সোনার বাংলা

by  কালের সিপাহি

কয়েকদিন আগেই কুয়ালালামপুর থেকে দেশে ফিরছিলাম। সঙ্গী হিসেবে আমার স্ত্রী। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে আরাম করে কিন্তু ভয়ে ভয়ে বসেছি মাত্র। পাশে চোখ গেল। দু’জন খুবই সাদাসিদা রকমের মানুষ। তাঁদের একজন অনেক বয়ষ্ক, পাজামা-পাঞ্চাবী পরা। মনে হচ্ছে, ঠিক মত নিজের পাজামাও বাঁধতে পারেনা। আরেকজনের বয়স ৪৫-এর আশেপাশে হবে। দু’জন অতি পরিচিতের মত কথা বলছেন। কিছুক্ষন পরে দেখলাম, বৃদ্ধ মানুষটির কোলে ছোট ছোট অনেক স্বর্নের গহনা! এত গহনা স্বর্নের দোকান ছাড়া আমি আর কোথাও দেখিনি। এত স্বর্ন দেখে আমি-আমার স্ত্রী দু’জনই তাজ্জব বনে গেলাম।

দুইজনই খুব আরামসে গহনা খুলে দেখে দেখে আমার প্যাকেটে নিয়ে জায়গামত রাখছেন। কম বয়ষ্কজন রাখছেন না, বরং কেমন ধরনের একটা প্যাকেটে করে বৃদ্ধ মানুষটার পাজামার ভিতরে নিরাপদে রাখলেন। বুঝলাম, বৃদ্ধ মানুষটাকে হয়তো আনাই হয়েছে এই কাজ করানোর জন্য। ঘটনাটা হয়তো অনেকের কাছেই খুব ছোট্ট মনে হবে, কিন্তু সেই মুহুর্তে সেই দুইজন মানুষ পোশাকআশাক এবং স্বর্নের পরিমান দেখে আমি এবং আমার স্ত্রী একদম বোকা বনে গিয়েছিলাম।

গত কয়েকমাস ধরেই সংবাদে দেখছি, এখানে সেখানে স্বর্ন চোরাচালানী ধরা হচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, গত ৩-৪ মাসে কম পক্ষে ৭০০-৮০০ কেজি স্বর্ন ধরা পড়ার নিউজ পড়েছি। বিশেষ করে, ঢাকা বিমানবন্দরে। তারপর দেখি, এখন রাস্তাঘাটেও স্বর্ন চোরাচালান ধরা খাচ্ছে। বিশেষ করে, যখন থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশি রকমের বেড়ে গিয়েছিল, তখন থেকে এটা শুরু হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, দেশের স্বর্ন ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে টুকটাক স্বর্ন চোরাচালানী করছে। কিন্তু দিনদিন এর পরিমান বাড়তেই থাকাতে অন্য কারন নিয়ে চিন্তা না করে পারা যায়নি। যে আইন-শৃংখলা বাহিনী এই চোরাচালানী রোধ করবে, এখন তারাই কিনা স্বর্ন নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করেছে।

প্রশ্ন হল, হঠাৎ করে দেশে এই স্বর্ন বর্ষনের কারন কি?

তাহলে কি দেশে কোন কারনে স্বর্নের চাহিদা বেড়ে গেছে? মানুষের আয় কি খুব বেড়ে গেছে, যে কারনে মানুষ স্বর্ন মজুদের দিকে ঝুঁকছে? তাতো হওয়ার কথা না। অর্থনীতির অবস্থাতো অনেক দিন ধরেই তথৈবচ।

তাহলে কি মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার বাজে হাল দেখে সঞ্চয় কিংবা বিনিয়োগের আর কোন নিরাপদ মাধ্যম না পেয়ে স্বর্ন জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তা কি করে হয়? দেশে যে হারে ডাকাতি-রাহাজানি হচ্ছে, নিরাপদে স্বর্ন রক্ষিত করা যাবে, তার তো কোন নিশ্চয়তা নাই।

তাহলে কি ভবিষ্যতে স্বর্ন দাম বাড়তে পারে, এমন কোন খবর আছে, যে কারনে মানুষ এখন স্বর্ন কিনে রাখছে? না, দেশে বা বিদেশের গনমাধ্যমে সেরকম তো কোন খবর নেই।

