‘বাঙলাদেশ’ এবং বাঙালী ও বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ

BD Map

মাহবুব মিঠু।।

এথনিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ে জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের মধ্যকার বিভ্রান্তি অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। কিম্বা সেটা হতে পারে স্বাধীনতা বা স্বার্বভৌমত্বের জন্য হুমকীস্বরূপ। অনেক ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তি কিছু মানুষের ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি। সেই ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে হোক আর যে কারণেই হোক, দেশ বিভাগের পর থেকে বঙ্গ অঞ্চলে সংস্কৃতির পরিচয়ে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের’ বন্ধন ক্রমশঃ ভিন্ন মাত্রায় চলে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ববঙ্গ) অনেক হিন্দু যেমন পশ্চিম বঙ্গে চলে যায়, তেমনি তার উল্টোটাও ঘটে। অর্থাৎ পশ্চিম বাঙলা থেকে অনেক বাঙালী মুসলিমও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া এই সীমানা, বিচ্ছিন্ন দুই বাঙলার মানুষের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। এর ফলে দুই বাঙলায় দুই ধরনের বাঙালী সংস্কৃতি বিকাশ ঘটে।

কোন সংস্কৃতি কখনোই অনড় কিম্বা অপরিবর্তনশীল নয়। ৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে যে রাজনৈতিক স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে তাতে উভয় পাড়েই ‘বাঙালী’ পরিচয় ছাপিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় অর্থাৎ ভারতীয় (বাঙালী) এবং পাকিস্তানী (বাঙালী) পরিচয়টাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙলাদেশ নামক ভূখন্ডের বাঙালী, ওপাড়ের বাঙালীদের চেয়ে স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করে। এই স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভের ফলে বাঙালী সাংস্কৃতিক বন্ধনের চেয়ে রাজনৈতিক বন্ধনটাই তখন মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নতুন পরিস্থিতিতে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে বসবাসকারীদের একই ছাতার নীচে, একই পরিচয়ে নিয়ে আসার জন্য সৃষ্টি হয় বাঙলাদেশী নামক রাজনৈতিক পরিচয়ে নতুন জাতীয়তাবাদ। এই বাঙলাদেশী পরিচয় বাঙলাদেশ নামের ভূখন্ডে বসবাসকারী নানা এথনিক গোষ্ঠীকে, নানা ভাষাভাষীকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়তা করে। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের বাঙালীদের চেয়ে আমাদের কাছে পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার অধিবাসীরা বেশী আপন হয়ে পড়ে। ঠিক এই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে ‘বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে’ ’বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ কেবল ক্ষুদ্রতাই তুলে ধরে না, বরং এটা একাধারে সাম্প্রদায়িকতা এবং বর্ণবাদের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে। এই ধারার লোকেদের তিনটি দুষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

প্রথমতঃ এরা কি উভয় পাড়ের বাঙালীদের নিয়ে নতুন কোন স্বাধীন ভূখন্ডের আশা মনে মনে পোষন করে? তাহলেও সেখানে ত্রুটি আছে। দুই বাঙলার একত্রীকরণের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকী জাতিস্বত্ত্বার অধিবাসীদের জাতীয়তা কি হবে? তাদেরকে কি বিতাড়িত করা হবে? নাকি বলা হবে ’তোমরা বাঙালী হয়ে যাও’।

 

দ্বিতীয়তঃ আমরা কি ওপাড় বাঙলার রাজনৈতিক পরিচয়কে অর্থাৎ বৃহত্তর ভারতের সঙ্গে একীভূত হতে চাই? এই মানসিকতাকে স্পর্ধা বললেও কম বলা হবে। এ ধরনের উদ্দেশ্য যদি কারো মনে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা যেতে পারে।

তৃতীয়তঃ বাঙালীদের খন্ডিত প্রতিনিধিত্ব করা স্বাধীন বাঙলাদেশের বাঙালীদের জাত্যাভিমান, যেটা ৭১ সালের পূর্বে পাকিদের মধ্যে ছিল। মূলতঃ পাকিদের এই জাত্যাভিমানই আমাদের স্বাধীনতার দাবীকে যৌক্তিকতা দেয়। এই যদি হয় উদ্দেশ্য, তাহলে সেটা পাহাড়ীদের বিচ্ছিন্নতার দাবীকেই গ্রহণযোগ্যতা দেবে।

 

এর বাইরে অন্য কোন কারণ থাকলে সেটা নিছক গোয়ার্তুমি কিম্বা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।

 

