By Jahid Islam
আমার প্রায়ই মনে হয় বাংলাদেশে আমরা মোঘল আমলে বাস করি, অন্তত চিন্তা চেতনায়। এখন খালি সম্রাটের বদলে সম্রাজ্ঞীরা দেশ চালায়। মোঘল বাদশাহরা যেমন একজনের পর একজন ক্ষমতায় আসতেন আমাদের দেশেও এই মত সরকারের বদল হয়। ব্যাপারটা বিস্তারিত ব্যাখার দাবি রাখে। যেমন- মোঘল সম্রাটরা ছিলেন শিল্প সাহিত্যের সমঝদার। তাদের রাজ দরবার আলোকিত করে থাকতেন কবি সাহিত্যিকেরা । সেসব শিল্পী,কবি-সাহিত্যিকদের নাচ, গান, কবিতা, আবৃত্তিতে মুগ্ধ হয়ে মোঘল বাদশাহরা নজরানা দিতেন, উপযুক্ত পদে বসাতেন। এদের মধ্যে আমরা সম্রাট আকবরের নবরত্নের কথা বিশেষভাবে জানি।
আমি অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম আমাদের রাষ্ট্র প্রধানরাও তো এ পথে হেঁটেছেন, হাঁটছেন।
যেমন ধরুন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ছিলেন কবিতার বিশেষ সমঝদার। তিনি নিজে কাব্য প্রেমিক ছিলেন,সাধ্যমত লিখতেও চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন অভিনয়ের সমঝদার। আমি দেখিনি তবে শুনেছি, তিনি নাকি ‘নতুন কুঁড়ি’ তে শিল্পী ঈশিতার অভিনয় দেখে কেঁদেছিলেন। একবার শুনেছিলাম তিনি নাকি নিজেও ভাল অভিনেতা। যখন সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তিনি নাকি এমন অভিনয় করতেন যেন কিছুই জানেন না। এ কারণেই তাকে কেউ কখনো নিজের জন্য ঝুঁকি মনে করেনি। অথচ তিনি কি কৌশলে এক সময় ক্ষমতা দখল করে নিলেন। ঠিক যেন কোন মোঘল সম্রাটের শত্রু রাজাকে ধোঁকা দিয়ে রাজ্য জয়ের মত। এবারের সাম্প্রতিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে তার ভূমিকা দেখেও অনেক সমঝদার দর্শক তার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। তাকে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীও শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীতের সমঝদারিতায় যেন একজন যোগ্য মোঘল উত্তরসুরি । তিনি অনেক শিল্পী,কবি-সাহিত্যিকদের পারফরম্যন্সে মুগ্ধ হয়ে ইতিমধ্যে তাদেরকে উপযুক্ত নজরানা দিয়েছেন। যেমন- আসাদুজ্জামান নূর, তারানা হালিম, গায়িকা মমতাজ প্রমুখ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়ভাজন লেখকও আছেন কয়েকজন। যেমন-শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন,আবদুল গাফফার চৌধুরী। এরা ত আসলে হাসিনার রাজসভার এক এক জন আবুল ফজল। অনেক মোঘল সম্রাট নিজেরাই ছিলেন বড় লেখক, যেমন -আওরঙ্গজেব। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও তো নিজেই অনেকগুলো বই লিখেছেন। তার সুললিত কণ্ঠে গাওয়া ‘ধনধান্যে পুস্পে ভরা’ গানটি দর্শক শ্রোতাকে আবেগ আপ্লুত করেছে।
মোঘল সম্রাটরা নিয়মিত শিকারে অংশ গ্রহণ করতেন। তীরন্দাজি, ঘোড়দৌড় এর মত ক্রীড়া কৌতুকে তাদের ছিল অনেক আগ্রহ। আমাদের এরশাদও তার রাজত্বের শুরু থেকেই এসব বিষয়ে মোঘল সম্রাটদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। একবার বিপিএল এ এক সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি সগৌরবে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি নাকি এ দেশে ক্রিকেটের প্রচলন করেছেন। গলফ খেলার উদ্দেশ্যে তিনি ত নির্বাচনের ব্যস্ত কর্মসূচীতে থেকেও সময় বের করে নিয়েছেন আমাদের চোখের সামনেই।আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও প্রায়ই ক্রিকেট খেলা দেখতে মাঠে আসেন। সম্প্রতি ফেসবুকে তিনি এবং তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যাডমিন্টন খেলার ছবি ত আসলে মোঘল সাম্রাজ্যের সোনালি অতীতের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
অনেকে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের বহুগামিতার সমালোচনা করেন। অথচ এটাও মুঘল আমলেরই ঐতিহ্য। মুঘল আমলে রাজা বাদশাহদের নিজেদেরই হেরেমখানা ছিল।
