‘সেকুলার রাষ্ট্রে’র বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক আবাসিক হল কেন?

আলাউদ্দীন মোহাম্মদ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ধর্মগুরু তৈরির প্রকল্প নিয়ে শুরু হলেও ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডের রেনেসাঁসের  সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সাধারণ্যের, বিশেষত উচ্চবিত্তের কাতারে নামতে থাকে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার সূচিকাগার ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত আদিতে ধর্মযাজকদের শিক্ষার কলেজ ছিল। ব্রিটিশেরও পূর্বে  ‘হোলি রোমান সাম্রাজ্যে’ ১০৮৮ সালে যাজক বানানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়। তার পূর্বে আফ্রিকার মিশরে ৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল ইসলামী ধর্মচর্চার কেন্দ্র। আর  প্রাচীণ ভারতের নালন্দায় খ্রিস্টপূর্ব ১০ শতকে (সম্ভবত) প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশিলাও ছিল বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুদের জ্ঞানচর্চার বিহার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সাধারণ্যের কাতারে নামার সাথে সাথে এবং ‘এনলাইটেনমেন্টে’র প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শনও বিবর্তিত হয়ে এক বিশ্ববোধের চেতনায় উন্নীত হয়। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা তাই আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার এক অনিবার্য অংশ।

HJH1

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেভাবে বড় গলায় নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বাতিঘর হিসেবে দাবী করে থাকেন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সূতিকাগার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করে থাকেন সেখানে ভাবতে অবাক লাগে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক (অপ)সংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে। পৃথিবীর মূলধারার কোন বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বাংলাদেশের গণবিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত মুসলিম বনাম অন্যান্য সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভেদসহ আলাদা আবাসিক হলের কোন নজির নেই। স্বভাবতই তাই প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের মত অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে এ সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হতে পারে এবং একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠণের ব্যার্থতার দায় এ বিশ্ববিদ্যালয় এড়াতে পারে কিনা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের দায় নিয়ে। যেহেতু লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করে ফেলেছিল এবং এই ভাগ করার বিরুদ্ধে কলকাতাকেন্দ্রিক জমিদার ও প্রভাবশালী হিন্দুরা তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯১১ সালে  এটিকে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তাই ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ কে সন্তুষ্ট করতেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। এক বাংলায় দুইটি আর্থ-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অখন্ড বাংলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে মর্মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাটিও খুব সহজ ছিল না। আমাদের কবিগুরুও সে দেয়ালের পিলার ছিলেন বলে অনেক কুৎসা আছে। সে যাই হোক, অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন যাত্রা শুরু করল তখন এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উত্থান ঠেকানো এড়ানো না গেলেও তখনকার সামাজিক জাত-বর্ণ প্রথার প্রেক্ষাপটে এটি একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে এর যাত্রা শুরু করতে পারেনি। এর অন্যতম নিদর্শন মুসলিম এবং অমুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আলাদা আবাসিক হলের প্রবর্তন। ব্রিটিশ উপনিবেশের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’নীতির আলোকে সাম্রাজ্য পরিচালনার প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির এ দ্বৈতনীতিও স্বাভাবিকভাবেই উপনিবেশের স্বার্থেই দরকার ছিল!

আর পরবর্তীতে পাকিস্তান যেহেতু একটি ধর্মরাষ্ট্ররূপে কিংবা মুসলমানদের রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানেও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি দেয়াল তৈরি করে রাখা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। কিন্তু যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ধর্মরাষ্ট্রের আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সে বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে এই ধরণের জঘন্য সাম্প্রদায়িক একটা ব্যবস্থা কীভাবে প্রশ্নাতীতভাবে টিকে আছে সেটা এক মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকেই বলে থাকেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি নতুন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন এবং এর সফল বাস্তবায়নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই নেতৃত্ব দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্তও বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্বে এ বিশ্ববিদ্যালয়ই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। এটা সত্য যে রাজনৈতিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিস্তারের কেন্দ্রেই অবস্থান করছে। কিন্তু এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক গড়ণ কীভাবে হচ্ছে তার খবর কি সচরাচর রাখা হয়? শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যখন তার শিক্ষার্থীদের পৃথক পৃথক গোয়ালঘরে ঢুকানো হয় তখন কি তা বিশ্ববিদ্যালয়টির মৌলিক আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করে বসে না? শুধু কি তাই, মোটা দাগে এটি কি রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষকতাই করছে না?

