খন্দকার রাক্বীব
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিনির্মাণে যে জাতীয়তাবাদী আর সেকিউলার ঢোপ গিলানো হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী। কেননা, ইতিহাসের লক্ষণ হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিতের বিচার। যার শুরু বর্তমান উত্থাপিত প্রশ্নের মীমাংসার সূত্র ধরেই। বর্তমান থেকে অতীতে যাওয়া তখনই, যখন অতীত সম্পর্ক অতীত পরিপ্রেক্ষিত – বর্তমান সম্পর্ক বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতকে ব্যাখ্যা করে। যা নির্মাণ করে ধারাবাহিকতা আর নির্দেশ করে ভবিষ্যতের। তাই বলা চলে, ইতিহাস হলো পরিপ্রেক্ষিতায়ন। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতায়নে ইতিহাসের চেতনা ক্ষমতানিরপেক্ষ বিষয় নয়। কারণ যুগে যুগে ইতিহাসের নির্মাতারা ছিল আধিপত্যবাদী। আধিপত্যবাদীদের তৈয়ার করা ইতিহাস ক্ষমতাধর এলিট শ্রেণীদের ভাবাদর্শিক বৈধতা-ই উৎপাদন করে। প্রান্তিক আর মজলুম মানুষদের অস্তিত্ব, তার চেতনা আর প্রতিরোধ সব-ই মুছে যায় বিদ্ব্যত সমাজের বয়ানে।
ইতিহাস চর্চায় এইভাবে আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সাব-অল্টার্নদের আড়াল করার অপচেষ্টাকে প্রথম নতুন উসুল তথা তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড় করান রণজিৎ গুহ। ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে তিনি দেখেন এখানকার ইতিহাস বিনির্মাণকালে নিম্নবর্গদের কিভাবে আড়াল করা হয়েছে। ‘on some aspects of the historiography of colonial india’ এবং ‘elemaentary aspects of peasant insurgency in colonial india’ নামক দু’টি গবেষণাকর্মে তিনি দেখান- ভারতবর্ষে আধুনিক ইতিহাসচর্চার শুরু হয় ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন থেকে নয়, বরং ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা থেকে। রনজিতের অভিমত, ইংরেজরা পাশ্চাত্য শিক্ষার আদলে আমাদের দিক্ষিত করতে ইতিহাস বিদ্যার আমদানি ঘটায়নি, ভারতবর্ষের ইতিহাস ইংরেজ শাসনের হাতিয়ার হয়েছে আরও আগে। যখন ইংরেজরা দেওয়ানি লাভ করে তখন তারা তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে এখানকার স্থানীয় ভূ-স্বামী আর রাজকর্মচারীদের নিজেদের অনুগত করে ফেলে। ১৮শতকের ব্রিটিশ সমাজের আদর্শ অনুযায়ী, ইংরেজরা বুঝেছিল এখানকার স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী আর ভূস্বামীদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হলেই রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন সমস্যা মিটে যায়। যার ফলে স্থানীয় জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের স্বার্থ ও সুবিধা একই সঙ্গে স্বীকৃতি পায় ঔপোনিবেশিক রাষ্ট্রনীতিতে ও ঔপোনিবেশিক ইতিহাসবিদ্যায়। ফলত ‘ঔপোনিবেশিক উচ্চবর্গ’ আর ‘বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী’দের হাত ধরেই রচিত হয় ভারতবর্ষের ইতিহাস। রণজিতের বক্তব্য “এই ইতিহাস বিদ্যার জন্ম ইংরেজ রাজশক্তির ঔরসে এবং ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই তা ঔপোনিবেশিক শাসনকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠে। যারা এই ধারায় প্রথম ইতিহাস লিখেন তারা সরকারের কর্মচারি কিংবা সরকারের মদদপুষ্ট। তারা যে ইতিহাস লিখেন, তার উদ্দেশ্য হয় সরকারি শাসন ব্যবস্থাকে সিদ্ধ করা কিংবা বেসরকারি রচনা হলেও তার সাহায্যে ব্রিটিশ প্রভুশক্তি ও প্রভু সংস্কৃতিকে আরও জোরদার করা”। আর এদেরই তৈয়ার করা ইতিহাসে এখানকার দরিদ্র কৃষক, মজলুম সিপাহি আর প্রান্তিক মুসলমানদের খুব হীনভাবে আড়াল করা হয়। তাদের আবেগ, অনুভুতি আর প্রতিরোধের ইতিহাস চাপা পড়ে আধিপত্যবাদিদের ক্ষমতার নীচে।
