ইতিহাস এবং ইতিহাসের নাগরিক রোমন্থন মানে Public Remembrance এক জিনিস না। ভাষা আন্দোলন নিঃসন্দেহে আমাদের জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের একটা অন্যায় এবং আধিপত্যবাদী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে না; এবং ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আমাদের তৎকালীন খুবই ছোটো আরবান এডুকেটেড মিডল ক্লাসের যে গভীর আস্থা তার বিস্ফোরণ – এর সাথে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ত্বের কোনো সংযোগ নেই।
কিন্তু ষাট বছর ধরে আমরা ভাষা আন্দোলনকে যে ন্যারেটিভ সহকারে স্মরণ করেছি তা এক বিচিত্র প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আদাবগুলো আমি লক্ষ্য করেছি গভীরভাবে।
ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি তাই আমাদের ভাষা সবার থেকে আলাদা অথবা শ্রেষ্ঠ। যেহেতু আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি সেহেতু আমাদের ভাষা মহান। এই মহান ভাষায় যারা কথা বলেন তারা সৌভাগ্যবান এবং তাদের একটা দায়িত্ব হোলো ভাষার “শুদ্ধতাকে” রক্ষা করা – নদীর মতোন করে। শুদ্ধ মাত্রই পবিত্র – বাঙালির মনে; তাই সে ভাষার ওপর পবিত্রতা আরোপ করে। খেয়াল করবেন যে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আমরা খালি পায়ে বেদীতে উঠি (কিন্তু ৭১ এর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সাভার স্মৃতি সৌধে খালি পায়ে যাওয়া আবশ্যক না) – পূণ্যভূমিকে মানুষ যেভাবে অবগাহন করে। যা কিছু আপনি পবিত্র বলে ধরে নেন তার প্রায় প্রতিটিই আপনাকে আশ্রয় দেয়, রক্ষা করে। Public Remembrance এর ভাষা আন্দোলনের সামনে দাঁড়ালে তাই আমরা এক বিশুদ্ধতা, এক পবিত্রতা, এক নিবেদন বোধ করি। আমাকে যদি “বাংলা ভাষা”কে একটা ছবি হিসেবে বর্ণনা করতে বলা হতো, আমি বলতাম – ২১শে ফেব্রুয়ারিতে “বাংলা ভাষা” হোলো মাইকেলএঞ্জেলোর সিস্টীন চ্যাপেলে আঁকা ফ্রেস্কো “The Creation of Adam” এর যে ঈশ্বরের মতন – যার সাদা লম্বা দাড়ি আছে (পিতৃবৎ), যে মহানুভব ও রক্ষাকারী, যে একটু উঁচুতে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এডামের দিকে।
আমি মনে করি এ ধরনের অনুভব ও আচার বাংলা ভাষার বিন্দুমাত্র উপকার করে নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা আন্দোলনের যে Public Remembrance তা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভাষা কোনো “পবিত্র” বিষয় না এবং ভাষার দূষণ বলে যে ধারণা আমাদের মাথায় চেপে ধরে বার্ষিক একবার, সেটা এক আজগুবি ধারণা। ভাষা একান্তই – আরেকবার বলবো – একান্তই “অপবিত্র” জিনিস – ব্যাঙ্ক নোট যে অর্থে অপবিত্র, সে অর্থে। কোনো ভাষার উৎকর্ষের জন্য এমন “অপবিত্র” হয়ে থাকতে পারাটা খুবই খুবই জরুরী।
