যুদ্ধ পূজারীর হাতে জিম্মি স্বাধীনতা

3

By শাফকাত রাব্বী অনীকঃ

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আজকাল আর বেইল নেই। বেইল শুধু যুদ্ধ-পুজারীদের।

যোদ্ধারা যুদ্ধ করে, গুলি চালায়, রক্ত দেয়, জীবন হারায়। মরলে হয় শহীদ, আর বাঁচলে গাজী । সেদিক থেকে যুদ্ধ-পুজারীর ঝক্কি ঝামেলা কম। পুজারীর দল যুদ্ধকালে ধরা দেয়, পালায়; তা না পারলে চুপচাপ সুশীল হয়ে বসে থাকে। কেউ কেউ শত্রুর চাকরিও কন্টিনিউ করে। তারপরে যুদ্ধ শেষে এই পুজারীর দল প্রকৃত যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব-গাঁথা আর রক্তের হিসেব নিকেশ নিয়ে সত্য-মিথ্যা গল্প ফাঁদে। যুদ্ধের পুজা বসায়। যার মন্ডপে যতো লোক, সে হয়ে যায় ততো বড় যুদ্ধ-পুজারী।

উপরের বাস্তবতায়, বন্দুক হাতে যুদ্ধ করা প্রেসিডেন্ট জিয়া আজ হয়ে গেছেন রাজাকার। কাদের সিদ্দিকী জামাতি। আর মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরী রাজনৈতিক দল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি।

অন্য দিকে যুদ্ধকালে পীরের বাড়িতে লুকানো ব্যাক্তি, শত্রু সেনার মুরগি সাপ্লাইকারী, শত্রুর চাকরি-পালনকারী, কিংবা যুদ্ধের পুরোটা সময় পালিয়ে বেড়ানো ব্যাক্তিদের দল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। এই পরিনতির পিছনে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষ ছিল একটাই। তারা যুদ্ধটা ফাটিয়ে করতে পারলেও, যুদ্ধের পুজোটা ভালো দিতে পারেননি।

যোদ্ধা আর পুজারীর কাজের পার্থক্যও বিস্তর। যোদ্ধার কাজ হলো যুদ্ধ করা। একারণে যুদ্ধ শেষ, যোদ্ধার কাজও শেষ। আর পুজারীর কাজ শুরু হয় ঠিক সেখানে, যেখানে যোদ্ধার কাজ হয় শেষ।

যোদ্ধার চোখে যুদ্ধ বড়ই নির্মম, হিংস্র, এবং অমানবিক। যোদ্ধা যুদ্ধকে ভাবে এমন এক বাস্তবতা, যা সে চায় না তার প্রিয় কেউ কখনও দেখুক। অন্যদিকে যুদ্ধ-পুজারীর কাছে যুদ্ধ হলো রূপকথার বীরত্ব-গাঁথা। কিছুটা রসালো ফেইরি টেইলের মতো। এমন কিছু যা বেঁচে খাওয়া যায়। গল্পে বিভোর কোন ফ্রিকের কাছে যুদ্ধ হয়ে যেতে পারে মিস হয়ে যাওয়া, না দেখা এক তামাশা। তাই পূজারিদের কেউ কেউ রিওয়াইন্ড করে সেই তামাশা দেখতে চায়। মানুষকে দেখাতে চায়।

যোদ্ধার কাছে যুদ্ধের সমাপ্তি খুবই কাং্খিত, রিলিভিং। যুদ্ধের সমাপ্তি যোদ্ধার কাছে কোন ভাবেই কম গর্বের কোন বিষয় নয়। পুজারির কেইস এক্ষেত্রে ভিন্ন।পুজারিদের যেহুতু যুদ্ধ ফুদ্ধ করা লাগে না, তাদের চোখে যুদ্ধ যতোবেশী স্থায়ী হবে, পুজোর ব্যাবসা ততোটাই জমবে। গল্প ফান্দার প্লটও বাড়বে।

