসে। যুদ্ধের নামে ক্ষমতা ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় মত্ত ছিল তারাও।
মুসলিম সভ্যতাও সবদিক বিবেচনায় সে বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। মুসলিমরা যে সময়কে ‘সোনালী যুগ’ হিসেবে অভিহিত করে সে সময়টা ছাড়া পরবর্তী সময়গুলোতে ক্ষমতা দখলের নেক্কারজনক প্রতিযোগিতা মুসলিম শাসক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। উসমানীয়, আব্বাসীয় প্রভৃতি সম্প্রদায়ে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এদের মধ্যে এতো বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ছিল যে, মৃত ব্যক্তির কবরে গিয়েও তারা প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা চালাত। তবে সোনালী যুগের শাসকসহ বিভিন্ন সময়ে অনেক সৎ শাসকের উপস্থিতিও আমরা মুসলিম সভ্যতায় লক্ষ্য করি যারা মানবতার জন্য, জ্ঞানের বিকাশের জন্য কাজ করে গেছেন। মুসলিম সভ্যতর সবচেয়ে বড় অবদান হলো- তারা চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে মানব জাতির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে মানুষের মধ্যে সত্যিকারের মূল্যবোধ জাগ্রত করেছিল। বিশ্বে প্রথমবারের মত প্রতিষ্ঠা করেছিল নারী অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার; দাসত্ব প্রথা রোধে গ্রহণ করেছিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
পাশ্চাত্য সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটেছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। তবে পাশ্চাত্য সভ্যতার সম্পর্কে প্রাচ্যে সবচেয়ে প্রচলিত কথাটি হলো- ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা দিয়েছে বেগ, আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ। বস্তুবাদ আর ভোগবাদী মানসিকতার জোয়ারে পাশ্চাত্যে আজ মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা বিলুপ্তির পথে। অর্থ উপার্জন, সম্পদ আহরণে নিচুতর পদক্ষেপ নিতেও তারা পিছপা হয় না। কিছু সংখ্যক কর্পোরেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ মানুষ। সরকারও কাজ করছে কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায়। আর বিশ্বব্যাপী পাশ্চাত্য আধিপত্য বিস্তারের নিকৃষ্ট ও জঘন্য প্রতিযোগিতা তো রয়েছেই। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানব জাতিকে উপহার দিয়েছে এই পাশ্চাত্য সভ্যতাই। ঔপনিবেশিক যুগে উপনিবেশ স্থাপন করতে যেয়ে হত্যা করেছে লাখো লাখো মানুষকে। আর এসবই করা হয়েছে তাদের আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য। বর্তমানেও পৃথিবীব্যাপী এক ত্রাসের রাজ্য তারা প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে যেখানে তাদের স্বার্থের বাইরে যাওয়া মানেই নির্যাতন ও নিষ্পেষণের তীব্র আঘাত। নারীদের উন্নয়নে প্রশংসনীয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও নারীকে পুরুষের ভোগের পণ্যে পরিণত করার বৃত্ত থেকে এখনো বের করে আনা সম্ভব হয়নি। মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার মত গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রেখেছে বর্তমান সভ্যতা। তবে বৃহৎ শক্তি কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে শাসন ও শোষণ করার মনোভাব তা ব্যাহত করছে প্রতিনিয়ত।
বলা হয়, মানবজাতি বর্তমানে আধুনিক-উত্তর যুগে বাস করছে। মানুষ প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায়। কলা, দর্শন, বিজ্ঞান, আইন, মহাকাশ, তথ্য-প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা কোন ক্ষেত্র বাকী আছে যে সম্পর্কে মানুষ গবেষণা করেনি? মানুষের পথচলার জন্য এসব জ্ঞান, তথ্য ও তত্ত্ব দিতে পারে সঠিক পথের দিশা। তবে এজন্য সাধারণ মানুষকে কায়েমী স্বার্থান্বেষী পুঁজিপতি ও ক্ষমতাশালীদের চক্রান্ত সম্পর্কে থাকতে হবে সচেতন। নিজেদেরকে জ্ঞানে, দক্ষতায় আরো উন্নত করে পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে রুখে দিতে হবে এসব তথাকথিত স্বার্থান্বেষী মহলকে। তাহলেই হয়তো মানবজাতি একটি কল্যাণপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।