ফাহাম আব্দুস সালাম
এক:
কিছুক্ষণের জন্য কল্পনা করুন যে আপনি ১৯১৪ সালের কোলকাতার তরুণ। খুব মেধাবী, বয়স ১৮।
আপনি পড়াশোনায় ভালো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হবেন। আপনার বাবা মাঝারি মাপের একজন জমিদার কিংবা জমিদারির সাথে সম্পৃক্ত। আপনি যে পড়াশোনায় ভালো এর মূল কারণ হোলো আপনার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যেটা পুরো বাংলার ৯০ ভাগ ১৮ বছর বয়স্কর নেই, আর সেটা হোলো অবসর – পড়ার জন্য।
পেশা বলতে আপনার আছে কেবল দুটো অপশন: ওকালতি আর বেশ্যাবৃত্তি (নীরদ চৌধুরী থেকে ধার করে একটু মশকরা করলাম, সেকালে “পেশা” শব্দটার যে মানে ছিলো এখন তার অনেকটুকুই পাল্টে গেছে )। যেহেতু আপনি মেধাবী, পরিবার শিক্ষিত, আমি ধারণা করছি আপনি ব্যারিস্টার হওয়াটাকে জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি বলে ধরে নিয়েছেন।
আপনি ১২ বছর পড়ালেখা করেছেন মূলত ইংরেজি মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজিতেই পড়বেন, ওকালতি যে করবেন সেখানে দলিল দস্তাবেজের ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত ফার্সি মিশ্রিত বাংলা আছে যদিও (৮০ বছর আগে সরকারী কাজ কর্ম সব ফার্সিতেই হতো) কিন্তু উচ্চ আদালতে (যেখানে ব্যারিস্টারী পাশ করে আপনি ঢু মারবেন) ইংরেজি ছাড়া কোনো গতি নেই। মক্কেলের সাথে বাংলায় কথা বলা ছাড়া বাংলা ভাষার তেমন কোনো ব্যবহার নেই আপনার পেশায়।
তারপরও ভালো বাংলা জানার ব্যাপক ইনসেনটিভ আছে আপনার – সত্যিই ব্যাপক।
এলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কোনো অস্তিত্ব নেই। আজকের হিসাবে এন্টারটেইনমেন্ট বলতে আছে বইপত্র আর মাঝে মাঝে নাটক। গ্রামোফোন এসেছে মাত্র তের বছর – হিন্দুস্তানী গানের রেকর্ড করে প্রথম বিখ্যাত হয়েছেন গওহার জান মাত্র সাত-আট বছর আগে। যেহেতু তখনও গ্রামোফোন বেশ দামী এবং রেকর্ডের দামও মনে হয় কম না (গওহার জান প্রথম রেকর্ডিং এর জন্য পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৩০০০ রুপি – সোনার দাম দিয়ে এডজাস্ট করলে অন্তত ৬০ লক্ষ টাকা হবে এই মুহুর্তে) – গ্রামোফোন আপনার বাড়ীতে নাও থাকতে পারে। তওয়ায়েফ আপনার এফোর্ড করতে না পারারই কথা। যদিও সঞ্জয় দত্তের নানী জাদ্দান বাঈ (গুজব আছে এই মহিলা নাকি মতিলাল নেহেরুর প্রেমের সন্তান) এতোই বিখ্যাত যে ঢাকার মতো ছোটো শহরেও তার পোস্টার কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু তওয়ায়েফ দের কোঠায় গিয়ে বিনোদিত হতে হলে অর্থবিত্ত ও প্রতিপত্তি লাগে – সেটা এখনও আপনার হয় নি। কাজেই সন্ধ্যা বেলায় বিনোদন বলতে হয় নানান ধরনের বই পড়া নয়তো এই বই নিয়েই আলোচনা করা, বন্ধুবান্ধবদের সাথে। বয়স আরেকটু বেশি হলে আপনি হয়তো প্রেমিকা পুষবেন কিন্তু সেটা এখনই না।