অতি আবেগী অনেকে কথায় কথায় ‘হাজার বছরের বাঙালী জাতীয়তাবোধ’ বলে রাজনৈতিক পরিচয়ের সাথে সম্পর্কিত উৎসবে গলা ফুলিয়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দেয়। আমাদের ভাষা আন্দোলন একান্তভাবেই বাঙালী জাতীয়তাবোধ থেকে আসে। কিন্তু স্বাধীনতার আন্দোলনের পিছনে কেবলমাত্র বাঙালী জাতীয়তাবোধ কাজ করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাহাড়ের জনগণও অংশ নিয়েছিল। অতএব, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের মতো বাঙলাদেশীদের স্বার্বজনীন উৎসবগুলোতে যখন কেউ গলা ফুলিয়ে, ঘাড় কাঁত করে বাঙালী জাতীয়তাবোধের তুবড়ি ফুটান, জেনে নিবেন, তারা আর কেউ নয়। নিতান্ত সাম্প্রদায়িক কিম্বা বর্ণবাদী মানসিকতার মানুষ।

 

এবার আসি বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মের সম্পর্ক। অস্বিকার করা যাবে না, এই অঞ্চলে ইসলামের আগে সনাতনী ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। একটা সময়ে ইসলাম প্রচারকদের আগমনে এই সনাতন ধর্মের অনেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। সেই সাথে পাল্টে যায় তাদের অনেক সাংস্কৃতিক আচার আচরণ। ধীরে ধীরে ইসলামের অনেক আচার আচরণ বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ে। সংস্কৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক অংগাঅংগীভাবে জড়িত। মানুষ বাদে মানুষের সংস্কৃতি কিভাবে সম্ভব? এ অঞ্চলে ইসলামের আগমনের সঙ্গে বাঙালী মুসলিম সংস্কৃতিরও উদ্ভব ঘটে। তেমনি হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পর্কিত কিছু সংস্কৃতি থেকে যায় বাঙালী হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে। দেখবেন বাঙালী হিন্দুদের ধর্মীয় অনেক আচার আচরনের সাথে ভারতের অন্যান্য হিন্দুদের আচার আচারণের পার্থক্য আছে। তেমনি বাঙালী মুসলমানদের সংস্কৃতির সাথেও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের সংস্কৃতিতেও একটু হলেও পার্থক্য আছে। অর্থাৎ হিন্দু কিম্বা মুসলমানি এই দুই ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে তার এথনিক বাঙালী পরিচয়কে কেন্দ্র করে একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটেছে। এই দুই ভিন্ন ধারার বাঙালী সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে আবার স্বার্বজনীন বাঙালী সংস্কৃতিও আছে যেখানে বাঙালী হিন্দু কিম্বা মুসলমানের কোন পার্থক্য নেই। নবান্ন উৎসব কিম্বা এ রকম আরো অনেক উৎসবে বাঙালী হিন্দু মুসলমান সবাই সমানভাবে অংশ নেয়।

তাই বাঙালী সংস্কৃতির নামে যারা ইসলামিক জীবনবোধকে দূরে ঠেলে দিতে চায় প্রকারান্তরে এই গোষ্ঠী অঞ্চলের মুসলমানদের এলিয়েন গোত্রে হিসেবে বিবেচনা করে। কিম্বা হতে পারে এটাও এক ধরনের সূক্ষ্ন সাম্প্রদায়িকতা

মানতেই হবে, বঙ্গ অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাবের ফলে এ অঞ্চলের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনে, তাদের আচার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটাও ক্রমে ক্রমে বাঙালী সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়ে। আগেই বলেছি, সকল সংস্কৃতিই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনটা ঘটে সময়ের সাথে যে চাহিদা সৃষ্টি হয় সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে। পরিবর্তনটা ঘটে সন্তর্পনে, অভিযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এতো কিছুর পরেও যারা ‘হাজার বছরের পুরাতন বাঙালী সংস্কৃতির’ জিকির তুলে মূলতঃ বাঙালী সংস্কৃতিতে ধর্মের প্রভাবকে অস্বিকার করে এটাকে (বাঙলা সংস্কৃতিকে) একটা জড়খন্ড বানিয়ে রাখতে চায় তাদের প্রকৃত ভাবনা আসলে কি? এরা কি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত সবাইকে বলতে চায়, ’যাও ফিরে যাও পুরাতন বিশ্বাসে’? এই আহবানে কি বাঙালী মুসলমান সাড়া দেবে? অবশ্য শেখ মুজিব একদা পাহাড়ীদের বলেছিলেন, ‘তোমরা সবাই বাঙালী হয়ে যাও?’ ভাবনায় এই বৈপরীত্য নিয়ে কিভাবে সম্ভব কোন ব্যাক্তির কিম্বা রাজনৈতিক দলের অধীনে অসাম্প্রদায়িক বাঙলাদেশের সূচনা করা?

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s