রণজিৎ গুহের এই বয়ানটি উসুল আকারে হাজির করলেই আমরা দেখব, কিভাবে জাতীয়তাবাদী আর সেকিউলার আধিপত্যের সাতকাহনে ইতিহাস কারখানায় প্রান্তজনরা বিতাড়িত হয়েছে। জাতীয়বাদী আর সেকিউলার ঢোপ গিলিয়ে মুন্তাসির মামুন আর শাহরিয়াররা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ চর্চার এজেন্ট বনে গেছে, যাদের বয়ানে এখানকার প্রান্তিক মুসলিমরা থাকে অবহেলিত। হাজার হাজার গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক আর উলেমারা অংশগ্রহণ করে এই যুদ্ধে। কিন্তু জামায়াত ইসলামিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই প্রতিরোধ সংগ্রামকে আজ একেবারেই লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরি’ কিংবা সংকলিত ‘একাত্তরের চিঠি’গুলো পড়লেই বুঝা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ইসলামের সাম্য আর জালিমের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাকে শামিল হয়েছিল। আধিপত্যবাদি সেকিউলার গোষ্ঠী মহান মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের এই সাম্য আর ইনসাফের বয়ানকে আড়াল করে মৌলবাদি ইসলামের জুজু দেখিয়ে রাষ্ট্রকে ডি-ইসলামাইজেশন করছে।
অনুপস্থিত রেখেছে নারীদের লড়াকু প্রতিরোধকে। মুক্তিযোদ্ধার বদলে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দ দিয়ে আড়াল করা হয়েছে বাঙালি নারীদের প্রতিরোধের ইতিহাসকে। ধর্ষিত নারীদের যুদ্ধ শিশুর কথা বলার সাথে সাথেই এই রাষ্ট্রের জাতির জনক কর্তৃক বলা হল ‘এই সব দূষিত রক্তকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দাও (আমি বীরঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইব্রাহিম)।
তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বয়ানে রাষ্ট্রকে মাতৃভূমি বানিয়ে রাষ্ট্র আর নারীকে সমান্তরালে নিয়ে আসে। নারীর ইজ্জত মানেই রাষ্ট্রের ইজ্জত! নারী যখন ধর্ষিত হয়, রাষ্ট্রের নাকি তখন ইজ্জতে কালিমা লাগে। এই কালিমা দূর করতে রাষ্ট্র এই ধর্ষিত নারীকে আর জাতীয়তাবাদী সমাজে মেনে নিতে চায়না! বিচিত্র বয়ান আসে তখন।
‘মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস’ বয়ানের মাধ্যমে আড়াল করা হয় আদিবাসি সাঁওতাল, গারো আর পাহাড়িদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস। চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে চাকমা আর মং রাজার নেতৃত্বে যেভাবে মারমারা যুদ্ধে নেমেছিল, তা আজ ইতিহাসে একরকম উপেক্ষিত। মাঝে মাঝে সামন্তবাদী প্রভুগোষ্ঠী ত্রিদিভ রায়দের উসুল হিসেবে ধরে রাষ্ট্র আদিবাসীদের এই সংগ্রামের বয়ান অন্যদিকে প্রবাহিত করে। সামন্তপ্রভুদের দোষে পুরো নিরীহ জাতিগোষ্ঠীদের রাষ্ট্র ঔপোনিবেশিক কায়দায় উপজাতি বানায়া রাখতে চায়। মানে তাদের কোন জাত নাই…!!
আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের বয়ান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্ন নয়, ঔপোনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক শাসনের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে একটি স্বাধীন রিপাবলিক গঠনের সোচ্চার উচ্চারণ। রুশোর ভাষায় যেটা একটা সামাজিক চুক্তি, এবং যে সামাজিক চুক্তির ভিত্তি হচ্ছে জনগণের সাধারণ ইচ্ছা। স্বাধীন রিপাবলিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের এই সাধারণ ইচ্ছাটি সংজ্ঞায়িত হয় কেমন করে? বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একেবারে গোড়ার গলদটাই হচ্ছে সাধারণের ইচ্ছা ব্যতিরেকে বিশেষের ইচ্ছায় রাজনৈতিক সংস্থা গঠন। আধিপত্যবাদী সেকুলাররাই এই রাষ্ট্রের সাধারণ ইচ্ছাকে সংজ্ঞায়িত করেছে। একটি গণবিপ্লবের পর সমাজে ক্রিয়াশীল গণ সংগঠনগুলোকে বাদ দিয়েই রচিত হয়েছে জনগণের সামাজিক চুক্তির দলিল।, বাংলাদেশের সংবিধান। গন্তন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতিয়তাবাদের লেবেলে এঁটে কেমন করে স্বৈরতন্ত্রী সংবিধান রচনা করা যায়, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের সংবিধান। যেখানে বাঙালি মৌলবাদীরা নিজেদের বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠি বলেনা, কিন্তু অপরকে ঠিক-ই বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। চেপে যেতে চায়, প্রান্তিকদের বয়ান।
raquib_bdf@yahoo.com