জিয়াউর রহমানের লেগাসি

1

Faham Abdus Salam

আপনি কী করতেন?
এক: 
২৫শে মার্চের রাতে পুরো চট্টগ্রাম এক ভয়ঙ্কর নগরী হয়ে গিয়েছিলো – কেওস, উৎকণ্ঠা আর প্রশ্নের শহর। কেও জানে না কী হবে এই জাতির? বেশীর ভাগের ধারণা শেষ করে দেবে আমাদের পাঞ্জাবীরা। সে রাতে আমি সেখানে থাকলে আমিও তাই মনে করতাম – সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক চারশ টাকার মেজর ঠিক সেভাবে চিন্তা করেন নি। সে রাতে তাকে কেউ জিজ্ঞেসও করে নি “কেমুন মেজর তুমি”। তিনি তার সিনিওর পাকিস্তানী অফিসার কমান্ডিং জানজুয়াকে হত্যা করেছিলেন আর বলেছিলেন – উই রিভোল্ট।

এই চারশ টাকার মেজরেরও কিন্তু একটা পরিবার ছিলো, ছোটো ছোটো দুটো ছেলে ছিলো, সন্তানের প্রতি মমতা আমার-আপনার চেয়ে তার হয়তো খুব কম ছিলো না। সেদিন তার জানা ছিলো না যে নয় মাসে আমরা স্বাধীন হবো। বরং তার মনেও উঁকি দিয়েছিলো শক্তিধর পাকিস্তান মিলিটারী বাঙালিদের শেষ করে দেবে। তিনি কিন্তু রাজনীতিবিদ ছিলেন না। ধরা পড়লে নির্ঘাৎ ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুবরণ।

একবার বুকে হাত দিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: আপনি কি রিভোল্ট করতেন? আজকে এই স্বাধীন বাংলাদেশের RAB এ টাকা নিয়ে মিলিটারী অফিসাররা মানুষ খুন করেন। একজনও কি উইসাল ব্লোয়ার হিসাবে বেরিয়ে এসেছে – একজনও কি বলেছে – আই রিভোল্ট?

দুই:

পৃথিবীর কোনো রাজনীতিবিদকে তার সময়টাকে মাথায় রেখে তার জুতায় নিজের পা ঢুকিয়ে চিন্তা না করলে আপনি তাকে অনুধাবন করতে পারবেন না। জিন্না, গান্ধী, বঙ্গবন্ধু এমন কি আমাদের পয়গম্বর – কাওকে আজকের পৃথিবীর মানদণ্ডে বিচার করলে আপনি কোনো সঠিক চিত্র খুঁজে পাবেন না।

প্রশ্ন আসলে একটাই: তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম?

তিন:

জিয়াউর রহমানকে অনেকেই সমালোচনা করেন তিনি রাজাকারদের প্রতিষ্টিত করেছিলেন।

বাংলাদেশে অনেকেই এখন মনে করেন যে রাজাকাররা বোধহয় সেকালে য়ুনিফর্ম পরে ঘুড়ে বেড়াতেন এবং যারাই রাজাকার তারাই যুদ্ধাপরাধী। ব্যাপারটা এতো শাদাকালো ছিলো না। এবং এমন মনে করার কোনো কারণ নেই ৭১ এ রাজনৈতিক পাকিস্তান কনসেপ্টটাকে ধারণ করেছিলো মাইক্রোস্কোপিক একটা জনগোষ্ঠী। হ্যা – যুদ্ধাপরাধী মানের রাজাকার হয়তো নগন্য সংখ্যক ছিলো কিন্তু মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করা লোক নেহাৎ কম ছিলো না। তারপর ছিলো সেসময়ের পাকিস্তান রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণী। নাম করতে চাই না – সে সময়ের দলিল দস্তাবেজ একটু ঘেঁটে দেখবেন, কোন সব রথী মহারথীরা ৭১ সালে – হ্যা ৭১ সালেও পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

এই মানুষগুলো একটা বিশেষ সময়ের প্রোডাক্ট ছিলেন, তাদের যখন যৌবন তখন অনেকেই লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করেছিলেন, অনেকেই কলকাতার দাঙ্গা দেখেছিলেন – তাদের পলিটিকাল আইডিয়োলজিতে মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্যারামাউন্ট ছিলো। সময়ের প্রয়োজনে তারা তাদের আইডিয়োলজি বদলাতে পারেন নি। ৮০’র দশকে ছাত্রলীগের যে তরুণ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলো তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন যে আজকে জাপার সাথে লীগের আঁতাত তারা মেনে নিতে পেরেছেন কি না? আমরা বাঙালিরা আমাদের পলিটিকাল আইডিয়োলজি বদলাতে পারি না। আমাদের পলিটিকাল বিলিফ বেশীরভাগ সময়েই রিলিজিয়াস বিলিফের মতোই অনড়।

আপনি পারতেন?

