মধ্যপ্রাচ্য, যুদ্ধ ও শান্তি…

by WatchdogBD

জানুয়ারি ৩, ২০০১ সাল। হোয়াইট হাউস হতে ঘোষণা এলো মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান পাওয়া গেছে। ঘোষণার সমর্থনে ইসরায়েলই কর্তৃপক্ষও ঘোষণা দিল সতর্ক আশাবাদের। অন্য ক্যাম্প হতেও স্বীকার করা হল ত্রি-পক্ষীয় বুঝাপড়ার। এর আগে ২৩ সে ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন চারদিনের সময় দিয়ে দরকষাকষি করা যাবেনা এমন একটা প্রস্তাব উত্থাপন করেন শান্তি আলোচনায়। প্রস্তাবের সারমর্ম ছিলঃ প্যালেষ্টাইনিরা পশ্চিম তীরের শতকার ৯৬ ভাগের দখল পাবে, বাকি চার ভাগ যাবে ইসরায়েলদের দখলে। পূর্ব জেরুজালেমে বসতি-স্থাপনকারী ইহুদিদের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা পাবে ইসরাইল, বাকিটার দখল পাবে প্যালেস্টাইনই কর্তৃপক্ষ। জর্ডান ভ্যালিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে অস্থায়ী ভাবে অবস্থান করবে ইসিরায়েলি বাহিনী এবং প্যালেস্টাইনই গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনটা আর্লি ওয়ার্নিং ক্যাম্প গড়ার অধিকার থাকবে ইসরাইলের। বিনিময়ে প্যালেষ্টাইনিদের হাতে পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে তাদের আকাশ সীমার। উদ্বাস্তুরা ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার অধিকার হারাবে। তবে প্যালেস্টাইনে ফিরতে তাদের কোন বাধা দেয়া হবেনা। প্রস্তাবে গাজা উপত্যকার ভাগ্য নিয়ে কোন কিছু উল্লেখ না থাকায় প্যালেষ্টাইনিরা তা প্রত্যাখ্যান করে। জানুয়ারির ৭ তারিখ ক্লিনটন অফিস হতে ঘোষণা দেয়া হয় গাজা হবে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাউন্টার প্রস্তাবে ইসরাইল গাজা ভ্যালিতে তার অবস্থান স্থায়ী করার প্রস্তাব করে। স্বাক্ষর করার জন্য কলম হাতে নিয়েও পিছিয়ে যান পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত। অজুহাত হিসাবে প্যালেস্টাইনই জনগণকে সামনে আনেন এবং দাবি করেন এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নিলে তার নিজের জনগণই তাকে হত্যা করবে। পিছিয়ে যান ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইয়াহুদ বারাক। কারণ এক মাস পরেই ছিল দেশটার সাধারণ নির্বাচন এবং সব ইঙ্গিত বলছিল ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত হবে ক্ষমতাসীন দল। ফলে যা হবার তাই হল, ভেস্তে গেল শান্তি আলোচনা। এক মাস পর ইসরাইলে ক্ষমতাসীন হল কট্টর রক্ষণশীল দল লিকুদ পার্টি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন বৈরুত ম্যাসাকারের অন্যতম জল্লাদ আরিয়েল শ্যারন। ওদিকে গাজায় শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে জঙ্গি হামাস ও ইসলামিক জিহাদ।

এর আগে ২০০০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার গ্রীষ্মকালীন অবকাশ ভবন ক্যাম্প ডেভিডে আমন্ত্রণ জানান মধ্যপ্রাচ্যের বৈরী দুই পক্ষকে। ঐ আলোচনায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইয়াহুদ বারাক পশ্চিম তীরের ৫-১০% দাবি করে অবৈধ সেটেলারদের শতকরা ৮৫ ভাগ নিজেদের দখলে রাখার প্রস্তাব করেন। সমস্যা দেখা দেয় পূর্ব জেরুজালেম নিয়ে। শহরের ঘন ইহুদি বসতি সম্পন্ন এলাকা ইসরাইলের এবং আরব বসতি এলাকা প্যালেস্টাইনদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রস্তাব করেন। উদ্বাস্তুদের ইসরাইল ফিরে যাওয়ার অধিকার স্থায়ীভাবে বাতিল করার পরিবর্তে ইয়াহুদ বারাক ক্ষতিপূরণ হিসাবে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু আবারও থেমে যান ইয়াসির আরাফাত। পালটা কোন প্রস্তবা দিতে ব্যর্থ হন। ভেস্তে যায় ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা। অনেকের ধারণা ইয়াসির আরাফাতের নিষ্ক্রিয়তার মূলে ছিল গাজায় হামাসের সশস্ত্র শক্তি মহড়া। পৃথিবীর মানচিত্র হতে ইসরাইলকে মুছে ফেলার অলৌকিক ও জেহাদি দাবি নিয়ে গাজা-বাসীকে নিজেদের ছায়াতলে সমবেত করতে সক্ষম হয় হামাস। এ ধরনের বায়বীয় প্রস্তাবে গোপন সমর্থন যোগায় মোল্লাদের ইরান ও লেবাননের তাদের সমর্থক হিজবুল্লাহ।

এভাবে যুগের পর যুগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে প্যালেস্টাইন সমস্যা। নিজদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মাঝে মধ্যে অকার্যকর রকেট ছুড়তে বাধ্য হয় হামাস। ১২ হতে বিশ বছরের তরুণ তরুণীদের বুকে বোমা বেধে পাঠিয়ে দেয় ইসরাইলের অভ্যন্তরে। ঘন লোকালয় অথবা যানবাহনে নিজদের উড়িয়ে দেয়। সাথে নিয়ে কিছু সাধারণ ইসরাইলিদের জীবন। জেগে উঠে ইসরাইলী দানব। স্থল ও আকাশ পথে শুরু হয় তাদের নির্মম ও পৈশাচিক আনাগোনা। শিশু, কিশোর ও মহিলা নির্বিশেষে পশুর মত হত্যা করতে শুরু করে প্যালেষ্টাইনিদের। এসব হামলার পেছনে নীরব সমর্থন থাকে প্রতিবেশী দেশ মিশর ও জর্ডানের। কারণ প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে গিয়ে তারা নিজেরাও ক্ষতবিক্ষত। ইসলামের ধ্বজাধারী মধ্যপ্রাচ্যের রাজা বাদশার দল পৃথিবীর দেশে দেশে ইহুদিদের সাথে বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে সূরা ও সাকির তৃষ্ণা মেটাতে প্রকারান্তে সহযোগিতা করে থাকেন ইহুদি রাষ্ট্রের অর্থনীতির ভীতকে। যার ফলাফল দেখা যায় ইসরাইলীদের সমরশক্তিতে।

হিটলারের পাপের ফসল আজকের ইসরাইল। ইউরোপের এই ক্যান্সার মধ্যপ্রাচ্যে রফতানির মাধ্যমে নিজদের ‘রোগমুক্ত’ করার কাজে মূল অবদান ছিল ব্রিটিশদের। অস্ত্র হিসাবে তারা ব্যবহার করেছে জাতিসংঘকে। ইসরাইলী নারকীয় তাণ্ডবের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়রা বরাবরই সোচ্চার ছিল। কিন্তু আল কায়েদার নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও মাদ্রিদ হামলার পর বদলে যায় নন-মুসলিম বিশ্বের মন-মানসিকতা। আজকের দুনিয়ায় মুসলমানদের অন্যতম পরিচয় তারা জঙ্গি, দাঙ্গাবাজ এবং আলোচনার টেবিলে সমস্যা সমাধানে অনিচ্ছুক একটা ধর্ম। বলাই বাহুল্য দেশে দেশে আল-কায়েদার মত জঙ্গি সংগঠনের অপ-তৎপরতার আসল ফসল ঘরে তুলছে ইসরাইল। টেবিল হতে আর্কাইভে স্থান পেয়েছে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা। ২০০০ সালে প্যালেস্টাইনই নেতা ইয়াসির আরাফাতকে যে মানচিত্র অফার করা হয়েছিল তার চার ভাগের একভাগও অফার করতে রাজী নয় আজকের ইসরাইল। পাশাপাশি গাজা উপত্যকায় ক্ষমতাসীন রয়েছে ইসরাইলকে পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মিশনে ব্যস্ত হামাস।

ইহুদি তাণ্ডবের দায়-দায়িত্বের একটা বিরাট অংশ নিতে হবে প্যালেস্টাইনই নেত্রীবৃন্দকে। সুযোগ পেয়েও তারা শান্তিকে প্রধান্য দেয়নি। বরং সমস্যা জিয়িয়ে রেখে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করে গেছেন মাত্র। খোদ ইয়াসির আরাফাতও এ হতে মুক্ত ছিলেন না। মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর ধন-সম্পদ তাই প্রমাণ করে। প্যালেস্টাইনি শিশু কিশোরদের বিকৃত ও বিভীৎস মৃতদেহ গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে আমরা হয়ত নিজেদের রাগ, ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করতে কার্পণ্য করছিনা। কিন্তু তাতে প্যালেস্টাইনই সমস্যার প্রতি কতটা আন্তরিকতা প্রকাশ করা হচ্ছে এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। ইসরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এ অঞ্চলে শান্তির কথা বলা একান্তই বাচালতা। ইহুদি মেধা ও সম্পদের কাছে গোটা বিশ্ব এখন পদানত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে শিক্ষা নিয়ে ওরা নিজেদের তৈরি করেছে কি করে বৈরী পৃথিবীতে বাস করা যায়। একবিংশ শতাব্দীর জটিল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে টিকে থাকতে চাইলে প্যালেষ্টাইনীদেরও খুঁজে বের করতে হবে সহাবস্থানের নতুন ফর্মুলা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s