আমরা প্রায়ই অনুযোগ করি যে আমাদের “একটা” মান ভাষা থাকা আবশ্যক যেটা সবাই বুঝবে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে একটা ভাষার নিজের মধ্যে অনেক গুলো মানভাষা থাকে। একটা সায়েন্টিফিক পেপারের ইংরেজি, সাহিত্যের ইংরেজি আর, আইনী রায় লেখার ইংরেজির মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে সেটাও আমরা ভুলে যাই। ধরা যাক আপনি একটি পরীক্ষায় কোনো একটা স্টেজে বরফের মধ্যে একটা প্লেটে কিছু cell মানে কোষ আধা ঘন্টা ইনকিউবেট করছেন। সাহিত্যের ইংরেজিতে cells were incubated in ice বললে কোনো ভুল হবে না কিন্তু সায়েন্টিফিক ইংরেজিতে আপনাকে বলতেই হবে যে cells were incubated on ice কারণ আপনার প্লেটটা ছিলো বরফের স্তুপের ওপরে, মধ্যে না।
এটা একটা অ-তি সাধারণ উদাহরণ কিন্তু এর একটা তাৎপর্য আছে। বাংলায় যেটাকে আমরা মান ভাষা বলি সেটা সাহিত্য করার জন্যে, কিংবা সাধারণ ভাব আদান-প্রদানের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ভাষার ব্যবহার মানে তো শুধু গল্প-উপন্যাস লেখা না, আপনাকে খুবই বিশেষায়িত যোগাযোগও করতে হবে। মনে রাখবেন যখনই আপনি বিশেষায়িত যোগাযোগ করবেন তখনই দুটো ঘটনা ঘটবে। এক: আপনি অনেক বেশি বিশেষ্য ও ক্রিয়া পদ ব্যবহার করা শুরু করবেন এবং দুই: যে বিশেষ্য ও ক্রিয়া পদ আপনি ব্যবহার করা শুরু করবেন সেগুলোর অর্থের স্পেকট্রাম খুবই নির্দিষ্ট।
উদাহরণ দেই: ধরা যাক আপনি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, কথা বলছেন আরেকজন ফ্যাশন ডিজাইনারের সাথে। আপনি ঝগড়া করছেন রীতিমতন, যে না এই ড্রেসটা ফ্রেঞ্চ ব্লু দিয়ে বানালে হবে না, বানাতে হবে কর্নফ্লাওয়ার ব্লু দিয়ে (দুটোই নীল রঙের শেড)। এবং আপনার জুনিওরকে বকা দিচ্ছেন – I told you to press the trouser not to iron it. সাধারণ মানুষের কাছে ফ্রেঞ্চ ব্লু আর কর্নফ্লাওয়ার ব্লু’র মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই কিন্তু একজন ডিজাইনারের কাছে পার্থক্যটা রাত-দিন। ঠিক তেমনি ভাবে press the trouser মানে হোলো ইস্ত্রী গরম করে প্যান্টের ওপর একজায়গায় বসাবেন, চাপ দেবেন তারপর উঠিয়ে ফেলে আরেক জায়গায় বসাবেন, ইস্ত্রী ঘষে ঘষে আরেক জায়গায় নেবেন না (একটা চাদর ইস্ত্রী করতে হলে যেমন একবার ইস্ত্রী বসিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব জায়গায় নিয়ে যান)।
লক্ষ্য করুন যে ইংরেজিতেও সাধারণ একজন মানুষের কাছে press the trouser এবং iron the trouser – এই যে দুটো এক্সপ্রেশান এর মাঝে ক্রিয়াপদের ব্যবহারের কোনো ফারাক নেই। কিন্তু ইস্ত্রী করা যার পেশা সে এই বিশেষায়িত ক্রিয়া পদের সীমানাটা বুঝতে পারে।
প্রশ্ন হোলো, এই ধরনের বিশেষায়িত ভাষিক যোগাযোগের কোনো সুযোগ প্রমিত বাংলা ভাষা মানে যে ভাষায় জ্ঞানী-গুণী জনরা লেখালিখি করেন সে ভাষার আছে কি না?
