শাফকাত রাব্বী অনীকঃ
অতীত ও ইতিহাস নির্ভরতা কোন জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক হতে পারেনা। ইতিহাস ও অতীত নিয়ে মারামারি দেশের একটি দল ও তার সমর্থকরা বেশি করলেও, অপর দল ও তার সমর্থকরাও মাঝে মধ্যে খামাখাই যোগ দেন। এই মুহুর্তে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সব চাইতে হট আলোচনার বিষয় হলো বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন।
বিএনপি সাইডের কথা বার্তা শুনে যা বুঝলাম, জিয়াউর রহমান সাহেবকে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ডিক্লেয়ার করার আগে নাকি বেশ কিছু সংবিধান বিশেষজ্ঞর পরামরর্শ নেয়া হয়েছিল। তারা গ্রিন সিগনাল দেবার পরেই এই ঘোষণা লন্ডন থেকে এসেছে। ঘটনা সত্য হলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রথম প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে এমন বিশেষজ্ঞ কতজন আছেন যারা আওয়ামী কিংবা বিএনপির সর্বোচ্চ নেতাদের মুখের উপর বস্তুনিষ্ঠ অপিনিয়ন দিতে পারেন? যেমন ধরুন, যদি শেখ হাসিনা দেশের শীর্ষ ১০ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞকে ডেকে বলেন, “দেখুনতো আমার আব্বাকে সংবিধানের আলোকে এক্স-ওয়াই-জেড টাইটেল দেয়া যায় কিনা?” আমার ধারণা এই আবদার শোনা মাত্র বিশেষজ্ঞের দল সমস্বরে বলে উঠবেন, ” অবশ্যই যায়, আলবত যায়, যাবে না কেন? বরং আমরাতো লজ্জিত এটা ভেবে যে এই ব্যাপারটি আপনার মতো আমাদের মাথায় এতো দিন এলো না কেন!! আপনি একজন জিনিয়াস, একে বারে বাবার মতোন”।
উপরের বাস্তবতা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে বেশী প্রযোজ্য হলেও, বিএনপির বিশেষজ্ঞরাও কতটা সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে।
এবার আসা যাক বিশেষজ্ঞ মহলের মূল যুক্তির দিকে। যতদূর বুঝেছি, বিশেষজ্ঞদের যুক্তির তিনটি মূল স্তম্ভ রয়েছে। প্রথমত, জিয়াউর রহমান সাহেব তার প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণায় বলেছিলেন যে তিনি নিজের হাতে কমান্ড তুলে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালের মার্চের ২৬ তারিখ থেকে শুরু করে এপ্রিল এর মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে কিংবা প্রবাসে স্থাপিত কোন সরকার ছিল না। সুতরাং, জিয়া সাহেবের প্রথম ঘোষণা অনুযায়ী তিনিই প্রথম সরকার প্রধান। তৃতীয়ত, যেহুতু সরকার প্রধানই কেবল মাত্র যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন, সেহুতু জিয়া সাহেব উপরের প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সরকার প্রধান বা প্রেসিডেন্ট হিসেবেই।
উপরের যুক্তিগুলো নিয়ে যুক্তি খন্ডন করার কাজটি ভালো করতে পারবেন উভয় দলের বিশেষজ্ঞরা। আমি লে-ম্যান হিসেবে যুক্তি খন্ডনে যাবো না। জাতীয়তবাদী ভাবধারা ও দল হিসেবে বিএনপির সমর্থক হিসেবে, আমি তর্কের খাতিরে ধরেও নিতে রাজী আছি যে উপরের যুক্তিগুলো সঠিক। কিন্তু তার পরেও বেশ কিছু কথা বলা উচিত, চুপ না থেকে।
আমার মতে, উপরের প্রতিটি যুক্তিগুলোকে বলা যেতে পারে টেকনিকাল, আইনী কিংবা আমলাতান্ত্রিক। জিয়াউর রহমান সাহেবের যে ইমেজ দেশের হাজারো মানুষের মনে এখনও বেঁচে আছে, তা এই সব আমলাতান্ত্রিক কিংবা টেকনিকাল যুক্তিলব্ধ টাইটেল-ফাইটেল এর ধার ধারার কথা না।
জিয়া সাহেব দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, নাকি প্রথম ফিল্ড মার্শাল ছিলেন, স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক ছিলেন নাকি দ্বিতীয় ঘোষক ছিলেন সেগুলোও টেকনিকাল আলোচনা। এগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন তারা, যারা ইতিহাসকে “ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্পিং ডিসিশন” এর মতো কিছু একটা ভাবেন। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের কাছে, বিশেষ করে যারা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন, কিংবা জীবিত ছিলেন, তাদের চোখে জিয়াউর রহমান হলেন সেই ব্যাক্তি যার যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব, রেডিওতে ভেসে আসা ঘোষণা মানুষ নিজের কানে শুনেছে, চোখে দেখেছে। থার্ড আম্পেয়ারের স্ক্রিনে দেখেনি।