তখনও পার্টিসিপেটোরী এলেকশান শুরু হয় নি ভারতে, কাজেই পলিটিশিয়ানরা তখনও হাটে ঘাটে মাঠে চাড়া দিয়ে ওঠে নি। আপনি যদি কলকাতার who’s who নিয়ে একটু গবেষণা করেন দেখবেন যে হয় এরা জমিদারীর সাথে সম্পৃক্ত, নয়তো লেখালিখি, শিক্ষক, ডাক্তার আর উকিল। এবং এটা কিন্তু খুবই ছোটো একটা সার্কেল – খুব বেশী হলে দশ হাজার মানুষের সার্কেল। এমন কি মহাত্মা গান্ধীও মূখ্যত একজন লেখক (তার রচনাসমগ্র ৫০ হাজার পৃষ্টার)। আপনি যদি তখনকার কোলকাতার ওপিনিয়ন মেকার হতে চান, সমাজে যদি একটু গুরুত্ব আশা করেন এবং যদি অমরত্বের প্রতি আপনার একটু দুর্বলতা থেকে থাকে – সত্যি বলতে কি খুব ভালো বাংলা জানা ছাড়া আপনার তেমন কোনোই আর বিকল্প নেই (অন্তত জানতে হবে, না লিখলেও চলবে)। আপনি যদি পত্রিকায় লেখালিখি না করেন কিংবা পত্রিকা নিয়ে আলোচনা করতে না পারেন আপনার সাথে হরিদাস পালের খুব পার্থক্য নেই। সময়টা একটু অদ্ভুত – লেখক ও পণ্ডিতরা তখন সত্যিই রকস্টার। যারা আপনার চোখে গুরুত্বপূর্ণ – অর্থাৎ সমাজের ব্রাইট মাইন্ডস এর প্রায় সবাইই ভালো বাংলা জানেন।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড টু ২০১৪।
আজকে ভালো বাংলা জানার যে প্রয়োজনীয়তা সেটা প্রায় শূণ্যতে নেমে এসেছে। ১৮ বছরের কোনো তরুণের যারা জীবিত হিরো তাদের প্রায় কেউই ভালো বাংলা জানেন না। আমার জানামতে এই ভাষার সর্বশেষ যে ব্যক্তিটি শুধুমাত্র লিখে জীবনধারণ করতেন সেই হুমায়ুন আহমেদও চলে গিয়েছেন। সাংবাদিক ছাড়া আমাদের এই দেশে এ মুহুর্তে সম্ভবত এমন একজনও নেই যিনি শুধুমাত্র লেখালিখি করে সম্মানজনক ভাবে বেঁচে আছেন।
ডিলেমাটা লক্ষ্য করুন। একশ বছর আগে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরে পেশাগত ভাবে ইংরেজি জানা আবশ্যক হলেও সামাজিক গুরুত্ব পেতে হলে ভালো বাংলা না জানার তেমন কোনো উপায়ই ছিলো না। আর এখন বাংলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে ভালো বাংলা জানার তেমন কোনোই প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং ভালো ইংরেজি জানলে আপনার সামাজিক ও পেশাগত – দু দিক দিয়েই পোয়াবারো।
যারা আপনার সময়ের ব্রাইট মাইন্ড তারা প্রায় সবাইই ভালো ইংরেজি শেখা নয়তো ব্যবহার করায় ব্যস্ত।
দুই:
মানুষ চিরকালই প্রয়োজনের কারণে ভাষা আয়ত্ত করেছে। এখানে দুটো প্রয়োজন আছে। একটা হোলো আনুভূমিক প্রসার অর্থাৎ একদম মৌলিক ভাব প্রকাশ – দোকানীর সাথে আলাপ, রিক্সাঅলার সাথে দরাদরি – এসব। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে বাংলা ভাষা শিক্ষা সেই প্রয়োজন আগামী দু- তিন শ বছরেও কমবে না – সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে আমরা নিরাপদ আছি। কিন্তু ভাষা শিক্ষার আরেকটা প্রয়োজন আছে যেটা হোলো উলম্ব প্রসার অর্থাৎ বিশেষায়িত যোগাযোগ। এই যেমন আমি এখন যে কাজটা করছি কিংবা আমি যদি আমার পেশা জীব বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালিখি করি বা শিক্ষকতা করি।