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৬ টি। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের আলাদা করে রাখা হয়। এমনকি আমরা যদি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই সেখানেও দেখতে পাব বিশ্ববিদ্যালয়টির নামের সাথেই একটা সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের সম্পৃক্ততা থাকার পরেও সেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা আবাসনের কোন ব্যবস্থা নেই।

পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও ধর্মীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা বাসস্থানের কোন ব্যবস্থা নেই। ইন্ডিয়ার যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সাথেই ধর্মীয় পরিচয় স্পষ্ট করে দেওয়া আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, জামিয়া মিল্লাহ ইসলামিয়া, বানারাস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি।

উত্তর প্রদেশে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৫ সালে উত্তর ভারতের প্রখ্যাত মুসলিম সমাজ সংস্কারক স্যার সৈয়দ আহমেদের হাত ধরে। মজার ব্যাপার হল বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন একজন হিন্দু রাজা রাজা জয় কিসান দাস।  বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে অধ্যায়ন করছেন প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। ১৯ টি আবাসিক হলের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে হিন্দু-মুসলিম সব বিখ্যাত ব্যক্তির নামেই আবাসিক হল থাকলেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোন হলকে চিহ্নিত করা নেই। দিল্লীর জামিয়া মিল্লাহ ইসলামিয়া এখন ইন্ডিয়ার সেন্ট্রাল মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কাজ করছে। ১৯২০ সালে মাওলানা মুহাম্মদ আলি এবং মাওলানা শওকত আলির নেতৃত্বে  মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম ভাইস চ্যাঞ্চেলর ছিলেন ড.জাকির হোসেন। ৫০ শতাংশ আসন মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বরাদ্দ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে অধ্যয়ন করছেন ১৭ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী।  বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছেলে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা হলের ব্যবস্থা থাকলেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোন আবাসন বৈষম্য নেই। বানারাস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এশিয়ার  অন্যতম বৃহৎ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৬ সালে। দুইটি ক্যাম্পাসে বিস্তৃত বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়তন ১৬ বর্গকিলোমিটার। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০ হাজার শিক্ষার্থী ছড়িয়ে আছে এর ৬০ টি আবাসিক হোস্টেলে। নামে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির আবাসনে ধর্মীয় পরিচয়ের কোন ভূমিকাই নেই।

ইন্ডিয়ার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, পাকিস্তানসহ বিশ্বের আধুনিক রাষ্ট্রের কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের আলাদা আবাসনের নজির নেই। আর অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তো এটা কল্পনারও বাইরে।

যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ধর্মীয় পরিচয়ের বিষয়টি মুখ্য এবং স্পর্শকাতরই হয়ে থাকে তাহলে লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণে কাউকে বঞ্চিত করাও সুস্পষ্টভাবে বৈষম্যমূলক। সে প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের সূত্রে ছেলেদের জন্য আলাদা হলের ব্যবস্থা থাকলেও মেয়েদের জন্য আলাদা কোন হলের ব্যবস্থা নেই। এটি যেন এমন যে, ছেলেদের জাত যাওয়ার ভয় থাকলেও মেয়েদের জাত-পাতের কোন বালাই নেই! এবং একটি রাষ্ট্রের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় যখন এভাবে লিংগীয় বৈষম্যমূলক এবং পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসারে ভূমিকা রাখে তখন রাষ্ট্রযন্ত্রটির আদর্শ নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন দাবী করে।

রাষ্ট্রযন্ত্রটির আদর্শ নিয়ে পূণর্ভাবনা কেন দরকার তার জন্য সামাজিকীকরণের বিষয়টার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। যেমন, ধর্মবিশ্বাস একটি মানসিক প্রক্রিয়া। ধর্মবিশ্বাসের রূপ যখন মানুষের আচরণে ফুটে উঠে তখনই আমরা কেবল জানতে পারি সে কোন ধর্মজাত। একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের বলয়ে যে মানসিকতা গড়ে উঠে সে মানসিকতার কাছে যখনই অন্য ধর্ম-বিশ্বাস এবং জীবনাচরণ প্রকাশ পায় তখনই তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় এবং সে তখন সে বিশ্বাসের প্রতি এক ধরণের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। এই প্রতিক্রিয়া যখন এক ধর্মের অথবা এক সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে হয় তখন আমরা বলি এটা সাম্প্রদায়িক আচরণ। যেহেতু মানুষ গোত্রপ্রথা থেকে বের হয়ে এসে আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বসবাস করতে শুরু করেছে তাই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায় পরিচয়ের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতেই দরকার একটি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। তা না হলে সমাজে সবল দূর্বলের উপর, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর উপর নিপীড়ণ চালাবে। তাই একটি স্থীতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার জন্যই দরকার অসাম্প্রদায়িক নাগরিক এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজচেতনা।