আমার উত্তর হোলো নেই। আমি এই আয়োজনে প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করবো যে প্রমিত বাংলা ভাব-প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা খুবই আটোসাটো মাধ্যম যার বিবর্তিত হওয়ার সক্ষমতা খুব কম। এরপর আমার থিসিস হোলো যে ভাষাটাকে প্রমিত বাংলার দূষণকারী বলা হচ্ছে, অর্থাৎ অপ্রমিত বাংলা, যেটাকে ব্রাত্য রাইসু কিংবা আবার জিগস ঘরানার বাংলা বলে নাক সিটকানো হয় সেই বাংলাকেই আমি মনে করি সম্ভাবনাময় বাংলা। আমি এও মনে করি যে এই ছোটোলোকের বাংলাই কেবল পারবে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটাতে এবং এ কাজটি করতে হলে প্রয়োজন হবে আমাদের শিক্ষার মাধ্যমকে ইংরেজি করা।
আপনার মনে হতে পারে যে আমি অনেক গুলো আজগুবি এবং স্ববিরোধী কথা বলছি। একটু অপেক্ষা করুন, হয়তো আমি আপনার মনে কিছু প্রশ্ন জাগাতে পারবো।
আমি “বাংলা মাধ্যম পর্ব” বলতে এই লেখায় বোঝাচ্ছি ৭০ পরবর্তী বাংলাদেশকে যখন স্কুলের ল্যাংগুয়েজ অফ ইন্সট্রাকশান ইংরেজি থেকে বদলে বাংলা করা হয়। এই পর্বের দুজন বিখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হুমায়ুন আহমেদ। প্রথম জনকে বেশীরভাগ পাঠক মনে করেন যে সিরিয়াস লেখক এবং দ্বিতীয় জন জনপ্রিয় লেখক। আমি এ দুজনের যে কোনো দুটো উপন্যাস নিয়ে প্রথম দশ হাজার শব্দের মধ্যে শুধুমাত্র ক্রিয়াপদগুলোকে দাগ দেয়ার অনুরোধ করবো এবং সমসাময়িক ইংরেজি ভাষার দুজন লেখক সালমান রুশদী এবং জেফরি আর্চারের যে কোনো দুটো বই নিয়ে একই কাজ করার অনুরোধ করবো। তারপর বাংলা ও ইংরেজির ক্রিয়াপদ নিয়ে একটু তুলনা করুন।
আপনি দুটো জিনিস দেখতে পাবেন। সম্ভবত উক্ত দুই বাংলা লেখকের বই এ আপনি এমন একটা ক্রিয়াপদও পাবেন না যেটা রবীন্দ্রনাথ পড়লে বুঝতেন না কিংবা রবীন্দ্রনাথের সময়ে ব্যবহার করা ক্রিয়াপদটার মানে এখন এতোটাই বদলে গেছে যে তিনি এই মুহুর্তে পড়লে তার পাঠোদ্ধার করতে পারতেন না। শুধু তাই না আধুনিক জীবন যাপন জনিত কিছু শব্দ ছাড়া (যেমন কম্পিউটার, ফ্যাক্স ইত্যাদি) রবীন্দ্রনাথ প্রায় পুরো বইই সঠিক অর্থে বুঝতে পারতেন। দ্বিতীয় যে জিনিসটি আপনি লক্ষ্য করবেন সেটা হোলো একটা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা লেখায় ক্রিয়াপদের অপ্রতুলতা। প্রমিত বাংলা ক্রিয়াপদের জগৎটা একটা খাটি অচলায়তন। ইংরেজি ভাষায় নিত্য নতুন ক্রিয়াপদ ঢুকছে কিংবা প্রচলিত ক্রিয়াপদের মানে বদলে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে কারণ আমাদের জীবন-যাপন বদলে যাচ্ছে।
উদাহরণ দেবো? Sexting, Xeroxed, Hoovered, trending, skateboarding, tweeting, speed-dating এই ক্রিয়াপদগুলো একেবারেই নতুন। Phrasal Verb ও বদলে যাচ্ছে দ্রুত। বিশ বছর আগে bump off শব্দদ্বয়ের কেবল একটাই মানে ছিলো – কাওকে মেরে ফেলার একটা ইনফরমাল এক্সপ্রেশান। কিন্তু এখন কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের সাথে যোগাযোগ হুট করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে bump off বলা হয়। ইংরেজি phrase এর ক্ষেত্রে যেহেতু কিছু অলিখিত সূত্র আছে সেগুলো ধরে অহরহই নতুন ক্রিয়াপদ তৈরী হয়। যেমন ধরুন dumb down বলতে বোঝানো হয় – ভোদাইদের জন্য আমি এই কঠিন ব্যাপারটা সহজ করে প্রকাশ করলাম। এটা পুরনো এক্সপ্রেশান কিন্তু এখন dumb up ও ব্যবহার হচ্ছে। এর মানে হোলো সাধারণ একটা জিনিসকে খুব ইন্টেলেকচুয়াল ভাব দেখানো – খেলনা প্লেনকে ড্রোন প্রমাণ করে বিশাল একটা লেখা লিখতে হলে যে কাজটা আপনাকে করতে হবে। তেমনি ভাবে তৈরী হয়েছে sex up বা sex down।
