কারাগার থেকে বের হয়ে বিএনপি নেতারা প্রথমে ছুটে যান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। ইদানীংকালে টেলিভিশনে বিএনপি নেতাদের জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিতে বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে। এর অবশ্য একটা ব্যাখ্যা হলো- আওয়ামী লীগ দ্বারা বিএনপি নেতাদের গ্রেফতারের হার নজিরবিহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার সুবাদে জামিনে মুক্তির সংখ্যাও বেড়েছে। আর সেকারণে জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। ঘটনার সংখ্যা বাড়লেও টেলিভিশনের ক্যামেরায় দৃশ্যটি কমবেশি একই রকম দেখা যায়। যিনি বা যারা মুক্তি পেয়েছেন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা দলবেধে মরহুম জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারতে যান। ফুল দেন। তারপর ক্যামেরার সামনে কথা বলেন। সমসাময়িক কোন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন।
প্রশ্ন হলো ৭৫ উত্তরকালে রাজনীতি যখন টালমাটাল, দেশের সেই ক্রান্তিলগ্নে হালধারণকারী একদার রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান কবর থেকে কিভাবে জীবিত নেতাদের সহায়তা করবেন? কারণ জিয়াউর রহমানের আদর্শকে তারা সঠিকভাবে ধারণ করেন কিনা সেটা যথেষ্ট অস্পষ্ট। তাদের চাল চলন, কথা বার্তা, নেতৃত্ব কোন কিছুতেই জিয়াউর রহমানের কাজের ধারাবাহিকতা তেমনভাবে সুস্পষ্ট নয়। দলীয়ভাবে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করা ছাড়া এখন নতুন কিছু উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের যুগান্তকরী অসমাপ্ত পদক্ষেপ খাল কাটা কর্মসূচি কিংবা উন্নয়ন চিন্তার ধারাবাহিকতা জিয়া উত্তর বিএনপিতে তেমনভাবে দেখা যায় না। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব জিয়ার রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো নিয়ে লেখাপড়াটা পর্যন্ত করেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। জিয়াকে নিয়ে বরং লেখাপড়াটা বেশি করে আওয়ামী লীগ। যেকারণে বিএনপিকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটা তারা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে ঠিক করে নিতে পারছে। এছাড়াও অন্তত আওয়ামী লীগের একজন জাদরেল নেতা জিয়ার দূরদর্শী খাল কাটা কর্মসূচি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেছে বলে শোনা যায়। নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন যে, সেটা জিয়াউর রহমানকে ভালোবেসে নয় বরং নিজের আখের গোছাতেই সে জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচি বেছে নিয়েছিল।
উল্টোদিকে, আজকে নদী তীরবর্তী শহরগুলোতে বসবাসকারী আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে নদী ভরাট করে দখল করছে সেটা নিয়ে বিএনপির কোন গবেষণাধর্মী রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখা যায় না। দেশের নদীকে সচল করতে এবং মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে জিয়াউর রহমান যে খালকাটা কর্মসূচি চালু করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় বিএনপি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং পরবর্তীকালে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। তারা সেই সুযোগ কাজে লাগায়নি।
নদী বাংলাদেশের প্রাণ। বিশ্বের কোন দেশে নদীকে মরতে দেয়া হয় না। ইংল্যান্ডে এখনো শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান খালগুলোকে সচল করার জন্য কাজ চলে। আর আমাদের ঢাকা মহানগরীর খালগুলোকে দখল আর ভরাট করে আমরা একটি নোংরা আবর্জনাময় শহর তৈরি করছি। যারা জিয়ার কবরে ফুল দিতে যান তারা এর কি জবাব দেবেন? ক্ষমতায় তো তারাও ছিলেন। ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারা এবং বর্ষার পানি ধরে রাখার জন্য তারা নদ-নদী খাল বিলকে কেন উপযুক্ত করে গড়ে তোলেননি সেই জবাব কি দেবেন? ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড মোকাবেলায় খালগুলো হতে পারত একটি বড় সহায়ক শক্তি। দেশের মানুষের চলাচল এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নদীপথ যে ভূমিকা নিতে পারত সে ব্যাপারে জিয়ার কবরে ফুল দেয়া মানুষগুলো কি কিছু করেছেন, যেটা জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন?
বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান কখনো শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অস্বীকার করেননি। শেখ মুজিবও জিয়াকে পছন্দ করতেন। সেক্টর কমান্ডার জলিলকে বীর উত্তম খেতাব থেকে বঞ্চিত করলেও জিয়াকে করেননি। আর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে সবসময়ই লড়াই করেছেন। সেটা ১৯৭১ সালে। এমনকি ১৯৭৬ সালেও। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্বৃত্তি দিয়েই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুরের ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ধারাবাহিকতায় দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছিলেন। বলা যায় অকাল মৃত্যুর শিকার শেখ মুজিবুরে যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন জিয়া। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনীতিকদের সীমাহীন দুর্নীতি ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় শেখ মুজিব রাজনীতিকদের ব্যাপারে খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি তৎকালীন নেতাদের চোর বলতেন। শেখ মুজিব রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ায় খুবই রুষ্ট ছিলেন, সেটা তার সেসময়কার বক্তৃতাগুলো শুনলেই জানা যায়। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতার দায়িত্ব নেয়ার পর তার সততা ও নেতৃত্ব দিয়ে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠনে ব্রতী হওয়ার পথে সকলকে তারই মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিতে সেই ধারা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন যেখানে নেতা শুধুমাত্র অন্যকে সৎ হতে বলবে না বরং নিজেও সকল সময় সততার চর্চা করবে। তিনি আশা করেছিলেন শেখ মুজিব যাদের উপর রুষ্ট ছিলেন সেইসব দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ সোজা পথে আসবে। যেকারণে তিনি শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া না দেয়া দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দি পলিটিশিয়ানস’; স্বাধীনতার পরপরই সীমাহীন দুর্নীতি চর্চাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া রাজনীতিকদের শুদ্ধ পথে আনার আগেই তাকে চলে যেতে হয়েছে।
ব্যক্তিগত সততা ও নিষ্ঠা এবং দেশের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য দেখাতে পারলেও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি। বরং তিনি তার পূর্বসূরি নেতা শেখ মুজিবের মতোই আততায়ীদের হাতে নিহত হলেন। শেখ মুজিব যে কম্বল চোরদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেই কম্বল চোরদের জন্য রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করার আগেই এবং সর্বোপরি একদল দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ তৈরির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারা তৈরির আগেই তাকে মেরে দেয় সেই সব দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা। তার গড়া বিএনপিতে সেই নেতৃত্ব আর পাওয়া যায়নি যিনি ও যারা তাদের সর্বোচ্চ দেশপ্রেম দিয়ে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের বাধ্য করবেন সৎ ও সুন্দরের পথে আসার জন্য।
সেকারণেই প্রশ্ন হলো- কবরবাসী জিয়া কি ফুল চান নাকি অন্য কিছু? শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কবরে ফুল দেয়াটা একটা গৌণ কাজমাত্র। ফুল পেয়ে মৃত মানুষ খুশি হন কিনা আজতক জানা যায়নি। কখনো জানা যাবেও না। তবে কমনসেন্স থেকে বোঝা যায় যে, কবরে ফুলের চেয়ে মৃত আত্মা বেশি তৃপ্তি পেতে পারেন যদি দেখেন যে, তার আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে।