অবহেলিত জনপদের দগ্ধ ওরা বিহারী? না কি মানুষ?

by Elora Zaman

একদিন গিয়েছিলাম বেনারসী পল্লীতে শাড়ি কিনতে। ঝলমলে দোকান পাট! রঙীন সব শাড়ি। কত নারী তার বাসর সাজিয়েছে ঐসব লাখ টাকা দামী শাড়ি দিয়ে। জীবন শুরু করেছে ওখান থেকে। বিত্তশালী সব নারীরা, সুনীলের চৌধুরীদের সূবর্ণ কঙ্কন পড়া রমণীদের মতো। দোকানী বললো, আপা! কারিগর শাড়ি দিতে দেরী করতেছে। দেইখ্যা আসি, কি অবস্থা।

আমার অতিউৎসাহী মন দোকানীর সাথে যেতে চাইলো। বললাম, আমায় নিয়ে চলেন। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে দোকানী হেসে বললো, যাইবেন? আচ্ছা চলেন। কিন্তু সহ্য করতে পারবেন তো? আমিও একগাল মিষ্টি হেসে বললাম, সহ্য করতে পারবো। আমি গরীবের মেয়ে, সব সহ্য করতে পারি। অসুবিধা নাই। চলেন।

কিছুদূর হেঁটেই দেখলাম ঝুপড়ির মতো ছোট ছোট ঘর। সোজা হয়ে হাঁটা যাচ্ছিলো না, নিচু হয়ে পাশ কেটে হাঁটতে হচ্ছিলো। এতোসব চিপা গলি, নোংরা, দুর্গন্ধ। কারিগরের রুমে ঢুকে খেলাম এক বিশাল ধাক্কা। দেখলাম ঘামে ভেজা কিছু উদোম শরীর। দরদর করে ঘাম পড়ছে সেইসব বারো-তেরো বছরের বিহারী কিশোর ছেলেদের শরীর থেকে। ওরা কাজ করে যাচ্ছে। সুতো টেনে টেনে, খটখট। অগ্নিকুন্ডের মত অবস্থা, তেল চিটচিটে লুঙ্গি গামছা! আমি বাহানা করে বেরিয়ে এলাম, সহ্য করতে পারছিলাম না। বাইরে এসে ভাবলাম, এরাও কি মানুষ?

পৃথিবীর সবচাইতে অবহেলিত একটি জনপদকে দেখে কষ্ট লেগেছিলো। কিন্তু ভুলে গেলাম অতি দ্রুত তার পাশেই ঝলমলে ডাউনটাউন দেখে। আজকে আবার মনে পড়লো সেই বিহারী পল্লীর কথা।

মীরপুরে এগারোজন মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে আর গুলি করে মেরে ফেলার খবর পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। তারচেয়ে বেশি হতবাক হয়েছি এ ঘটনার পর বাংলাদেশের মানুষদের বিশাল একটা অংশের প্রতিক্রিয়ায়। আমরা কি সভ্য মানুষ? অথবা ‘মানুষ’ শব্দটা দিয়ে পরিচিত হওয়ার যোগ্য? এটা কি দুইহাজার চৌদ্দ সাল?

আজকের সময়ে এমন নৃশংস একটা ঘটনায় কেউ জংলী ক্যানিবাল ট্রাইবের মতো আনন্দ প্রকাশ করে কিভাবে? যারা এমন করছে, এরা তো আমাদেরই আশেপাশের মানুষ, ভাই-বোন-বন্ধু-আত্মীয়। আমরা কি ধরণের মানুষদের সাথে বসবাস করছি! পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে নিরব সমর্থন দিয়েছে। কেন দেবেনা? যুবলীগ ছাত্রলীগের ছেলেদের কাজে বাঁধা দেবে, এমন সাহস আর ক্ষমতা কি পুলিশের আছে না কি?

কতটা অসহিষ্ণু এবং উন্মাদ হয়ে গিয়েছি আমরা? শিশু সহ যে মানুষগুলো পুড়ে মারা গেলো, তাদের জায়গায় আমরা নিজেরা অথবা আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজন থাকলে তখন কেমন লাগতো? বাচ্চাগুলো আর বড় হওয়ার সুযোগ পেলোনা। নিরপরাধ নারীরা অভাব-অনটনের সংসারের ভেতরেও বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পেলো না।

দেশে যেহেতু কোন অন্যায়ের বিচার নেই, সরকারী দলের লোক হলে তাদের যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা আছে, তারা তাদের এলাকার স্থানীয় মারামারিতে ক্ষমতার প্রকাশ দেখালো। সেই ক্ষমতায় দেয়া আগুনে কার্বন মনোঅক্সাইড বিষে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে, একটু একটু করে শরীর পুড়ে গিয়ে, বিকৃত হয়ে মারা গেলো দশজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।

এরপর শুরু হলো এরচেয়ে বড় উন্মাদনা, পাশবিক উন্মত্ততা। শিক্ষিত ও রুচিশীল মানুষেরা এ ঘটনাকে সমর্থন করা শুরু করেছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নাম দিয়ে যে পাগলামি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সারা দেশে, এর শেষ কোথায়? সত্যিই কি এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

আসলেই কি একটা জাতির মুক্তির সংগ্রাম এরকম ঘৃণা আর অমানবিকতার ভিত্তিতে ঘটতে পারে? বিশ্বাস করিনা। বরং এ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো আওয়ামী-শাহবাগিদের চাষাবাদ করা ঘৃণার জমিন। এ ঘৃণা আর বিভেদের আগুন বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যতকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিচ্ছে।

সব ছাড়িয়ে বারবার মনে হচ্ছে, নিরপরাধ মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে পারিনা কেন আমরা? কেন পারিনা ঘৃণিত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে? আমাদের চেয়ে বেশি রেইসিষ্ট জাতি কি আর কোনটা আছে? ধিক আমাদের! বাংলাদেশী পরিচয় দিতে লজ্জা হয় আজ!

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s