সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সরকার: এদেশ – ওদেশ

1

শিবলী সোহায়েল

 

মোবাইলটা বেজে উঠতেই রিমি ফোন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবল কোন ওভারসিস কল হবে। ফোনটা রিসিভ করেই বুঝল ঠিকই ধরেছে, রাজিতের কল। গাল ভরা হাসি নিয়ে রিমি বলল, কি খবর? অনেক দিন পর?

– হ্যাঁ অনেকদিন পর। আজ এখানে অস্ট্রেলিয়ায় হারমনি ডে মানে সম্প্রীতি দিবস তো তাই সম্প্রীতি বজায় রাখতে সব বন্ধুদের ফোন করে খবরাখবর নিচ্ছি।

– ও তাই? তো তোমাদের এই সম্প্রীতি দিবস টা কি? প্রশ্নটা করেই রিমি ভাবল এবার শুরু হবে রাজিতের তত্ত্ব কথা। শুনতে অবশ্য খারাপ লাগেনা। জানা যায় বেশ কিছু আর নিজের ভাবনাগুলোও শেয়ার করা যায়।

রাজিত সোৎসাহে শুরু করল, প্রেমপ্রীতি ছাড়া যেমন সংসার টেকে না, তেমনি সম্প্রীতি ছাড়াও দেশ টেকে না। অস্ট্রেলিয়া তাই প্রতি বছর ২১ শে মার্চ পালন করে সম্প্রীতি দিবস। আদিবাসীরা ছাড়াও এখানে বসবাস করে পৃথিবীর কোনা-কাঞ্চি থেকে উড়ে আসা, ভেসে আসা হাজার ধর্মের, হাজার বর্ণের, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরা। ভিন্নতা সত্ত্বেও সবাই যেন একে অপরকে শ্রদ্ধা করে মিলেমিশে থাকে সেটাই উদ্দেশ্য। এই দিন বাচ্চারা সবাই নিজ নিজ সংস্কৃতি অথবা ধর্মীয় পরিচয় বহন করে এমন পোশাক পড়ে স্কুলে যায় আর একসাথে গান ধরে-

“উই আর ওয়ান বাট উই আর মেনি

এন্ড ফ্রম অল দি ল্যান্ডস অন আর্থ উই কাম

উই শেয়ার এ ড্রিম এন্ড সিং উইথ ওয়ান ভয়েস

আই এম, ইউ আর, উই আর অস্ট্রেলিয়ান…”

আমার সাত বছরের মেয়েটাও যাচ্ছে টুকটুকে লাল শাড়ী পড়ে। তাও আবার কুঁচি দিয়ে না, ঐ যে গ্রামের মেয়েরা যেমন করে পড়েনা সেই রকম। ফুটফুটে লাগছে…

রাজিতের উৎসাহী কণ্ঠে তাল মিলিয়ে রিমি বলল, মজার তো। তোমাদের ওখানে তাহলে তো দেখছি সম্প্রীতিতে ভরপুর। কোন ক্যাচাল, কোন ঝগড়া-লড়াই নেই একদম?

– একেবারে যে নেই তা না। শতভাগ পারফেক্ট বলে কি দুনিয়ায় কিছু আছে? কোথাও কম কোথাও বেশী, এই যা। মানুষের কাজ হচ্ছে এই ক্যাচালগুলোকে কমিয়ে রাখা, ঝামেলাবাজদের দমিয়ে রাখা। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে সরকার।

– সরকারের ভূমিকা? সে আবার কি রকম? আমাদের বাংলাদেশে তো এখন সরকারই ইস্যু তৈরি করছে, বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে এমনকি ঢালিউডের সিনেমার কাহিনীও তৈরি করছে ।রেশমা নাটকের কথা তো নিশ্চয় শুনেছ?