তার মানে কিন্তু এই না যে পাকিস্তানে বিশ্বাস করা মানুষজন সব অপরাধী ছিলেন। আব্দুলাহ আবু সায়ীদ নিষ্ফলা মাঠের কৃষকে সে সময়ের ইংরেজির ব্রিলিয়ান্ট প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, সমালোচনা করেছেন বিস্তর – কিন্তু এটাও বলেছেন যে এরা ছিলো বিশ্বাসের শহীদ – তাদের বিশ্বাস ভুল ছিলো কিন্তু ব্যক্তি জীবনে উচ্চ আদর্শের মানুষ ছিলেন। আমাদের আজকের মতো চোর-ছ্যাচ্চর-গুণ্ডা ছিলেন না।

প্রশ্ন হোলো আপনি যদি দেশ প্রধান হতেন এবং যেকালে হারিকেন জ্বালিয়ে একটা গ্র্যাজুয়েট পাওয়া যেতো না সেকালে এই ভিন্ন বিশ্বাসের মেধাবী লোকগুলোকে জাতি গঠনের কাজে লাগাতেন কি না? জিয়াউর রহমান কিন্তু আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করা সদ্য প্রয়াত এ বি এম মুসাকেও প্রেস কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন। আমার আপনার জন্য আজকে এটা একটা ফিলোসফিকাল ডিসকাশন কিন্তু জিয়াউর রহমানের কিন্তু সেই লাক্সারী ছিলো না – তার জন্য সেটা ছিলো জাজমেন্ট কল। মনে রাখবেন, আজকাল যে মাপকাঠিতে রাজাকারিত্ব মাপা হয় সে মাপকাঠিতে মুনীর চৌধুরী ও তার ভাই কবীর চৌধুরীকে অনায়াসে রাজাকার বলা যায়। নিজেকে প্রশ্ন করুন কবীর চৌধুরীর মতো মেধাবী লোককে শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের দেয়া কি ঠিক হতো?

আজকে আপনার প্রতিষ্ঠানে জামাতের লোক নেবেন না, বিএনপির লোক নেবেন না – এমন সিদ্ধান্ত নিয়েও হয়তো প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন কারণ যোগ্য লোকের কমতি থাকলেও চেষ্টা করলে খুঁজে বের করা সম্ভব। সত্তর এর দশকে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটাতে সেটা সম্ভব ছিলো কি?

আর হ্যা – জিয়াউর রহমান কোনো দুর্নীতিবাজ কিংবা গুন্ডা-বদমাশদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কে? জিয়া কিংবা বঙ্গবন্ধুর চেয়েও হাসিনা অনেক বেশী একচ্ছত্র ক্ষমতা উপভোগ করেছেন। জিয়া যেমন চেরী পিক করে য়াং প্রফেশনালদের রাজনীতিতে এনেছিলেন সে সুযোগ হাসিনাও পেয়েছিলেন – তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন কি? তার নিজের দলেই জিয়া কোনো শামীম ওসমানকে ঠাই দিয়েছিলেন কি?

চার:

জিয়াউর রহমান বহু নিরপরাধ সামরিক কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন।

একটু অন্যভাবে দেখা যাক।

আজকের ছাত্রলীগ কী ধরনের প্রতিষ্ঠান বোধ করি সেটা কাওকে বুঝিয়ে দেয়ার দরকার নেই। একবার চিন্তা করুন তো শেখ হাসিনা যদি সত্যিই ছাত্রলীগকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন তাহলে তাকে কী করতে হবে? প্রথমত খুন খারাবীতে জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা দিতে হবে, দ্বিতীয়ত ছাত্রলীগের হয়ে করা সব ধরনের অপরাধের কঠোর শাস্তি দিতে হবে এবং পুরা ছাত্রলীগের কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে নতুন করে সাজাতে হবে। সম্ভবত কট্টরতম লীগ সমর্থকও আমার সাথে এ ব্যাপারে একমত হবেন। এখন বলুন ছাত্রলীগের প্রত্যেকেই কি অপরাধী? প্রত্যেকেই কি সাজা পাওয়ার হকদার? কিন্তু ম্যাসিভ রিস্ট্রাকচারিং এ বহু নিরপরাধীকেও দণ্ডি দিতে হয়, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