খেয়াল করুন যে আধুনিক জীবনে আমরা এমন শত শত কাজ করছি যেগুলো ৫০ বছর আগেও কল্পনা করা যেতো না এবং সেগুলো প্রকাশের কোনো যুতসই শব্দ আপনার কাছে নেই। পোলাপান যে “গো আউট”, “ডেটিং”, “ফাকায়” শব্দগুলোকে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করে এর যথার্থ কারণও আছে। বাংলা ভাষায় আধুনিক জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শব্দভাণ্ডার নেই।
গরু আপনি জবাই (Slaughter/Butcher) করেন ঠিক আছে কিন্তু আমি যে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ইদুর “ব্যবহার” করে মেরে ফেলছি যেটাকে ইংরেজিতে অপরাধ বোধ কমানোর জন্য বলা হচ্ছে culling কিংবা একদিন ইদুরের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেছিলাম ভুল করে – যেটাকে বলা হয় sever বা decapitulation সেটাকে বাংলায় কীভাবে প্রকাশ করবেন? আমি তো আর ইদুর “হত্যা” করি না, কিংবা এমন স্যাডিস্টও নই যে ইদুর “মেরেই” আমার সুখ।
অনেকেই মনে করেন যে “ল্যাবে ইদুর মারি” বললেই শ্রোতা বুঝে নেবে যে পরীক্ষার জন্য ইদুর ব্যবহার করে মেরে তারপর ফেলে দেয়া হচ্ছে। ঠিক আছে। ইদুরের ক্ষেত্রে হয়ত আপনি সঠিক অর্থই গ্রহণ করতেন কিন্তু যদি আমি ল্যাবে “গরু মারতাম” তাহলে কিন্তু “মারা” দিয়ে আরো অনেক মানে বের করা যেতো।
এই সমস্যা শুধু ক্রিয়াপদ নিয়ে না, বিশেষ্য নিয়েও। আমি একটা বিজ্ঞানসম্মত (কিন্তু বৈজ্ঞানিক বলা যাবে না আপাতত) পরীক্ষার কথা চিন্তা করেছি। সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হোলো “কন্ট্রোল”। আমাদের তাই প্রয়োজন এমন বস্তু (বিশেষ্য) যেটাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ইন্টারপ্রেট করার সুযোগ আছে। আবার এমন জিনিস দিলেও হবে না যেটা সবার বোঝার কথা না। আপনি গাড়ী হিসেবে Jaguar XJ দেখিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন যে এটা কি – সবাই উত্তর দিতে পারবে না – পারার কথাও না।
সবার বোঝার কথা – অন্তত দেখার কথা এমন একটা বিষয় হতে পারে “রং” ও তার নাম। যেহেতু আমরা সবাই এই রংগুলোর মুখোমুখি হই অহরহ সেহেতু কেউ বলতে পারবেন না যে আমি তো এই বিশেষ্যর সাথে পরিচিত নই। (আগে ভাগেই বলে নি এটা সঠিক অর্থে সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টেশান না) আমি নীচে মোট ৬টা কালার সোয়াচ দিয়েছি এবং রংগুলোর নামও দেয়া আছে। আপনি কাউকে এই ৬টি রং দেখাবেন (অবশ্যই রঙের নামগুলো দেখাবেন না) কিন্তু একসাথে একটির বেশী রং দেখাবেন না এবং এই ৬টি রঙের মধ্যে আপনার ইচ্ছে মতন আরো কয়েকটি কালার সোয়াচ ঢুকিয়ে দেবেন (পর পর দেখালে ক্লু পেয়ে যাবে)। শুধু লক্ষ্য রাখবেন এই ৬টা রঙের নাম পরীক্ষার্থী কি বলছে?
আমার অভিজ্ঞতা কী বলি। বেশীরভাগ মানুষ না বলে দিলে রঙের নাম ইংরেজিতে বলা শুরু করে। বাংলায় অনেকেই য়েলো অকার ও ক্রোম য়েলো দুটোকেই হলুদ বলেন। যদিও য়েলো অকারকে অন্তত বাদামী বলা যায়। বার্ন্ট সিয়েনাকে খয়েরী বলা যায় কিন্তু অনেকেই বলেন লাল। আবার যারা বার্ন্ট সিয়েনাকে লাল বলেন মাঝখানে আরো কয়েকটা রং দেখিয়ে মনোযোগ নষ্ট করলে ভার্মিলিয়নকেও লালই বলেন। বাংলায় বললে প্রায় সবাইই শেষ দুটো রংকে বেগুনী বলেন (হালকা আর গাঢ় বেগুনী) .
