By: Aman Abduhu
‘একাত্তর ইস্যুতে/ মানবতা মুছে ফেলো টয়লেট টিস্যুতে’ স্লোগানটা বহু বছর আগে ব্লগে প্রথম দেখেছিলাম। চমকে উঠেছিলাম। আজ এতো বছর পরও মনে পড়ে, প্রথমবার দেখে সেদিন কেমন থমকে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো এর জের বহুদূর টানতে হবে বাংলাদেশকে। একটা গোষ্ঠীর চিন্তার প্রকাশ যদি এমন হয়, এবং তা সমাজের শিক্ষিত অংশের মাঝে সমাদৃতও হয়, তবে তার পরিণতি কারো জন্য ভালো হওয়ার কথা না। হয়ওনি। এরপরের বছরগুলোতে শাহবাগিদের প্রিয় সে স্লোগানটা বিভিন্ন উপলক্ষে বারবার, অসংখ্যবার মনে পড়েছে। আজ আবার মনে পড়লো বিহারী পল্লীর হত্যাকান্ডের ঘটনায়।
ঢাকার বিহারী পল্লীতে যুবলীগ নেতাদের নেতৃত্বে উম্মত্ত জনতা আগুনে পুড়িয়ে আর পুলিশ গুলি করে এগারো জন মানুষকে মেরেছে। বেশিরভাগ শিশু আর নারী। শবে বরাতের রাতে আতশবাজি জ্বালানোর মতো তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে। এবং তারপর বীর বাঙালী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উল্লাসে ফেটে পড়ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলায় জিতে আবার মুক্তিযুদ্ধ জয়ের মতো অর্বাচীন সে উল্লাস। সবার সে কি আনন্দ। নিজের অপরাধবোধ আর পশুবৃত্তিকে ঢেকে রাখার কি নিদারুণ চেষ্টা। বিহারী মারলে অসুবিধা নেই। বরং ভালো হয়েছে। এরা স্বাধীনতার শত্রুদের বংশ। এগুলোকে এভাবেই মারা দরকার!!
বাঙালীর এ আনন্দ-উল্লাস দেখে মনে পড়ে বইয়ে পড়া গহীন অরণ্যের আদিম নরখাদক জংলী গোষ্ঠীর উল্লাসের কথা। আগুনে পোড়ানো হচ্ছে কিছু নারী আর শিশুকে। তাদের চামড়া পুড়িয়ে আগুন আরো ভেতরে যাচ্ছে, জ্বালাচ্ছে। চুল পুড়ছে, হাত পুড়ছে, পা পুড়ছে। শ্মশানের পাশে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, সেই মাংসপোড়া গন্ধ ভাসে বাতাসে। আর তাদের চারপাশ ঘিরে ফেসবুকের জঙ্গলে উল্লাসে হৈ হৈ করে নাচছে, লাফাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আপ্লুত বাঙালীর দল। আদিম সেই উল্লাস, খাদ্য জুটছে তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ অন্ধ মনের।
একাত্তরের চেয়ে মানবতা অনেক বড় একটা বিষয়। আর কয়েক জেনারেশন পর একাত্তর স্রেফ অতীতের একটা ঘটনা হয়ে যাবে। কয়েকশ বছর পরে থাকবে বই এর পাতায়। কিন্তু পৃথিবীর শেষ মানুষটা বেঁচে থাকা পর্যন্ত মানবতা একটা দরকারী বিষয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী একাত্তরে মানবতার তোয়াক্কা করেনি বলেই তারা এতো ঘৃণিত।
বিহারী পল্লীর এ ঘটনায় একাত্তর কোনভাবে প্রাসঙ্গিকই না। তারপরও তা টেনে এনে নাচানাচি করা বিকৃত মানসিকতা। যে বিকৃতি আজ বাংলাদেশে মহামারীর মতো। আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বুদ্ধিজীবি আর শাহবাগির দল সে বিকৃতিকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের বড় একটা অংশের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। হেডোনিস্টিক ভোগবাদি জীবন যাপনের পাশাপাশি এইধরণের খেলা বা খুনের ঘটনায় এরা দেশপ্রেমের দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি পায়।