কে যেন কিছুদিন আগে একটা নিউজ জানালো। ভারতের সরকার নাকি স্বর্নের উপর ট্যারিফ বাড়িয়েছে। আমি নিজেও পরে খোঁজ নিলাম। খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল, তা অনেকটা এরকমঃ পেট্রোলিয়ামের পর স্বর্ন হচ্ছে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানী পন্য। অর্থাৎ স্বর্ন আমদানীর জন্য ভারতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডলার খরচ করতে হয়। আমরা অনেকেই হয়তো জানি, কিছুদিন থেকেই ভারতকে চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারনে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তাই চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে ভারত সরকার স্বর্ন আমদানী নিরুৎসাহিত করতে স্বর্ন আমদানীর উপর ট্যারিফ বসাচ্ছে। দয়া করে নিচের লিঙ্কগুলো পড়বেন, তাহলে পরিষ্কার হওয়া যাবে।
(http://timesofindia.indiatimes.com/business/india-business/Govt-raises-golds-import-tariff-value/articleshow/32130381.cms)
(http://online.wsj.com/news/articles/SB10001424127887324665604579080961422779936)
(http://www.bloomberg.com/news/2014-03-27/gold-shipments-into-india-seen-rebounding-by-billionaire-jeweler.html)

প্রশ্ন হলঃ ভারতের স্বর্ন আমদানীর উপর ট্যারিফ বাড়ানোর সঙ্গে আমাদের স্বর্ন চোরাচালানীর কি সম্পর্ক?

বৈশ্বিক স্বর্নের অন্যতম প্রধান বাজারগুলোর মধ্যে দুবাই, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক এবং কুয়ালালামপুর। আবার, ভারত হচ্ছে স্বর্ন সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ভারতে সরকার যেমন স্বর্ন ক্রয় করে, তেমনি বেসরকারী পর্যায়েও অন্য যেকোন দেশের তুলনায় বেশী হারে স্বর্ন ক্রয় হয়ে থাকে।

ঢাকা ট্রিবিউনের নিচের লেখা থেকে এটা পরিষ্কার যে, দেশে জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৩ তে যে পরিমান চোরাচালানীর চালান ধরা হয়েছে, তার ৮৬% ছিল স্বর্নের। মূল্যের হিসেবে গননা করলে পরিস্থিতি আরো খারাপ। দেখা যায়, একই সময়ে যে পরিমান চোরাচালানী পন্য ধরা হয়েছে, তার ৯৫% হচ্ছে স্বর্ন চোরাচালানী। হিসেবে দেখা যায়, ২০১৩ সালে শেষের ছয় মাসে সে পরিমান স্বর্ন ধরা হয়েছে, তার মূল্য ২৫১ কোটি টাকার মত। ঢাকা ট্রিবিউনের লেখা থেকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খবর যেটা পাওয়া যায়, তা হলঃ যে পরিমান স্বর্ন চোরাচালান হয়, তার মাত্র ১-২% ধরা যায়, বাকিরা যেকোন ভাবেই পার পেয়ে যায়! এই হিসেব থেকে বলা যায়, ২০১৩ সালে শেষের ছয় মাসে প্রায় ১২,৫০০ কোটি থেকে ২৫,০০০ কোটি টাকার স্বর্ন চোরাচালান হয়েছে! আপনি কি একটু ভাবতে পারেন?
http://www.dhakatribune.com/crime/2014/apr/02/smuggled-gold-accounts-86-all-contraband

কিছু মৌলিক প্রশ্ন এখান থেকে করা যায়। এক, ভারতের স্বর্নকারবারীরা বাংলাদেশকে কতটা নিরাপদ মনে করলে এই বিশাল পরিমান স্বর্ন চোরাচালান করার জন্য বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিরাপদ রূট মনে করে। আমরা কি মনে করব, এরা কোন ধরনের সরকারী আশ্বাস ছাড়াই এত বড় একটা ঝুঁকি নিচ্ছে? এটাতো কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য না।

দুই, কি ধরনের শিথিল ইমিগ্রেশন নিয়ম থাকলে আন্তর্জাতিক চোরাচালানীরা এই ধরনের কাজে উৎসাহী হতে পারে? এই বিশাল পরিমানের চোরাচালান বাংলাদেশের বিমানবন্দর দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে আসে, তেমনি দেশের ভূমি সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হয়। তার মানে কত বিশাল পরিমান এবং শক্তিশালী চক্র এর সঙ্গে জড়িত থাকলে এমন একটা কাজ করা সম্ভব। আমরা কি মনে করব, কোন রকম সরকারী সাহায্য ছাড়াই এরা নির্বিঘ্নে এমন একটা কাজ করতে পারছে?

ভারতের স্বর্ন ব্যবসায়ী এবং চোরাচালানীদের কাছে আমার একটা সরল প্রশ্নঃ কেন ভাই নিজেদের ঝামেলা আমাদের ঘাড়ে এসে ফেলেন? ভারতের জন্য বাংলাদেশের মানুষ আর কত ত্যাগ স্বীকার করবে? ভারতকে বৈধ পন্যের যাতায়াতের জন্য আমরা আমাদের ভুমি উন্মুক্ত করে দিয়েছি, এখন আবার অবৈধ পন্যের জন্যও তাই করতে হচ্ছে? বাংলাদেশ যেখানে একটা শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে দেশকে চোরাচালানীর এক স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলছি? কারা এটা করছে, এবং কাদের স্বার্থে এসব হচ্ছে? 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s