একটু খেয়াল করুন পাঠক এই রংগুলোর একদম পারফেক্ট নাম আর্টিস্ট ও ডিজাইনার ছাড়া প্রায় কেউই বলতে পারবেন না, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি বেছে বেছে এমন রং নিয়েছি যেগুলো মোটামুটি সবাইই বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন শুধুমাত্র লাইলাক ছাড়া। বাদামী, হলুদ, খয়েরী, কমলা/লাল, লাইলাক/ল্যাভেন্ডার/মভ ও বেগুনি। অন্তত ৫টা রঙের নাম কিন্তু চলনসই ভাবে বাংলা দিয়েই বলা যায় কিন্তু অনেকেই বার্ন্ট সিয়েনা ও ভার্মিলিয়ন দুটোকেই লাল বলেন এবং লাইলাক ও ভায়োলেট দুটোকেই বেগুনী বলেন।
এর কারণ কি?
এর অনেক ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। রং নিয়ে খুব সফিস্টিকেটেড পরীক্ষা হয় যেগুলো আমার আয়ত্তের বাইরে। তাছাড়া এটাকে পরীক্ষা না বলে পর্যবেক্ষণ বলাটাই শ্রেয় – আমি অল্প কয়েকজনকে নিয়ে পর্যবেক্ষণটা চালিয়েছি। কিন্তু কয়েকটা প্যাটার্ন আমরা ধরতে পারি এবং হয়তো কিছু এডুকেটেড গেস করলে অপরাধ হবে না। যে ব্যক্তি খয়েরীকে লাল বলছেন তিনি কিন্তু দেখছেন খয়েরীই কিন্তু বলছেন লাল কেননা তিনি রংটাকে প্রকাশ করার সময়ে মনে করছেন যে লাল রঙের ব্যাপ্তি এতোটাই বড় যে খয়েরীকে লাল বললে অসুবিধা নাই (এটা আমার ব্যাখ্যা)। তার মাথায় একেকটা বিশেষ্যর ব্যাপ্তি এতোটাই বড় যে আরেকটা বিশেষ্যর সাথে ওভারল্যাপ করাটাকে তিনি “ভুল” মনে করেন না। হোমারের ইলিয়াড রচনার সময়ে গ্রীক ভাষায় “নীল” রঙের সমার্থক কোনো শব্দ ছিলো না (কিংবা এখনো গ্রীক ভাষায় Bush এর সমার্থক শব্দ নেই যেহেতু গ্রীসে ঝোপঝাড় হয় না)। সে হিসেবে লাইলাক রঙটা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য “অপরিচিত” হতে পারে কিন্তু বাকী রংগুলোর নাম কিন্তু বাংলায় আছে। তাহলেও কেন সে একই নাম দিয়ে দুটো ভিন্ন রং প্রকাশ করে?
আমার কাছে মনে হয় বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার যেহেতু সীমিত সেহেতু বাংলা ভাষাভাষীরা ছোটোবেলা থেকেই একই শব্দ দিয়ে অনেকগুলো অর্থ বোঝানোর একটা বিদ্যা আয়ত্ত করে। এই কাজটা আমরা করি নিজের অজান্তেই। যার ফলে বাংলা ভাষার শব্দের পরিধি ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এই “কাজ চালানোর” একটা বিশাল সমস্যা আছে। বাংলা শব্দবিশারদ কলিম খান দেখিয়েছেন যে শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বঙ্গীয় শব্দকোষ” অনুসারে “তীর্থ” শব্দটির মোট ৪২ টি অর্থ করা যায় মধ্যে যোনি, নারী, রতিস্থান/ক্রীড়াস্থান, পাত্র/সৎপাত্র, আগুন, খেয়াঘাট এমন কি মন্ত্রীও আছে। আমি বলছি না, এমন কি সুপারিশও করছি না যে একটা শব্দের কেবল একটাই মানে থাকা উচিত (সেটা ভাষার দীনতা) কিন্তু তাই বলে ……….. কোথায় আগুন, কোথায় যোনি (তামাশাটা দেখুন – এটাও বাঙালির তীর্থ) আর কোথায় মন্ত্রী? মানেগুলো কি একটার সাথে আরেকটা মেলে কিংবা এগুলো কি কাছাকাছি শব্দ?