রিমির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটু তাত্ত্বিক ভঙ্গিতে বলে চলল রাজিত, সমাজে কিছু কিছু মানুষ থাকবেই যাদের কাজ হচ্ছে বিদ্বেষ ছড়ানো আর উস্কানি দেয়া। মিডিয়ার কাজ হচ্ছে এই উস্কানিকে উৎসাহ না দেওয়া। সরকারের কাজ হচ্ছে সতর্কতার সাথে বিষয়টাকে দমিয়ে দেয়া।

– তাঁর মানে কি ওখানেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্যাচাল লেগে যায়? রিমি জিজ্ঞেস করল।

– ওয়ান্স ইন এ ব্লু মুন। কালে ভদ্রে বলতে পার। যেমন ধর প্রায় বছর আটেক আগে ২০০৫ সালে ঘটেছিল একবার। সিডনীর ক্রনুলা নামে এক জায়গায়। দোষটা মূলত ছিল মাইগ্রেটেড মিডিল-ইস্টার্ন কিছু বখাটেদের। ওরা ক্রনুলা সমুদ্র সৈকতে ভলান্টারি লাইফ সেভার মেয়েদের উত্যক্ত করল। ঘটনার শুরু সেখান থেকেই। মেয়েগুলো ছিল ‘অসি’ (Aussie)।

– অসি?

images (2)

– হ্যাঁ ‘অসি’।কয়েক পুরুষ ধরে বসবাসকারী  ইউরোপিয়ানদেরকেই মূলত এরা ‘অসি’ (Aussie)   বলে। এই ঘটনায় ক্ষেপে গিয়ে এলাকার সব  অসিরা মিডিল-ইস্টার্ন  বখাটেদের শায়েস্তা করতে জোট বেধে রাস্তায় নেমে গেল। কিন্তু কিছু সাম্প্রদায়িক চেতনাবাজ অসিরা এই ক্যাচালকে কাজে লাগিয়ে শ্লোগান তুলল, “উই গ্রিউ হিয়ার, ইউ ফ্লিউ হিয়ার”।মানে হচ্ছে, “আমরা এখানে বেড়ে উঠেছি আর তোমরা এখানে উড়ে এসেছ”।স্লোগানটা বেশ নির্দোষ শোনালেও এখানে ধারাল বিদ্বেষের বিষ আছে। এটা এক নিমিষে জাতীকে বিভক্ত করতে পারে মাইগ্রেন্ট এবং নন-মাইগ্রেন্ট এই দুই ভাগে। এখানকার সরকার জানে যে এই চেতনার জোয়ার প্লাবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে সারা দেশে। আর তাই মোটেও দেরি না করে চেতনাবাজ স্লোগান ধারিদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করলো দুদিনেই। যদিও শুরুটা হয়েছিল মিডিল-ইস্টার্ন বখাটেদের দোষে কিন্তু কিছু সাম্প্রদায়িক চেতনা ব্যবসায়ীদের কারণে মার খেতে হোল বেচারা অসিদেরকেই। এখানে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসা করার মত। ভোট ব্যাঙ্কের পরোয়া না করে সরকার দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্ব পালন করল।

-তো ঐ মিডিল ইস্টার্ন বখাটেদের কিছু হলো না?

-অবশ্যই, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

রিমি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হুম, মনে হচ্ছে বাংলাদেশেও সম্প্রীতি দিবসের আয়োজন করতে হবে, যা শুরু হয়েছে আজকাল। আগে কখনই এর প্রয়োজন হয়নি। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তোমাদের অস্ট্রেলিয়ার চাইতেও ভাল ছিল। তাই দিবস টিবসের কখনো দরকার হয়নি।

– কি বলছ? উপমহাদেশের প্রায় সব কটা দেশেই তো সাম্প্রদায়িক সমস্যা মারাত্মক রকমের। অবাক কণ্ঠে বলল রাজিত।

– তা সত্যি, তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিন্তু যথেষ্ট ভিন্ন। স্বাধীনতার পর থেকে উল্লেখ করার মত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা পাবে মাত্র হাতে গোনা ৪ থেকে ৫ টি। এই ধর ১৯৯০ সালের ঘটনা, ২০১২ সালের রামুর ঘটনা, ২০১৩ সালের নভেম্বরে পাবনা ও বরিশালের ঘটনা এবং ২০১৪-র জানুয়ারিতে যশোরের ঘটনা।

– তাই নাকি? রাজিতের কণ্ঠে হালকা অবিশ্বাস।

– রিমি কিছুটা জোর দিয়েই বলল, হ্যাঁ তাই, “List of Ethnic Riots” গুগল করে দেখ, বাংলাদেশে উল্লেখ করার মত মাত্র এই কয়েকটা ঘটনাই ঘটেছে।