মিলিটারীর যখন কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে যায় তখন কিন্তু বিপদ হয় ছাত্রলীগের চেয়েও হাজার গুণ বেশী কারণ তাদের কাছে অস্ত্র থাকে এবং সেটা ব্যবহার করতেও তারা সক্ষম।

৭৫ সালে যারা মিলিটারীতে চাকরি করেছেন তাদের একবার হলেও জিজ্ঞেস করে দেখুন জিয়া কী ইনহেরিট করেছিলেন। ইট ওয়াজ এ ব্লাডি মেস। একজন আর্মি অফিসারের সাথে দশজন আছেন বাস তিনি মনে করে বসলেন যে তার কু করা প্রয়োজন। আজকের দিনে যেমন DSLR থাকলে বানরও নিজেকে ফটোগ্রাফার মনে করে। এরকম অবস্থায় কমান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য নির্মম হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো কি? মিলিটারীতে কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে পড়লে সুশীল উপায়ে ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে আনার কোনো রাস্তা নেই, আপনাকে রুথলেস হতেই হবে। সেদিন এই কাজটা জিয়া না করলেও অন্য কাওকে ডার্টি জবটা করতে হতো, করতেই হতো। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই, সেদিন যারা মিলিটারীতে চাকরি করতেন তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন – যে মিলিটারী নিয়ে আমরা আজকে গর্ব বোধ করি সেই কমান্ড-বেজড মিলিটারী জিয়াউর রহমানের রুথলেস এপ্রোচ ছাড়া সম্ভব হতো কি?

তিনি কি নির্ভুল ছিলেন? অবশ্যই না। ভুক্তভোগীরা বলবেন যে তিনি অপরাধ করেছিলেন। কিন্তু ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি না করলে মিলিটারীতে প্রাতিষ্ঠানিক ডিসিপ্লিনের বদলে ব্যক্তিগত ক্যারিজমা-ভিত্তিক যে কাল্ট গড়ে উঠছিলো বিপজ্জনক হারে সেটাকে প্রতিহত করার আর কী বিকল্প ছিলো? রিয়ালিস্টিকালি চিন্তা করে দেখুন। পৃথিবীর ইতিহাস ঘেঁটে বলুন কোন দেশে মিউটিনি গোছের বিশৃঙ্খলা শক্ত হাতে ক্রাশ না করে ফিরে এসেছে?

পাঁচ: 
জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় লেগাসি কী?

দুটো: প্রথমটা হলো তিনি এই জাতিকে য়ুনিফাই করার চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন ধারার রাজনীতির একটা স্পেস তিনি তৈরী করেছিলেন। এই কাজটা মিলিটারী ডিক্টেটররা কখনোই – আবারো বলছি – কখনোই করেন না। এজন্যে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। হাসিনার মতো আদিম যুগের মানুষও যদি এই বহুধা বিভক্ত দেশকে “এক” করতে পারেন বিশ্বাস করুন আমি তার পিছে দাড়াবো, তাকেই আমার নেতা মানবো। আমি বঙ্গবন্ধুকেও বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখি কারণ তিনি এই কঠিন কাজটা করতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি সেই একতা ধরে রাখতে পারেন নি তাও আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। বাঙালিকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা করা দুঃসহ কঠিন কাজ।

দ্বিতীয়টা বলছি। বাংলাদেশের যেকোনো নেতা – এই রিয়ালী মীন ইট – যে কোনো নেতার ভিডিও ফুটেজ লক্ষ্য করুন। দেখবেন যে তারা বক্তৃতা দিচ্ছেন। মাঠে ঘাটে জনসভায় টিভিতে বক্তৃতা দিচ্ছেন নয়তো তর্ক করছেন।

একমাত্র ব্যতিক্রম জিয়াউর রহমান। তার ভিডিও ফুটেজে দেখবেন যে তিনি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছেন – গ্রামে গঞ্জে শহরে। হি ওয়াজ এ ডুআর। জিয়াউর রহমান সত্যিই ওয়াট এভার ওয়ার্কস এ বিশ্বাসী ছিলেন।

বাংলাদেশে এ ধরনের নেতা একেবারেই বিরল। আপনি যেই আদর্শের রাজনীতিই করুন না কেন এই লেগ্যাসি দুটো হয়তো কাজে দেবে।

One thought on “জিয়াউর রহমানের লেগাসি

  1. আরেকটি ব্যাপার আছে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে উনার চরম আর্থিক সততা। এটা আজ বিএনপি এবং বিএনপির বাইরে কারোই নাই।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s