মনে রাখবেন ভাষার “উন্নতি” বলতে আমরা যা বুঝি সেটা কিন্তু বিশেষায়িত যোগাযোগের মধ্য দিয়েই শুরু হয়। দশম শতাব্দীতে হাসান ইবন আল হাইথাম বা আলহাজেন ক্যামেরা অবস্কিউরার প্রোটোটাইপ আবিষ্কার করলেন। মানে তিনি একটা বন্ধ ঘর বা চেম্বারে শুধু ছোট্ট একটা ফুটা দিয়ে আলো ঢুকতে দিলেন। ঐ ফুটার বিপরীত দেয়ালে উল্টা প্রতিবিম্ব তৈরী হোলো। আরবীতে চেম্বার কে কামারা বলে, ঠিক যেভাবে আমরা বাসার ঘরকে বলি কামরা। সেই কামারা ল্যাটিনদের হাত ধরে ইংরেজিতে এলো ক্যামেরা হিসেবে। এখন ক্যামেরা আর কোনো “বিশেষ” সায়েন্টিফিক টার্মিনোলজি না কিন্তু এককালে ছিলো। ঠিক তেমনি পাটনার শেখ দ্বীন মোহাম্মদ চাপানো (চাপ দেয়া) অর্থে হিন্দুস্তানী “চাপনা”র ইমপেরাটিভ ভার্ব চাম্পু শব্দটা ব্রিটেনে ব্যবহার করলেন ১৭৯০ এর দিকে। মানে ডলাডলি দিয়ে মালিশ। সেই চাম্পু বদলাতে বদলাতে হয়ে গেলো শ্যাম্পু। এখন সবাই শব্দটা ব্যবহার করে মূল শব্দটা না জেনে।
বাংলা ভাষাতেও এ ধরনের উদাহরণের শেষ নেই। প্রশ্ন হোলো প্রথম দিকে যিনি একটি ভাষায় অন্য একটি ভাষার শব্দ ব্যবহার করবেন তাকে যদি সেই ভাষাটা ব্যবহার করতেই না হয় তাহলে সেই ভাষায় নতুন এক্সপ্রেশান ঢুকবে কীভাবে? অন্যভাবে আপনি যদি আপনার ভাষার ব্রাইট মাইন্ডসকে আপনার ভাষা ব্যবহার করাতে না পারেন তাহলে আপনার ভাষার “উন্নতি” হবেটা কীভাবে?
তিন:
বাস্তবতা হোলো জীবিকার তাড়না হোক, পেশার কারণে হোক অথবা সামাজিক চাপ – গত বিশ-তিরিশ এই জাতির সবচেয়ে মেধাবী মানুষেরা ইংরেজি শিক্ষায় যতোটা মন দিয়েছেন, বাংলায় ততোটা দেন নি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা মূর্খতা, বাহাদুরী না। এই ট্রেন্ড যে আমার জীবদ্দশায় যে বদলাবে না সে নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য গবেষক হতে হয় না। বরং দিনে দিনে এটা বাড়বে। লিখে রাখুন – এখন থেকে তিরিশ বছর পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল সাহিত্যিক বাংলাদেশে বসেই ইংরেজিতে উপন্যাস লিখবেন এবং আপনি সেই উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ পড়বেন। বাংলা ভাষায় লেখালিখি করে সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকা তো অনেক দূরের কথা – একজন ঔপন্যাসিক যে পরিমাণ খাটাখাটনি করে একটা ভালো উপন্যাস লিখবেন তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পাঠকই নেই বাংলাদেশে। তিরিশ বছর পরের মেধাবী ছেলেটি মনে করবে এর চেয়ে ভালো ইংরেজিতে লেখা কারণ সারা পৃথিবীতেই তার পাঠক আছে।
কিন্তু আমার আগ্রহ সাহিত্য না ঠিক। আমি আগেই দেখিয়েছি যে বাংলা ভাষায় বিশেষায়িত ভাব প্রকাশের সক্ষমতা সীমিত – ইংরেজির তুলনায়। এবং যেহেতু ভালো ইংরেজি শেখার পেশাগত ও সামাজিক সুবিধা মাত্রাতিরিক্ত বেশী (আপনি এমন কাওকে চেনেন যিনি খুব ভালো ইংরেজি জানেন কিন্তু খুব ভালো উপার্জন করেন না?) সেহেতু যারা এই জাতির ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন অর্থাৎ মেধাবী ও সফল পেশাজীবী তারা সবাই উমদা বাংলা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাবেন। বুঝতে হবে যে বাংলাদেশে সোশাল আপওয়ার্ড মোবিলিটির একটা বড় নিয়ামক হোলো ইংরেজি।
আমরা যদি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই অর্থাৎ বাংলার প্রসার ও উন্নতি চাই তাহলে ইংরেজি শিক্ষার কারণে যে সামাজিক ও পেশাগত সুবিধার সিড়ি সৃষ্টি হয় সেটাকে ভাঙ্গতে হবে – ভাঙ্গতেই হবে।
কীভাবে ভাঙ্গা যাবে?