তাই গত কয়েকবছর ধরে যে অবিচার আর অমানবিকতা চলে আসছে, তাতে মানুষের আর বিকার হয় না। পুলিশ যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নির্বিকার খুন করে ফেলতে পারে, ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারে, গুম করতে পারে, কোন বিচার নাই। ছাত্রলীগ যুবলীগও যা ইচ্ছা খুন ধর্ষন চালিয়ে যেতে পারে, কোন সমস্যা নাই। বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারা ছাত্রলীগ নেতা সবার সামনে উঁচু গলায় তার পরিবারকে জানিয়ে দেয়, সমস্যা হবে না কোন। গ্রেফতার টেফতার এগুলো ফরমালিটিজ। নারী শিশুদেরকে পুড়িয়ে মারার পর সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হাসিমুখে বলতে পারে, এটা নিছক দুর্ঘটনা। একই দিনে শেখ হাসিনার কথা বলার বিষয় হলো খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদগার। বিহারী পল্লীতে না হয়ে এতজন মানুষ ক্যান্টনমেন্টে মারা গেলে হাসিনা দৌড়ে যেতো, তাদের পরিবারের ভরণপোষনের দায়িত্ব নেয়ার রেডিমেইড নাটকও মঞ্চস্থ হয়ে যেতো এতোক্ষণে।
সমসাময়িক বাংলাদেশে মানবতার এ দুর্দশা শুরু হয়েছিলো আঠাশে অক্টোবরে পল্টনে লগি-বৈঠার সেই ঘটনায়। যেদিন হাসিনার নির্দেশের ফলে মানুষকে আর মানুষের সম্মান দেয়া হয়নি। পশুর মতো পিটিয়ে মারা হয়েছে, প্রকাশ্য দিবালোকে। এবং তার কোন বিচার হয়নি। সে ঘটনার মানসিক প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। আওয়ামী মাফিয়া লীগের লোকজন জেনে গেছে, তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। প্রফেশনাল দুবৃত্ত, চোর-ডাকাত, খুনী-ছিনতাইকারীরা বুঝে নিয়েছে, আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে তাদের প্রফেশনাল কাজকর্মের কোন সমস্যা নাই। মীরপুরের ঘটনা এলাকার যুবকদের মারামারি হলেও, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে যুবলীগ নেতা রানা, সেন্টু, শরিফুল। বাংলাদেশে এখন কোন ঘটনাই রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়া ঘটে না।
কোন একজন মানুষও কি মনে করেন, এ ঘটনার কোন বিচার হবে? এভাবে নারী আর শিশুদেরকে পুড়িয়ে মারলো যারা, তারা শাস্তি পাবে?
বরং আঠাশে অক্টোবরের সে ঘটনা থেকে শুরু করে বড় বড় ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার না হলে, আজকের বিহারী পল্লীতে ঘটে যাওয়া এই ধরণের গণউন্মাদনার মতো পশুবৃত্তি কখনোই বন্ধ হবে না। কাল বিহারী পল্লীতে এগারোজন মরলো। কয়েকবছর আগে শবে বরাতে আমিনবাজারে ছয় ছাত্র মারা গিয়েছিলো। কয়েক বছর পরে অবশ্যই আমি আপনি মারা যাবো। আগুনে পুড়তে পুড়তে, অথবা মব হিস্টিরিয়ার গণপিটুনিতে দুমড়ে মুচড়ে হোক, কিংবা আওয়ামী দুবৃত্তদের উদ্ভাবিত নতুন কোন উপায়ে। আর গণভবনে বসে রক্তপিপাসু ডাইনী হাসিনা এসব মৃত্যুর খবর পেয়ে সবার সামনে চোখের পানি দেখানোর আগে জিন্দেগী জিন্দেগী গানের তালে একটু নেচে নেবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা!! হাহ!
ফুটনোটঃ একাত্তর নিয়ে আমরা যেই সরল গল্প-কাহিনী জানি, তার বাইরেও কিছু অলটারনেটিভ কথা আছে। আজকের বাঙালীদের এ উল্লাস দেখে মনে হয়, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের লেখা ‘একাত্তরের স্মৃতি’ বইয়ে যুদ্ধের আগে বিহারীদের উপর গণহত্যা চালানোর যে ঘটনাগুলো আছে, তা সত্যও হতে পারে। আমাদের বাবা-দাদারাই তো ছিলেন।