লেখক যে অর্থে তীর্থ শব্দটি ব্যবহার করছেন পাঠক সে অর্থে শব্দটি গ্রহণ করবেন কি না – এর কোনো নিশ্চয়তা আছে কি?
এটা আমাদের ব্যবহারিক বাংলারও একটা মূল সমস্যা। আমাদের কলহপ্রিয়তার একটা মূল কারণ আমার কাছে মনে হয় বাংলা শব্দার্থের স্পেকট্রাম খুব বড় হওয়া। আমি বহু ঝগড়া প্রত্যক্ষ করেছি যেখানে এক পক্ষ যে অর্থে ভাব প্রকাশ করছে গ্রহীতা সে অর্থে ভাবটা নিচ্ছে না, কারণ গ্রহীতার পক্ষে শব্দটার ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ আছে। সংসদে চুদুর বুদুর শব্দদ্বয়ের ব্যবহার নিয়ে যে বিরাট ঝগড়া হয়েছিলো বছর খানেক আগে তার মূল কারণও এটি। কেউই জানে না এই শব্দের সীমানা আসলে কোথায় শেষ হয়? যেহেতু শব্দদ্বয় শুরুর দু-অক্ষর চ এবং দ ধ্বনি তাত্ত্বিক ভাবে “চোদা” শব্দের কাছাকাছি সেহেতু গ্রহীতা না জেনে ধরেই নিয়েছিলেন যে শব্দটি অশ্লীল।
এই আলোচনা আমি অনেকের সাথেই করেছি এবং একটি প্রসঙ্গ বারবারই এসেছে। অনেকেই মনে করেন যে কথোপকথনের ভাষা আর লেখার ভাষা ঠিক এক না। লেখার ভাষায় বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের অভাব থাকলেও বলার ভাষায় – অনেকেই মনে করেন যে পার্থক্য খুব বেশী নেই। আমি তা মনে করি না বরং আমার ধারণা বলার ভাষায় আমাদের শব্দভাণ্ডার আরো কম। আমার এই ধারণা সঠিক কি না তার জন্য একটা পরীক্ষার আয়োজন করি।
আমার বিচারে টেলিভিশন ইতিহাসে বাংলা ভাষায় লেখা শ্রেষ্ঠ সিরিয়াল হোলো বহুব্রীহি আর ইংরেজি ভাষায় Twin Peaks (এবং দ্বিতীয় সেরা হোলো Breaking Bad)। আমার রুচির সাথে আপনারটা মিলবে না জানি – প্রয়োজনও নেই – কিন্তু এই তিনটি সিরিয়ালই যে সুলিখিত সে কথা অন্তত কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আমার কৌতুহল মেটানোর জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে বহুব্রীহির একটি পর্ব (প্রথম পর্ব) এবং Breaking Bad এর একটি পর্ব (3rd Season, 1st episode) নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করি। আমার আগ্রহ বাংলা এবং ইংরেজি দু ভাষায় মোটামুটি ৪৫ মিনিটের লিখিত ও এডিটেড কথোপকথনে মোট কতোগুলো Unique Verb বা অনন্য ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রথমে আমি দুই ভাষার দুটো পর্বে সর্বমোট কতগুলো শব্দ উচ্চারিত হয়েছিলো সেটা গুনেছি। বহুব্রীহি ৫২ মিনিটের প্রথম পর্বে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে মোট ৪৯২১টি। অন্যদিকে Breaking Bad, 