রাজিত আবার অবাক কণ্ঠে বলল, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং! দেখতে হবে তো! ১৯৯০ সালের পর বাকি সবগুলো ঘটনাই তো দেখছি একেবারে রিসেন্ট। তবে ৯০ এর ঘটনাটাকে আমি সাম্প্রদায়িক  বলতে পারছিনা। আমি তখন দেশে ছিলাম, নিজে দেখেছি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই আন্দোলনের মোড় ঘুরাতে এরশাদই একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা করেছিল। ওটা ছিল মোর পলিটিকাল।

রিমি বলল, হ্যাঁ সবারই তাই মত, ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পরপরই এই ইস্যুটাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল এরশাদ। আর হাঙ্গামা বাধাবার জন্য কিছু উগ্রবাদী তো সবসময়ই থাকে। সেইসময় বাবরী মসজিদ নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক জোয়ার উঠেছিল তার ধাক্কা বাংলাদেশ লাগাটা খুব অস্বাভাবিক ছিলোনা। কিন্তু বাংলাদেশ সত্যিই ব্যতিক্রম ছিল।

-আমার এখনও মনে আছে সেসময় আমার বাপ চাচারা অন্যান্য মুসল্লিদেরকে নিয়ে সারারাত বসে ছিলেন নারিন্দার গড়িয়া মঠের সামনে, যাতে কেউ মন্দির আক্রমণ করতে না পারে। কি আজব! সরকার উস্কানি দিচ্ছে আর সাধারণ মানুষ চেষ্টা করছে থামাতে! কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলল রাজিত।

Ramu

-২০১২, ১৩ র ঘটনা গুলো তো আরও আজব যেমন ধর রামুর ঘটনা। হাজার বছর ধরে বৌদ্ধ-মুসলিম সেখানে একসাথে বসবাস করছে, কখনো কিন্তু কিছুই শোনা যায়নি। হঠাৎ  করেই কি ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটে গেল ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ মধ্যরাতে। তুমি বলছিলে সরকারের ভূমিকার কথা। ধরে নিচ্ছি ঘটনাটা ঘটে গেছে হঠাৎ  করেই চোখের পলকে সরকারের কোন কিছু করার ছিলোনা। মেনে নিলাম। কিন্তু এটা তো একটা সাধারণ প্রত্যাশা যে এরপর সরকার দোষীদের কে ধরবে, সাজা দেবে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। অবাক হবার মত ঘটনা কি জান, সরকার তদন্ত টদন্ত না করেই দোষ দিলো রোহিঙ্গাদের।তার মানে তারা আরেকটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কে দিতে চাইলো। অকল্পনীয়। জানিনা আর কোন দেশে এমন উদাহারন পাওয়া যাবে কিনা।

অবাক হয়ে বলল রাজিত, বল কি? কি করে সম্ভব?

– তুমি অনেক বছর ধরে বাইরে আছ তাই অবাক হচ্ছ। এদেশে আজকাল অনেক কিছুই সম্ভব হচ্ছে। বিশ্বাস করবে, যেদিন রাতে এই ঘটনা ঘটলো সেদিন বিকেলে সরকারীদলের লোকজন উস্কানিমূলক মিছিল করছিল রামুতে? আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই তুমি ২৪ অক্টোবর ২০১২ এর ডেইলি স্টার খুলে দেখ। সত্যিই এগুলো বলতে মোটেই ভাল লাগেনা, কি দেশটা ধিরে ধিরে যে কি হয়ে যাচ্ছে! বলতে গিয়ে রিমির গলায় একটুখানি আবেগ আটকে গেল তাই গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ২০১৩ সালের পাবনা সাথিয়ার ঘটনাটা তো শুনেছ?

– হ্যাঁ শুনেছি।

– ৭ ই নভেম্বর ২০১৩-র ডেইলি স্টারের রিপোর্টটা চোখে পড়েছে? হেডিংটা দেখেছ? “Some attackers seen with Tuku”। টুকু কে জান তো? টুকু হচ্ছে তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

– কি বললে? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী? মানে হোম …

রাজিতকে শেষ করেতে না দিয়েই বলল রিমি, হ্যাঁ, যার দায়িত্ব দেশের সকল মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। সেসময়কার নিউজগুলো পড়লে যে কারো মাথা খারাপ হতে বাধ্য। কোন কোন পত্রিকা লিখেছে “হিন্দুদের ওপর হামলা, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিয়াই তসলিম উদ্দিন খান কে গ্রেফতার” আবার কেউ কেউ লিখেছে, “চাপে পড়ে পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিয়াই তসলিম উদ্দিন খানকে ছেড়ে দেয়া হয়”।