এই অসাম্প্রদায়িক সমাজচেতনার জন্য প্রথমেই যেটি দরকার সেটি হল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে স্বাভাবিক সহাবস্থানের মানসিকতা তৈরি। এই মানসিকতা তৈরি হয় সমাজের বিভিন্নক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সক্রিয়ভাবে নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। আর এই মিথস্ক্রিয়া বাড়লে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং জীবনবোধের কাছাকাছি আসতে পারে। এই কাছাকাছি আসা থেকে তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। আর এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যে সমাজে বিদ্যমান থাকে সে সমাজে সাম্প্রদায়িকতা দানা বাঁধতে পারে না। যেকোন সমাজের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তাই দায়িত্ব হচ্ছে এমন কাঠামো তৈরি করা যেটি নাগরিকদের মধ্যে এই উদার মানসিকতার সৃষ্টি করবে।

আর এই মিথস্ক্রিয়া যেখানে থাকে না সেখানে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়কে এলিয়েন ভাবে এবং নিজেদের অজ্ঞতা থেকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি থেকে এক সম্প্রদায়ের অন্য সম্প্রদায়ের অনুভূতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মানসিকতা তৈরি হয় যা থেকে বিদ্বেষ বাড়ে যেটি অনিবার্যভাবেই সাম্প্রদায়িকতার আঁতুড়ঘর ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’দের আলাদা হলের বরাদ্দ নিয়ে ভাবনাগুলোকে মোটা দাগে চারটি পয়েন্টে ভাগ করা যায়।

প্রথমতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিমদের জন্য রয়েছে এক প্রকার হল এবং মুসলিম ভিন্ন অন্য সব ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে একটি হল। এখানে মুসলিম বনাম অন্যান্য(সংখ্যালঘু) ধর্মের আড়ালে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসীসহ বিভিন্ন ধর্মের স্বতন্ত্র্যতা রক্ষা করা হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভিন্নমতের(ভিন্ন ধর্ম) নূন্যতম অস্তিত্ব না থাকায় তাদের মধ্যে সহাবস্থানের একটি অন্তর্নিহিত চেতনা তৈরি হয় না যেটি তাঁর গণতান্ত্রিক মানসিকতার গঠনকে বাধাগ্রস্ত করে।

তৃতিয়তঃ কিছুদিন পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা রটনা উঠল যে একটি জঙ্গী সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংখ্যালঘু হল’ আক্রমণ করবে। তখন হলটির শিক্ষার্থীগণ নিজেরা এটাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে রাতভর হলটি পাহারা দেয়। তার মানে হলটির ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়টিই তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি যেটি ১৯৭১ সালেও এই পরিচয়ের কারণেই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল।

চতুর্থতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি এই হলটি চালিয়ে রাখার সপক্ষে  পর্যাপ্ত যুক্তি থেকেও থাকে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়ার দায়ভার নেবে কে? বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মত এখানেও পুরোপুরি লিঙ্গবৈষম্যকেই স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে।

এটা মেনে নেওয়া কঠিন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৪৩ বছর বয়স হওয়া স্বত্বেও এই নীতিগত অসামঞ্জস্যটি নিয়ে কেউ শক্তভাবে কথা বলেননি কিংবা বলার সাহস পাননি! এবং এই দুই কারণের কোনটাই কম বিপদজনক নয়। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে নির্বিঘ্নে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িকতার এ মালগাড়ীতেই সওয়ার হয়েছে রাষ্ট্র যেটির গতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে অন্তর্দন্দ্ব। রাষ্ট্রটির কি তার এঞ্জিন নিয়ে ভাবতে শুরু করা উচিত নয়?

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s