3rd Season, 1st episod এর ৪৭ মিনিটে সর্বমোট ৩৫৭৩টি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। এরপরে আমি দেখেছি উভয় মাধ্যমে মোট কতগুলো Unique Verb ব্যবহৃত হয়েছে? ইংরেজিতে Auxiliary Verb আমি গুনি নি এবং একই Verb এর কর্তা ও কাল ভেদের পার্থক্যকে আমি একটাই গুণেছি, আলাদা করি নি। অর্থাৎ Unique Verb এর বিচারে I eat, He eats, Pinkman ate, Saul was eating – এই চার প্রকাশে কেবল একটাই মূল ক্রিয়াপদ আছে – আর সেটা হোলো eat । ৩৫৭৩টি শব্দের মধ্যে যতোবার যেভাবেই eat শব্দটি আসুক আমি গুনেছি কেবল একবারই, একটা Unique Verb হিসেবে।
ঠিক এমনিভাবে বাংলাতেও আমি পারি, সে পারে, রহিম পারছে, ফাহামবাগই পেরেছিলেন – এই চারটি বাক্যে আমি একটি মূল ক্রিয়াপদের চারটি ভিন্ন রূপ দেখেছি মাত্র। তাই গোনার সময়ে আমি গুনেছি একটি ক্রিয়াপদ: পারা। বহুব্রীহির এই পর্বে চারটা ইংরেজি ক্রিয়াপদও আছে যেগুলো হোলো গেট, গোয়িং, স্টার্টিং এবং মিক্স আপ। সে সাথে আছে “অপ্রমিত” ক্রিয়াপদ যেমন জিগানো। আমি এগুলোকে অনন্য ক্রিয়াপদ হিসেবেই গুনেছি তবে “করেছি”, “করি” এবং “কইরেন” কে শুধুমাত্র “করা” ক্রিয়াপদ হিসেবে গুনেছি।
বলে রাখা ভালো যে বহুব্রীহির কোনো অফিসিয়াল স্ক্রিপ্ট নেটে নেই যেটা Breaking Bad এর আছে। যেহেতু পুরো বহুব্রীহি শুনে লেখা সেহেতু ছোটখাটো কিছু ভুল থাকতে পারে – এবং ক্রিয়াপদের গণনায়ও কিছু ভুল থাকা অসম্ভব না।
Breaking Bad এর ৩৫৭৩টি শব্দের মধ্যে মোট Unique Verb ব্যবহৃত হয়েছে ১৭০টি, শতকরার বিচারে এই পর্বের কথোপকথনে সাকুল্যে ৪.৭৫% শব্দ হোলো Unique Verb। অন্যদিকে বহুব্রীহির ৪৯২১টি শব্দের মধ্যে মোট Unique Verb ব্যবহৃত হয়েছে ৮৫টি, শতকরায় ১.৭২%। অঙ্কের হিসেবে ইংরেজি কথোপকথনে বাংলার চেয়ে ২.৭ গুণ বেশী অনন্য ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে এই উদাহরণে।
কোনো উৎসাহী পাঠক চাইলে Pronoun ও Proper Noun বাদ দিয়ে শুধুমাত্র Unique Noun নিয়েও কাজ করতে পারেন, আমার কাছে দুটো স্ক্রিপ্টই আছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ২.৭ গুণ না হলেও ইংরেজি কথোপকথনে Unique Noun ও ব্যবহার হয় বেশী।
বাংলার শব্দভাণ্ডার যে সীমিত এটা নিয়ে সম্ভবত কোনো তর্কের অবকাশ নেই। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হোলো বাংলা ভাষায় শব্দভাণ্ডারের যে দীনতা এর দায়ভার কি প্রমিত বাংলার? এবং এই অপ্রতুলতা কি আমাদের কোনো ক্ষতি করে?