দুটো উপায় আছে। প্রথমটা হোলো কেউ ইংরেজি শিখতে পারবে না। আমরা সবাই শুধু বাংলা শিখবো এবং এই জাতির কেউ ইংরেজি জানবে না। আশা করি এই য়ুটোপিয়ান চিন্তার অসারতা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়টা হোলো আমরা সবাই বাই-লিঙ্গুয়াল হবো অর্থাৎ বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে ইংরেজি শিখতে হবে।
চার:
খেয়াল করুন এখন ইংরেজি শিক্ষা জনিত যে ফুটানি তার মূল কারণ হোলো অল্প কিছু মানুষ ভালো ইংরেজি জানেন এবং বাকীরা জানেন না। আমি মনে করি এই অল্প কিছু মানুষ অত্যন্ত অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন শুধুমাত্র একটা বিদেশী ভাষা জানার কারণে। যে কলোনিয়াল মেন্টালিটির সমালোচনায় রাত কাবার করি অনায়াসে তার কারণও হোলো এই অল্প কিছু মানুষের ইংরেজি-জানা জনিত সুযোগ সুবিধা। তারা একটি ভাষার সফল ব্যবহার করাটাকে এক বিশাল সক্ষমতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে – যেটা শুধু অন্যায্যই না, হাস্যকরও বটে। তবে এটাও ঠিক যে ভালো ইংরেজি জানলে আপনি দেশের বাইরে এমন সব সুযোগ-সুবিধার মুখোমুখি হবেন যেটা অন্য কোনোভাবেই সম্ভব না।
এই অবস্থার পরিবর্তন হবে শুধু তখনই যখন গ্রামের ছেলেটাও চোস্ত ইংরেজিতে যোগাযোগ করবে। আশ্চর্য হবেন না, আশি বছর আগে এই বড় বঙ্গেই ঘটনাটা অহরহ ঘটতো। তখনকার গ্রামের ছেলেটা গ্রামে থেকেই ভালো ইংরেজি শিখে, মেধার জোড়ে নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো। ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।
আমার যে থিসিস তার এতোটুকু সবাই মেনে নেন একটু ভাবনা চিন্তার পরে। মানতে পারেন না এর পরের অংশটুকু।
পাঁচ:
আমি আগে বিস্তারিত ভাবে প্রমিত বাংলার সমস্যার কথা লিখেছি। প্রমিত বাংলার বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের ভাণ্ডার বিপজ্জনক রকমের অপ্রতুল এবং এই বাংলার একটা পিউরিটান চরিত্র আছে। এই শুদ্ধবাদী মেজাজ শুধু ভাষা না আমাদের জীবনযাত্রাকেও ঘিরে ফেলে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক আপনি পনের বছরের একজন কিশোরী এবং কথা বলছেন আপনার বাবার সাথে এমন একটি বিষয়ে যা নিয়ে কথা বলাটা একটু লজ্জাজনক – মনে করি আপনি আপনার যোনীপথ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান – হয়তো কোনো শারীরিক সমস্যার কথা। খেয়াল করুন যে সামাজিক ভাবে স্বীকৃত অযৌনাত্মক কোনো সভ্য টার্মিনোলজি নেই আপনার শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের। আপনি সম্ভবত আকারে ইঙ্গিতে ভাবটা প্রকাশ করবেন। আমি বলছি না যে শুধুমাত্র প্রমিত বাংলার কারণেই এই সংকোচ তৈরী হয়েছে – ধর্ম এবং আমাদের সামাজিক রক্ষনশীলতাও এর একটি বড় কারণ – মানছি। কিন্তু প্রমিত বাংলা এই সংকোচকে ধারণ করতে সহায়তা করে।
কীভাবে করে?
