শ্রমিক দিবসের চেতনা এবং প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিকোন- মুজতাহিদ বাপ্পী

1
আমাদের প্রজন্মের একটি দোষ হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকেই আমরা সরলভাবে বিশ্বাস করতে পারিনা । মাঝে মাঝে মনে হয় একবিংশ শতাব্দী সম্পূর্ণরুপে একটা এন্টি-ট্রাস্ট ফেইজ । আমরা এমন কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে গড়ে উঠতে পারিনি যেই ব্যবস্থা বাহ্যিক উৎকর্ষের সাথে সাথে শতভাগ আত্মার প্রশান্তি এনে দেবে । এজন্যেই বিশ্বাসের ভিত্তি যেমন দুর্বল হয়েছে, মনের খুঁতখুতে স্বভাবও বেড়েছে । জেনারেশন এক্স-ওয়াই-জেড পার হয়ে আমরা এখন কোন টাইম-স্পেস ফ্রেইমে অবস্থান করছি সেটাও সুনির্দিষ্ট নয় ।যাইহোক, এরকম সন্দিহান মন নিয়ে এবারের মহান মে দিবসে কি করণীয় হতে পারে তাই ভাবছিলাম । আমাদের দেশেও দেখলাম অনেক মহল ঘটা করেই মে দিবস পালনের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন । উইকিপিডিয়াতে জানতে চাইলাম মে দিবস কিভাবে পালন করতে হবে ! ওখানে বলা আছে এটা হলো উত্তর গোলার্ধের বসন্ত উৎসব । এইদিন প্যাগানদের উপাসনার জন্য বিখ্যাত । ছোটশিশুরা হোমওয়ার্ক বাদ দিয়ে সারাদিন মে-পোল নামক একটা সার্কাসের চারিদিকে ঘুরতে থাকবে, তরুণীরা কুমারী মেরী সেজে একটা ঝুড়িতে ফুল-ফল নিয়ে প্রতিবেশীদেরকে বিতরণ করতে থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সমুদ্রসৈকতে মাইলটেস্ট দিতে থাকবে, কিছু অনুষ্ঠানসর্বস্ব সুবিধাভোগীর দল মরিস ড্যান্সিং নামে রাস্তায় রাস্তায় একটা প্যাগান রিচুয়েল পালন করতে থাকবে । মে দিবসের এহেন কর্মকান্ড দেখে আমি অবাক হয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া খুলে বসলাম ।
হায় হায়, এরাও বলতেসে মে দিবস মোটামুটি চৌদ্দ-পনেরটা উৎসবের সম্মিলিত দিন ! এ কি অবস্থা ! আমরা সারাজীবন মুখস্ত করে এলাম এটা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, শ্রমিকেরা আন্তর্জাতিক কর্মঘন্টার স্বীকৃতি আদায়ে রক্ত দিয়েছে, ঘর্ম দিয়েছে, চর্ম দিয়েছে, আরো কতো কি ! সেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই মে দিবসের এমন ভিন্ন রুপ ! পরে বৃহত্তর কিউরিওসিটি নিয়া গুগলিং করে করে যা বুঝলাম তা হইলো পুরা মে দিবস জিনিসটা অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসের মতোই নিছক একটা দাবার চাল ছাড়া আর কিছুই নয় । এই দিনে কোন শ্রমিক নিহত হয়নি । এই দিনে কোন মালিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মালিকানা হারায়নি । এই দিনে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান দুর্ঘটনায় ধ্বসে পড়তেও দেখা যায়নি । শুধুই একটা অন্ধ প্রচলনের কক্ষপথে পুরা পৃথিবী যেনো আবর্তন করে যাচ্ছে ।মে দিবসের নামে যে ঘটনাটি প্রচার করা হয় তার সাথে ভ্যালেন্টাইন দিবসের কাহিনীর মিল আছে । কারণ দুইটির একটিও কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত নয় । আবার শিকাগো শহরের হে-মার্কেট রায়ট নামে যে ঘটনার বর্ণনা আমাদের কাস্তে-কোদাল চিণ্হিত লালমহলে জোরেশোরে আলোচিত হয় সেটিও ঘটেছিলো ১৮৮৬ সালের ৪ মে, পহেলা মে-তে নয় । শ্রমিকদের একটি র‌্যালি থেকে নিক্ষিপ্ত বোমা বিস্ফোরিত হয়ে সাতজন পুলিশ সদস্য নিহত হয় । তারপর পুলিশের গুলিতে চারজন শ্রমিক নিহত হয় । তাতে একটি সাময়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে বিচারের মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে ফাঁসিতে মৃত্যদন্ড দেওয়া হয় । ব্যস্ এই হলো ঘটনা । যেটা আমাদের দেশে ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশে এখন নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র । কিন্তু সেই ঘটনাকে টেনে নিয়ে ঘুটি চালাচালি শুরু করলো রাজনৈতিক তৃতীয় পক্ষ । ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবর্ষ পালন উপলক্ষ্যে “সোশালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল” নামে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম শুরু হয় প্যারিসে । রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিন ছিলেন এই সংগঠনের কর্মী । অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ার উপায় হিসেবে তারা শিকাগোর ঘটনা এবং পূর্বের শতাব্দিতে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবকে সামনে নিয়ে আসে । এইভাবে তারা ঘোষণা দেয় মে মাসের এক তারিখ হবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যদিও তারা নিজেরা এমন ঘোষণা দেয়ার কতটুকু সক্ষমতা বা গ্রহণযোগ্যতা রাখে সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ । তারাই আবার ১৯১০ সালে ঘোষণা দেয় মার্চ মাসের ৮ তারিখ হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ! নিছক রাজনীতি ছাড়া একটির পর একটি দিবস ঘোষণা করা কোন দলের কাজ নয় এটা বোঝার ক্ষমতা আধুনিক বিশ্বে মোটামুটি সবাই রাখেন ! আর সত্যিই যদি শ্রমিকদের কোন স্বার্থে এই দিবস ঘোষণা করা হতো, তবে একই সংগঠন প্রলেতারিয়েত রাজনীতিতে অংশ নেবে কেন ? যাইহোক দিবসনির্ভর রাজনীতি চালিয়ে বেশিদূর যেতে পারলোনা দলটি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা খেয়ে তারা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো ১৯১৬ সালের মধ্যে । কিন্তু তাদের ফেলে যাওয়া দিবস দুখানি (মে দিবস এবং নারী দিবস) এখনো পৃথিবীর আনাচে কানাচে অসহায় মানুষের জন্য মিথ্যে আশা কুহকিনী হয়েই বেঁচে রইলো যেনো ।কারণ যতোটুকু শ্রমিকদের স্বার্থে ব্যবহার হবার কথা ছিলো, মে দিবস তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া তৃতীয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠির দাবার চাল হিসেবে ।এবার দেখে নেয়া যাক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে মে দিবসের ভূমিকা কেমন ছিলো । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মে দিবস পালনের নামে নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠি সবসময় রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টায় সক্রিয় ছিলো । বিশেষ করে ১৯৩০ সালের দিকে গ্রেট ডিপ্রেশনকে কাজে লাগিয়ে তারা দিবসটি পালন করতো এবং নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, সিয়াটল প্রভৃতি স্থানে দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করতো । অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মে দিবসের বদলে শ্রমিক দিবস অন্য দিনে নির্ধারণ করায় এই প্রচেষ্টা কখনো সফলতা পায়নি । যুক্তরাষ্ট্রে এখনো শ্রমিক দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার । এমনকি কানাডাতেও শ্রমিক দিবস সেপ্টেম্বরে পালিত হয় । এছাড়া অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট জাতীয় আন্দোলনগুলো সবসময় মে দিবসের সংবেদনশীলতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । জার্মানীতে মে দিবসকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা বাঁধানোর ইতিহাস প্রায় পঁচিশ বছরের । এমনকি ২০১০ সালেও বামপন্থী শিবিরের প্ররোচনায় বার্লিনে দাঙ্গা হয়েছে মে দিবসে । রাশিয়াতে মে দিবস মানেই বলশেভিক বনাম মেনশেভিক দ্বন্দ্ব । ২০১৪ সালের মে দিবসে সম্ভবত পুতিনের বিরুদ্ধে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্যে রেড স্কোয়ারে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়ান ফেডারেল ট্রেড ইউনিয়ন । মুসলিম বিশ্বের মধ্যে তুরস্কে ১৯৭৭ সালে তাকসিম স্কয়ারে কম্যুনিস্টরা মে দিবস পালনের নামে যে দাঙ্গা শুরু করে তা শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালের সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ হয় । বর্তমানে এরদোগান সরকার তাকসিম স্কয়ারে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠি মে দিবসের প্রতি মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বারবার সরকার পতনের চেষ্টা চালিয়েছে দিনটিকে উপলক্ষ্য বানিয়ে ।