প্রকৃত যোদ্ধারা যুদ্ধকে এড়িয়ে চলতে চান। নিতান্ত বাধ্য না হলে যুদ্ধের ডাক দেন না। কেননা তিনি জানেন যুদ্ধ কি জিনিস। পুজারিদের কিন্তু এতোটা দায়িত্ববান হবার ঝামেলা নেই। কেননা তারা যুদ্ধ করেন না। একারনে দু’দিন পরপর নতুন নতুন যুদ্ধের হাক-ডাক দিতে পিছ পা হননা যুদ্ধ-পুজারীর দল। যে কাজ নিজে করা লাগে নাই, তার হাওয়া তুলে মানুষকে লাড়িয়ে বেড়ানোর শিশুতোষ আনন্দে তারা বিহ্বল হন।

প্রকৃত যোদ্ধাদের অনেকেই যুদ্ধের গল্প বলতে চাননা। কেননা শত্রুর হাঁতে নিজের সহ-যোদ্ধার মৃত্যু তাকে পিড়া দেয়। আবারএকই ভাবে তার স্মৃতিতে পিড়া দেয় সহযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধ তুলতে গিয়ে নিজের হাঁতে হত্যাকৃত শত্রু সেনার বীভৎস লাশ । একারণে যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা বলেন যে প্রকৃত যোদ্ধার চোখে যুদ্ধ হলো মানব-মনের সবচাইতে পরিত্যাজ্য, অনাকাঙ্ক্ষিত, ভয়াবহ এবং হিংস্র এক বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে প্রকৃত যোদ্ধারা কখনও তাদের ভাগ্যের পরিনতি, কিংবা কখনও দেশপ্রেম বা দায়িত্ববোধের আলোকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেন বাকীটা জীবন।

যুদ্ধ পূজারীরা এখত্রেও অনেক লাকি। তাদের যুদ্ধ বিষয়ক এত্তসব কমপ্লেক্স ফিলিংস নিয়ে বাঁচতে হয়না। প্রকৃত যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা কিংবা শত্রুর হিংসাত্মতার গল্প দাঁত কেলিয়ে, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে পূজা জমানোতেই ব্যাস্ত থাকেন পূজারীর দল । শুধু মুখে মুখে যুদ্ধের গল্প, কবিতা, কাব্য আউড়িয়ে চেতনার ফেনা তুলে যুদ্ধ-পুজোর মন্ডপে লোকের সমাগম বাড়ানোই থাকে পুজারির মূল লক্ষ্য। মন্ডপে লোক জমানোর বিশ্ব রেকর্ড করতে পারলেতো কথাই নেই।

আমি জানি যুদ্ধ-পুজারীদের ভয়ানক ভিড়ে দেশে এখনও বেঁচে আছেন প্রকৃত যোদ্ধার বংশধরেরা। তাদের অনেকেই হয়তো হাসেছেন যুদ্ধ-পুজোরীর কান্ড দেখে। কেননা তারা জানেন, যদি আবার যুদ্ধ লাগে, এই যুদ্ধ-পূজারীর দল তাদের পূর্ব-সুরীর মতোই পীরের আস্তানায় পালাবে, ধরা দেবে, সুশীল থাকবে, না হয় শত্রু-প্রভুর চাকরিটাই কন্টিনিউ করবে।

আবারও যুদ্ধে যাবে তারাই, যাদের পুর্বসুরীরাও যুদ্ধে গিয়েছিল। কেননা যোদ্ধারা হলো একটা বিশেষ জাতের মানুষ। তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যোদ্ধাই থেকে যায়। যোদ্ধার রক্ত যার গায়ে, তাকে আবারো যোদ্ধা হতে আবৃতির আসর কিংবা কোরাস গানের মচ্ছব বসানো লাগে না।

কোনদিন সেই প্রকৃত যোদ্ধারা আবারও জেগে উঠবেন। সেই প্রত্যাশাতেই আছি। সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

 

3 thoughts on “যুদ্ধ পূজারীর হাতে জিম্মি স্বাধীনতা

Leave a Reply to Hossain Md. Ershad Cancel reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s