কিছুদিন আগে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুকে একটা ছবি দেখেছিলাম হাতে বিয়ারের বোতল সহ। অনেকে এর সমালোচনা করেছেন। আমার মনে হয়েছে যারা এ সমালোচনা করেছেন তারা ইতিহাস সচেতন না। কেননা, মোঘল শাহজাদারাও একটু আধটু মদ্য পান করেতেন। রাজা শাহজাদারা একটু আধটু সেবন করলে এটা তেমন দোষের কিছু না।
মোঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ত সেটা মাথায় রেখেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি দশ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াতে চান। মোঘলদের খাবারের ‘মোঘলাই রুচির’ কথা খুব বিখ্যাত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে বিরিয়ানি রান্নার যে ছবি আপলোড করেছেন সেটা থেকেই তার মোঘলাই রুচির কথা বোঝা যায়। মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের ছিল ছবি আকার শখ। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হল ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার শখ।
ক্লাস এইটে, সম্ভবত কালিদাস রায়ের লেখা (লেখকের নাম ভুল হতে পারে) একটা কবিতা পড়েছিলাম ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ নামে। সেখানে বর্ণনা ছিল একজন সম্রাট হয়েও তিনি কি করে একটি শিশুকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন খ্যাপাটে উদ্ধত হাতির সামনে থেকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে বক্তৃতা দিলেন এটি ত আসলে সম্রাট বাবুরের সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
মোঘল আমলে কেউ যদি কোন উজিরের সাথে এমন কোন আচরণ করত যেটিকে উজির অশোভনীয় মনে করেছে তাহলে শাস্তি হত- জীবনদণ্ড । রেফারেন্স সহ এরকম ঘটনার উল্লেখ করেছেন লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার ‘বাদশাহ নামদার’ বইয়ে। হাসিনার উজির আসাদুজ্জমান নুর কিংবা শামীম ওসমানের সাথে যারা অসদাচরণ করেছে তারা ইতিমধ্যেই দণ্ডিত হয়েছেন প্রাণদণ্ডে।
মোঘল সম্রাটরা বিভিন্ন নাম ধারন করতেন। মানুষও তাদের সে নামে ডাকত। আমাদের দেশেও এই চল আছে। পল্লিবন্ধু, দেশনেত্রী, জননেত্রী এসব উপাধি ত আসলে মোঘলদের আদলেই এসেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অনেকগুলো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রীতে ভূষিত করেছে ঠিক যেভাবে অন্য রাজ্যের কোন রাজা মোঘল সম্রাটদেরকে উপাধি দিতেন। মোঘল সম্রাট-সুবেদাররা তাদের প্রিয়জনের স্মৃতিতে স্তম্ভ নির্মাণ করেছেন। যেমন-তাজমহল, পরিবিবির মাজার। আমাদের দেশেও রাজনীতিবিদেরা তাদের প্রয়াত প্রিয়জনদের মাজার নির্মাণ করেন।
মোঘল সাম্রাজ্যে কোন অবাধ্য প্রজার স্থান ছিল না। সে সাম্রাজ্যে সম্রাটের আদেশই ছিল আইন। সেখানে সম্রাট চাইলেই দণ্ডিতের শাস্তি মাফ করতে পারতেন, আবার যে কাউকে যে কোন অপরাধে নিজের ইচ্ছামত যে কোন দণ্ড দিতে পারতেন,দণ্ড পরিবর্তন করে দিতে পারেন। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রপতিও অনেক দণ্ড মাফ করে মোঘল সম্রাটদের দেখানো পথে হেঁটেছেন। আবার কাদের মোল্লার দণ্ড পরিবর্তন হওয়ায় মোঘলদের রেখে যাওয়া ধারাবাহিকতার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। অবাধ্য দুষ্ট লেখক মাহমুদুর রহমান যথার্থই কারাবরণ করেছেন।
মোঘল সাম্রাজ্যে কোন বাদশাহ নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে একজন সিংহাসন অলংকৃত করতেন। আশা করি আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এটি ব্যাখা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
সবশেষে, নিন্দুকেরা যাই বলুক, আমি কিন্ত একজন বাধ্য প্রজা। আমি কেবল বলি- ” মহামান্য সম্রাজ্ঞীর জয় হোক “।