ক্লাস ফোর সিন্ড্রোম

by Jahid Islam

বাড়িতে আমাদের একজন প্রতিবেশী আছেন যার মেয়ে ২০১২ সালে ক্লাস ফোরে পড়ত। সম্পর্কে উনি আমার ভাই হন। মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা হয়, কুশল বিনিময় এবং হালকা কথাবার্তা হয়। উনার সাথে কয়েকদিন কথা বলার পর একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে উনি আমার সাথে গল্প করার সময় পর পর তিন দিন উনার ক্লাস ফোরে পড়া মেয়ে পড়াশুনায় কত ভাল সেটা নিয়ে বিস্তারিত বললেন।

প্রথম দিন ধৈর্য ধরে শুনলাম। এরপর আবার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিন প্রায় একই কাহিনী। সাথে যুক্ত হল ক্লাস ফোরের পড়া এখন কত কঠিন এবং এরপরও তার মেয়ে কত অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে একের পর এক প্রতিবন্ধতকতা অতিক্রম করে ভাল করে চলেছে এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ। আমি নিশ্চিত এরকম অভিজ্ঞতা আরও অনেকেরই হয়েছে। এটা একটা মজার সিম্পটম। জাতি হিসেবেই আমরা সামান্য জিনিসকে অসামান্য করে দেখার এই ‘ক্লাস ফোর সিন্ড্রোম’ এ আক্রান্ত।

আপনি ইউরোপ আমেরিকায় খোজ নিলে দেখবেন যে হিমালয় বিজয় বা বাংলা চ্যানেলের মত জিনিস বিজয়ীর সংখ্যা হাজার হাজার । কিন্তু আমাদের প্রায় ১৮০ মিলিয়ন লোকের একটা দেশে এটা এতই বড় একটা খবর যে, দিনের পর দিন এ ঘটনা পত্রিকার প্রথম পাতা দখল করে রেখেছে। মুসা ইব্রাহিম তার এই অসামান্য (!) অর্জন নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কলাম লিখেছেন, স্টার হয়েছেন। এখন আবার তার বিরুদ্ধে একের পর এক জালিয়াতির অভিযোগ আসছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে যাব না। কারণ বাংলাদেশে যে কারও পেছনে এক দল শয়তান পিছু নিলে সহজে ব্যক্তির সম্মানহানি করতে পারে। আর আমরা যে মানি লোককে খুব মান দেই ব্যাপারটা এমনও না এবং ড. ইউনুস হতে পারেন এর আদর্শ দৃষ্টান্ত ।

তবে এই যে ইতিমধ্যে লাখ বার জয় করা হিমালয় জয় নিয়ে এত বিতর্ক কিংবা বাংলা চ্যানেলের মত একটা জিনিসের জয় নিয়ে এত মাতামাতি এবং এখন এত বিতর্ক, এটা প্রমাণ করে যে আমরা সামান্য জিনিস নিয়ে মেতে থাকতে কত পছন্দ করি ! অথচ এত বিরাট জনসংখ্যার একটা দেশে আন্তর্জাতিক কোন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রায় কোনই অর্জন নেই। লাখের ঘরে জনসংখ্যা ইউরোপের এরকম অনেকে দেশের অর্জন আমাদের চেয়ে বেশী। এমনকি আফ্রিকার গরীব দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশ অলিম্পিকের মত গেমসের বিভিন্ন ইভেন্টে নিয়মিত গোল্ড জেতে। এত বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে আমাদের মত অর্জনহীন দেশ দুনিয়াতে কম আছে ।

একটা সামান্য জিনিসকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একসাথে “ইউরেকা ইউরেকা” বলে লাফিয়ে এরপর এটাকে জাতীয় গর্বে (!) পরিণত করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

ইউরোপ আমেরিকার স্কুল বালকেরা এরকম চ্যানেল জয়ের কাজ প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে করে থাকে এবং সেটা তাদের যে কারও কাছে কাছে এতই স্বাভাবিক যে সে তার বন্ধুর সাথেও এটা শেয়ার করার প্রয়োজন মনে করে না। আমরা যে বড় হতে পারি না এর অন্যতম একটা কারণ আমাদের টার্গেট ছোট, চিন্তাও ছোট। সামান্য জিনিসকে বিরাট মাইলস্টোন মনে করি।

আমরা করি নাক ফোঁসফাঁস টাইপ জাতি। প্রতিদিন কম্পক্ষে তিন-চার ঘণ্টা সময় ব্যয় করে রান্না করি এবং ভাত খেয়ে দুপুরে আরাম করে ঘুমাই। প্রোডাক্টিভ কাজের দিক থেকে আমরা দুনিয়ার অন্যতম আন-প্রোডাক্টিভ জাতি (কেবল আরবরাই আমাদের চেয়ে উপরে আছে বলে আমার মনে হয়)।

গত দশ বছরে কোন ভাল সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন না থাকার পরও এ দেশের সেরা বিজ্ঞানী ড.জাফর ইকবাল ! এ দেশে ফুটবল/ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ইয়ুনিভারসিটি বন্ধ থাকে যেটা অস্ট্রেলিয়া বা হল্যান্ডে হয় না যদিও তারা কেউ ক্রিকেটের এবং কেউ ফুটবলের পরাশক্তি। সামান্য এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস (কে প্রথম প্রেসিডেন্ট/কে স্বাধীনতার ঘোষক, কার ব্লাউজের দাম কত) নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে মজা নিতে আমরা উস্তাদ।

সামান্য জিনিসকে অসামান্য করে উপস্থাপনের এই ‘ক্লাস ফোর সিন্ড্রোম’ যত দিন থাকবে তত দিন মুসা ইব্রাহিম’রা হয়ে থাকবেন এ দেশের স্টার। তাদেরকে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে কথা হবে এবং এটা বলে মজা নেয়াই হবে আমাদের পরম প্রাপ্তি !

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s