– বরিশাল আর যশোরের ঘটনাও কি একই রকম? জিজ্ঞেস করল রাজিত।

– বরিশালের ঘটনায় ২১ নভেম্বর ২০১৩ সরকারী সমর্থক পত্রিকা কালের কণ্ঠের রিপোর্টটা দেখ, “বরিশালে মন্দির ও বাড়িতে আগুন দেয় ছাত্রলীগ কর্মীরা!” আর যশোরের ঘটনাটা ঘটলো ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে, নির্বাচনের পরপরই। বিষয়টি ছিল, পরাজিত আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল ওহাব বনাম একই দলের এমপি রণজিতের বিরোধ। ওহাব তার প্রতিপক্ষ বিজয়ী রণজিতের সাথে পেরে না উঠে হামলা পরিচালনা করে। যেহেতু ওহাব নাম ধারী মুসলমান, বিজয়ী রণজিৎ হিন্দু, তাই সহজেই এটাকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। জানুয়ারি মাসের পেপার পত্রিকা এবং টিভি রিপোর্ট থেকে এই ধারনাই পাওয়া যায়।

– তুমি কি আজকাল বিরোধীদল কর নাকি? শুধু সরকারকেই দোষ দিচ্ছ? সরকার কেন এসব করতে যাবে? একটু খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করল রাজিত।

– না আমি মোটেই সরকারকে দোষ দিতে চাচ্ছি না। আমি বলছি সরকারের ভূমিকার কথা। ঘটনা যাই হোক, দোষী যেই হোক সেটা খুঁজে বের করা তো সরকারের দায়িত্ব নাকি? কখনও কি শুনেছ সরকার এর ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে চুপচাপ বসে থাকে? এই যে সেদিন মালয়েশিয়ান প্লেনটা হারিয়ে গেলো। মালয়েশিয়ান সরকার কি টেররিস্টদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বসে আছে? ওদের ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টারের তো এখন রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ওরা চীন, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল, সন্ধানী দল সবাই কে সাথে নিয়ে খোজা খুজি করছে হারিয়ে যাওয়া প্লেনটা।শুধু তাই না হারিয়ে যাওয়া যাত্রীদের পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা, সাহায্য দিতে নিয়োগ করেছে ৭০০ জন সেবক- সেবিকা ।তারা রাত দিন ২৪ ঘণ্টা এই পরিবারগুলোর দেখ-ভাল করছে। আর আমরা? সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর মন্ত্রীরা এর-ওর উপর দোষ চাপিয়ে, নড়া চড়া তত্ত্ব দিয়ে, বিদেশী সাহায্যে কে নাকচ করে দিয়ে একটা যা তা অবস্থা। কথা হচ্ছে সমস্যা একটা হতেই পারে কিন্তু তারপর আমরা কি করছি। যে দায়িত্ব দিয়ে মানুষ সরকারকে বসিয়েছে সে দায়িত্ব সরকার পালন করছে কিনা? অবিশ্বাস্য হচ্ছে উপরের ঘটনাগুলোর একটি ক্ষেত্রেও সরকার তা করেনি। তাই প্রশ্ন উঠেছে সরকারের ভূমিকা নিয়ে। তাছাড়া তুমি যদি লক্ষ্য কর দেখবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার কোন না কোন একটা ইস্যুকে ধামা চাপা দিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোকে সামনে এনে।

-মানে?