২৬ এ মার্চের গণহত্যার রাতে দেশের তৎকালীন শীর্ষ রাজনৈতিক মহলের সবাই যার যার জান হাঁতে নিয়ে, যে যে দিকে পেরেছেন পালিয়েছিলেন। সেই রাত্রে যেই ইয়াং ছেলেটি পুরা দেশের মানুষের মনের কথা, নিজ দায়িত্বে, শুরুতে নিজের নামে, পরবর্তিতে একজন স্বেচ্ছায় ধরা খাওয়া শীর্ষ নেতার নামে রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই ইয়াং ছেলেটি ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাকে কি নামে, কি উপাধিতে ডাকা হবে, তা নিয়ে গ্যালারির দর্শকেরা চিল্লা চিল্লি করতে পারে। তাতে জিয়ার ইমেজ বাড়া কিংবা কমার কথা না।
২৬ শে মার্চে জিয়া সাহেবের কিন্তু একটা ব্যক্তিগত স্টোরীও ছিল। তিনি কোন বিপ্লবী-বিবাগী ছিলেন না। তিনি সংসারী ছিলেন। তার ছোট্ট ছেলে ছিল, তার বউ ছিল। ২৬ সে মার্চের সেই রাতে তিনি যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, “উই রিভোল্ট” তখন তার নিশ্চয়ই ভয় হয়েছিল যে তার সেই সংসার, তার সেই ছোট্ট ছেলেকে আর কোনদিন না দেখার। আপনি জিয়াকে মহান না ভাবতে পারেন, তার নেতৃত্ব না মানতে পারেন, আশা করি যারা সন্তানের জনক তারা অন্তত দেশের জন্যে বাবা হিসেবে জিয়ার মৃত্যু ভয় জয় করতে পারার বিষয়টিকে সাধুবাদ দেবেন। জিয়া একজন বীরের মতো সেই ভয় জয় করেছিলেন, শত্রুর আঘাতের প্রথম রাত্রেই। তিনি ওয়েট এন্ড সি পলিসিও নিতে পারতেন। তা না নিয়ে, প্রথম রাত্রেই প্রত্যাঘাতের কাজ শুরু করেছিলেন। একারণে বলতে হবে, জিয়া শুধু মাত্র একজন অসাধারণ সাহসী যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি যোদ্ধা। এটাই ওনার সব চাইতে বড় পরিচয়। উনি কবে জেনেরাল ছিলেন, কবে মেজর ছিলেন, সেগুলো টাইটেল মাত্র।
বিএনপির যেই বিশেষজ্ঞরা তারেক রহমান বা খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন, তাদের জন্যে একটা ছোট্ট পরামর্শ। আপনারা যদি জিয়া সাহেবকে শেখ মুজিব সাহেবের সাথে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতাতে নামাতেই চান, তাহলে শুধু একটা বিষয়কে হাই লাইট করুন। সেটি হলো, এই ব্যাক্তিদ্বয়ের একজন ছিলেন আঘাতের রাত্রে স্বেচ্ছায় ধরা খাওয়া, আর একজন ছিলেন যুদ্ধ শুরু করে দেয়া মানুষ। এই ছোট্ট সিম্পল সত্যটি বেশী করে হাইলাইট করুন। এই কাজে আপনাদের কোন টেকনিকাল বা আমলাতান্ত্রিক যুক্তির প্রয়োজন হবে না। শিশু থেকে শুরু করে সংবিধান বিশেষজ্ঞও এক বাক্যে এই কম্পারিজন বুঝতে পারবেন।
জিয়ার মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, হেড কাউন্টে বাংলাদেশের সব চাইতে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ও একজন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর কমান্ডারের আর নতুন কোন টাইটেল লাগার কথা না, আইন কানুণে যাই থাকুক না কেন।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সবচেয়ে সময় উপযোগী পদক্ষেপ কি হতে পারত? সেই পদক্ষেপ গুলোর একটি লিস্ট করলে “জিয়াউর রহমান” কে প্রথম প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা লিস্টের কত নম্বর পদে থাকত??
হয় সেলুকাস! হয় বিএনপি!! বড় বিচিত্র এ দেশ!!
“জাতীয়তবাদী ভাবধারা ও দল হিসেবে বিএনপির সমর্থক” দের একটা সাধারণ মিসকনসেপশণ হলো যুদ্ধকে ২৭শে মার্চ থেকে শুরু করানো । আগামী কাল যদি একজন মেজর হটাত করে বাংলাদেশ বেতার থেকে কোন একট বিভাগ কে স্বাধীন ঘোষণা করেন তাহলে সেই বিভাগের জনগনের reaction কি হতে পারে? মেজর জিয়ার ঘোষণা সাধারণ মানুষের মনে যে রিয়্যাকশন এর জন্ম দিয়েছিল তার সাথে এই reaction তফাত কি?? একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে উত্তর দিন। বছরের পর বছর আন্দোলন সংগ্রাম করে একটি জাতিকে যুদ্ধের জন্য মানসিক ভাবে কে এবং কারা প্রস্তুত করেছিল ??
“আঘাতের রাত্রে স্বেচ্ছায় ধরা খাওয়া” কি বঙ্গবন্ধুর সঠিক চিত্রায়ন হতে পারে? স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুর শাসনআমল আলাদা টপিক হতে পারে। এখানেই বাশেরকেল্লা’র সাথে নুরালদিনের গুণগত পার্থক্য চাই।
ধন্যবাদ।
http://www.nipunservices.com/apps/blog/show/42025936-shafkat-rabbi-onik
Reblogged this on rokib14.