 

সম্ভবত এসব দাঙ্গা-নৈরাজ্যের কথা মাথায় রেখেই ইরান, জাপান, কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্র মে দিবসের সরকারি ছুটি বাতিল করেছে । দোষ কিন্তু মে দিবসের নয় । বরং সুবিধাভোগী বিশেষ বিশেষ গং দের ট্রেড ইউনিয়নের আড়ালে দেশের শিল্প-বাণিজ্যকে রাজনৈতিক কূটচালের উপকরন হিসেবে ব্যবহার করাই মূল সমস্যা । যদি কোন সত্যিকার দেশপ্রেমিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তবে চক্রান্তকারীদের প্রথম আক্রমণের জায়গা হয় দেশের অর্থনীতি । আর এসময় শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার নাম করে কতিপয় ট্রেড ইউনিয়ন নামের মুখোশধারী দাঙ্গাবাজ পলিটিক্যাল থাগ দের খেলা শুরু হয় । অতএব দেশরক্ষার ভবিষ্যৎ ক্যালকুলেশনে শুধু সামাজিক ইস্যু ভ্যালেন্টাইন ডে-পহেলা বৈশাখের অশ্লীলতা নিয়ে ভাবলেই চলবেনা, রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে শ্রমিক দিবসের নামে শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহার নিয়েও বোধহয় নতুন করে ভাবা দরকার ।

 

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে শ্রমিক সংঘের নাম আছে । অথচ শ্রমিকদের সত্যিকার বেতন-ভাতা নির্ধারণ, কাজের সুন্দর পরিবেশ তৈরি, সামাজিক সম্মান বা কোন দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি হলে সঠিক ক্ষতিপূরণের জন্যে কেউই তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বলে জানা নেই । নির্যাতনকারী মালিকপক্ষকে ভাসা ভাসা তিরস্কার, বুঝেও না বোঝার ভান, মৃদু ভৎসর্নার নীতি গ্রহণ, অর্থনীতির সঞ্চারপথে খুব একটা সুখকর ভবিষ্যৎ বয়ে আনেনা ।

 

অতএব- কেবল দিবসে দিবসে চেতনার বুদবুদ গ্রহণের পূর্বে একটু সতর্ক হবার সময় এসেছে বলেই মনে করি । আমরা চাই বছরের প্রতিটি দিন যেনো শ্রমিকেরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে কাটাতে পারেন সেই পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হোক । শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনা-ভাতার ব্যবস্থা করা হোক । তাদের সন্তানদেরকে যেনো লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে শিশুশ্রমিক হিসেবে অল্পবয়সে জীবিকার সন্ধানে বের হতে না হয় সেই রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা বিধান করা হোক । হয়তো তাহলেই সত্যিকার শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত হবে । নিছক দিবসের আড়ালে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বন্ধ হবে । শ্রমিক দিবস তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে । সেদিন হয়তো “দুনিয়ার কুলি-মজুর এক হও লড়াই করো” শ্লোগানের বিপরীতে নতুন শ্লোগান হবে “মোরা সভ্যতার কারিগর- স্বদেশ করবো স্বনির্ভর” ।

 

One thought on “শ্রমিক দিবসের চেতনা এবং প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিকোন- মুজতাহিদ বাপ্পী

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s