-মানে হচ্ছে ঠিক ১৯৯০ সালে এরশাদ যা করতে চেয়েছিল এখনও সম্ভবত তাই হচ্ছে।এটা মোটেও নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগে মিশরের সামরিক জান্তা সংখ্যালঘু খৃষ্টান-চার্চে আক্রমণ করিয়ে বিরোধীদের দোষারোপ করল। আরে বাবা আন্দোলন যখন দানা বেধে উঠেছে, বিরোধীরা কোন আক্কেলে কপ্টিক চার্চ আক্রমণ করে আন্দোলনকে ভণ্ডুল করবে? একটু খেয়াল করে দেখ, বাংলাদেশে ২০১৩–র নভেম্বরে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন তুঙ্গে তখনই কিন্তু ঘটল পাবনা আর বরিশালের ঘটনা। আর নির্বাচনের পর যখন একতরফা কারচুপির নির্বাচন নিয়ে সরকার দেশে বিদেশে প্রবল সমালোচনার মুখে তখন ঘটলো যশোরের ঘটনাটা। ব্যাপারগুলো কি একেবারেই কাকতালীয়? শুধু আমিই না হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন গুলোও সরকারের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। এমনকি সরকারী মানবাধিকার কমিশনও এই একই কথা বলে কিঞ্চিৎ দৌড়ের উপর আছে।

রিমির রাশভারী যুক্তিগুলো শুনে রাজিত একটু গম্ভীর স্বরে বলল, অবিশ্বাস্য বটেই, কোন কোন সরকার অনেক সহনশীল জনগণকে নিয়েও সম্প্রীতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে আর কোন কোন সরকার অসংখ্য চরমপন্থিদের নিয়েও সম্প্রীতি ধরে রেখেছে শুধুমাত্র আইন, সুশাসন, সুবিচার ও সমতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। যেমন ধর দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা ধর আমাদের কাছের দেশ মালয়েশিয়া অথবা সিঙ্গাপুরের কথা। মাত্র ৩০/৪০ বছর আগেও ওদের সাম্প্রদায়িক সমস্যা কতটাই না  গভীর ছিল। অথচ সরকারের সঠিক ভূমিকার ফলে সব কিছুকে পিছনে ফেল ওরা কতটা এগিয়ে গেছে, এগিয়ে যাচ্ছে।

– সেটাই। যাক অনেকদিন পর অনেক কথা হোল। দেশের সম্পর্কে অনেক ভালো ভাল কথা বলতে ইচ্ছে করে, ভাবতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কি করার আজকাল শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষই নয় রাজনৈতিক বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হচ্ছে আরও বেশী।

– সেদিন প্রথম আলোতে সৈয়দ আবুল মকসুদ এর একটা লিখা পড়লাম। খুব ভাল লাগলো। লিখাটা উনি শেষ করেছেন এভাবে, সেদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েই ছিল একটি সংহত, সম্প্রীতি-পূর্ণ ও আত্মমর্যাদা শীল জাতি গঠনের জন্য, যেখানে থাকবে না হিংসা, ঘৃণা ও বৈষম্যের কোনো স্থান।এই পরিস্থিতিতে এসে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও যখন একটি সংহত, সম্প্রীতি-পূর্ণ ও আত্মমর্যাদা শীল জাতির কথা বলছে, তোমার আমার মত দেশের সাধারণ মানুষও যেহেতু সম্প্রীতি-পূর্ণ সমাজের প্রয়োজন বুঝতে পারছে, সরকারকেও বুঝতে হবে আজ অথবা কাল।

রিমি এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, দোয়া করো যেন তাড়াতাড়ি বোঝে, মেঘনায় আর কোন লাশ ভাসা দেখতে চাই না।

 

রাজিত এবার একটু মজা করেই বলল, এক কাজ করো তোমরাও অস্ট্রেলিয়ার মত একটা সম্প্রীতি দিবস পালন কর। যেদিন বিভিন্ন ধর্ম, দল ও আদর্শের সবাই একসাথে জড়ো হবে। কেউ ধুতি পড়ে, কেউ টুপি পড়ে, কারো গলায় হোলী ক্রস, কারো গায়ে মুজিব কোট, কারো হাতে তারবীরের ছবি, কারো হাতে তারপিরের ছবি। সবাই একসাথে মিলে, হাতেহাত ধরে দাঁড়িয়ে লাখ কণ্ঠে সম্প্রীতি সঙ্গীত গাইবে, বিশ্ব রেকর্ড গড়তে নয়, সম্প্রীতি গড়তে-

 Flag Old

নানা ধর্মের, নানা মতের তবু আমরা মানুষ এক

এই মাটিতেই আমরা সবাই জন্মেছি এক ঝাঁক,

আমরা একই স্বপ্ন দেখি ধরি একই গলায় গান

আমি, তুমি, আমরা সবাই বাংলার সন্তান।।

One thought on “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সরকার: এদেশ – ওদেশ

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s