হ্যা, আমি মনে করি যে বাংলা শব্দভাণ্ডারের দীনতার সাথে প্রমিত বাংলার সরাসরি যোগাযোগ আছে। প্রমিত বাংলা একান্তই শুদ্ধবাদী এবং শব্দের জন্য সে তৎসম ভাবাপন্ন। অর্থাৎ শেকড়ে সংস্কৃত শব্দের ছিটেফোটা না থাকলে প্রমিত বাংলা আড়ষ্টতা বোধ করে – প্রমিত বাংলা উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত গ্রহণবাদী না এবং আজুড়ে অভিভাবকত্বে এই ভাষা স্থবির হয়ে পড়েছে। ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে শেকড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান না (শেকড় নিজে এই কাজটা করে না – সে যেদিকেই পুষ্টি পায় সেদিকেই যাওয়া শুরু করে) – এর মাঝে নেই কোনো মহত্ত্ব, নেই কোনো পবিত্রতা এবং অবশ্যই নেই কোনো বুদ্ধিমত্তা।
এবং হ্যা, শব্দভাণ্ডারের দীনতা আমাদের ক্ষতি করে। আপনি যদি প্রচুর শব্দ না জানেন, যদি শব্দের সীমানা না জানেন তাহলে প্রথমত আপনার চিন্তা প্রসারিত হবে না এবং দ্বিতীয়ত আপনার চিন্তা ভাষায় প্রকাশের ক্ষেত্রে আপোষ করতে বাধ্য হবেন। আমি এই প্রসঙ্গে আগে যা লিখেছি সেটা এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত মনে করি।
“মৌলিক কিছু অনুভূতি ছাড়া মানুষের ভাবনা ভাষা নিরপেক্ষ না। খিদে লাগার প্রকাশ ইংরেজ, আরব কিংবা বাঙালি সবার জন্যেই এক, কিন্তু জটিলতর কিংবা বিমূর্ত কোনো বিষয় (যেমন বিজ্ঞান বা দর্শন) নিয়ে চিন্তা শুরু করলে দেখা যায় যে সেটা আপনার জানা শব্দগুলোকে ঘিরেই বাড়তে শুরু করে। আমাদের অনুভূতি ভাষাতীত হতে পারে কিন্তু ভাবনা বেশীরভাগ সময়ই না। বরং শব্দই ধরে রাখে চিন্তাকে, সূক্ষ্মতর চিন্তাকে। তাই একজন লেখক একটি নির্দিষ্ট ভাষায় শুধু লেখেনই না ভাবেনও বটে। নীরদ চৌধুরী এ কারণেই বলেছিলেন যে তিনি যখন ইংরেজিতে লেখেন ভুলে যান যে তিনি বাংলা জানেন এবং যখন বাংলা লেখেন তখন ভুলে যান যে তিনি ইংরেজি জানেন। ভাষার সাথে ভাবনার এই গাঁট-ছড়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, যে শব্দ আপনার জানা ভাষায় নেই সেই শব্দের দ্যোতক ভাবনা আপনার মগজে সহজে আসবে না (সবসময় না যদিও)। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। আপনারা যারা কোরান পড়েছেন তারা সম্ভবত “আব্দ” শব্দটা পেয়েছেন কখনো-সখনো (এই লেখকের মধ্যনামেও শব্দটি পাওয়া যাবে)। বাংলা অনুবাদে শব্দটিকে লেখা হয় দাস কিংবা গোলাম এবং ইংরেজিতে Servant অথবা Slave। দাস কিংবা Servant তার কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক আশা করে; অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে পারিশ্রমিক পাবে বলেই দাস তার কর্তব্য পালন করে। “আব্দ” এর দাসত্বে কিন্তু আরাধ্য পারিশ্রমিকের এই শর্তটি নেই। সে দাসত্ব করে ভালোবেসে। এই কনসেপ্টটি যদি আপনার মাথায়ই সর্বপ্রথম আসতো এবং প্রকাশ করতে হতো বাংলায় কিংবা ইংরেজিতে, কীইবা শব্দ ছিলো আপনার মজুদে?”
বাংলা ভাষার এই অপ্রতুলতার কি কোনো সমাধান আছে? ভাষা কোনো মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন না যে চাইলেন আর দু বছরের মধ্যে স্ট্র্যাটেজি বদল করে প্রফিট করে ফেলবেন। তবে এমনও না যে কোনোদিনও এই অভাব পূরণ করার না। দ্বিতীয় পর্বে এর সমাধান নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রথমে, আমাদের ভাষার যে সব সমস্যা অন্তর্নিহিত সে প্রসঙ্গে একমত হতে হবে – এবং জানতে হবে যে অজ্ঞতা জনিত উচ্ছ্বাস ও আহ্লাদ কেবল শিশুদেরই কাজে দেয়, আর কারো নয়।
ফাহাম আব্দুস সালাম
এই লেখার জন্য আমাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন মারুফ আল্লাম নামের এক সহৃদয় বন্ধু – তিনি পুরো বহুব্রীহি আমাকে বাংলায় টাইপ করে দিয়েছেন। জ্যোতি রহমান এবং শায়ান এস খানের কাছেও আমি ঋণী। শহীদ মিনারের ছবিটি কার তোলা খুঁজে বের করতে পারি নি – তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা।
One thought on “শেকায়েতনামা”