প্রমিত বাংলা শুদ্ধবাদী বলে সে নতুন শব্দকে এই ভাষায় ঢুকতে বাধা দেয়। ফলে সে ভাষার যে স্টেটাস কো সেটাকে ধরে রাখে। যেমন ধরুন পনেরো বছরের এই মেয়েটি যদি আপনার সন্তান না হয়ে বাসার কাজের মেয়ে হয়ে থাকে তাহলে সে সম্ভবত যোনীপথ বলতে পারবে না, এমন কি জেনিটাল বা ভ্যাজাইনা বলে যে মুখ রক্ষা করবে সে উপায়ও তার নেই। খুব সম্ভব (আমার ধারণা) তার জানা একমাত্র শব্দ এক্ষেত্রে হোলো ভোদা। এই শব্দটা হোলো ভদ্রলোকদের মাথায় এয়ারপোর্টে বসানো মেটাল ডিটেক্টরে ঘন্টা বাজার মতো। কোনো মেয়ে যদি ভুলেও শব্দটা উচ্চারণে জানায়, সাথে সাথে সে ইতর মানুষে পরিণত হবে। খেয়াল করুন যে বাংলা ভাষায় জঘন্য শব্দের অর্থ হচ্ছে ঘৃণিত বা গর্হিত। শব্দটা এসেছে জঘন থেকে যার মানে হোলো মেয়েদের শরীরের তলপেটের যে অংশটুকু সামনে থেকে দেখা যায় – অর্থাৎ গ্রোয়েন। জঘন ও জঘন্যের মাঝে যে যোগাযোগ সেই যোগাযোগই আপনাকে বুঝিয়ে দেয় এই ভাষার পিউরিটান চরিত্রের কথা।
আমার কাছে কোনো ডেটা নেই, এমন কি কোনো সায়েন্টিফিক রিজনিংও নেই, কিন্তু আমার ধারণা খুব ছোটো বয়সে যখন আপনার ব্রেইন হার্ড ওয়্যার হওয়া শুরু করে, যেহেতু সেটা আপনার প্রথম ভাষাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সেহেতু আপনি বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পৃথিবীকে দেখতে শুরু করেন – এবং আমার হাইপোথিসিস হোলো প্রমিত বাংলার এই রক্ষণশীলতা আপনার মানসিকতাকেও রক্ষণশীল করে তোলে (আবারও বলছি – এটা আমার অনুমান মাত্র)।
এছাড়াও খুব বড় সমস্যা আছে। প্রমিত বাংলা বা তার কাছাকাছি বাংলায় বাংলাদেশের শতকরা এক ভাগ কথা বলেন কি না আমার সন্দেহ আছে। ফলে আমরা আসলে দুটো বাংলা শিখি জীবনে। দুটো বাংলা শেখাকে আমি কোনো সমস্যা মনে করি না কিন্তু একটি বাংলার আপাত শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবকে মেনে নেয়ার তীব্র আপত্তি আছে আমার। কারণ এই গৌরবে বাকবাকুম হয়েই প্রমিত বাংলা মৌলবাদী হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে।
ছয়
আমি বলতে চাইছি যে বাংলা ভাষার অপ্রতুলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে বড় অন্তরায় হোলো প্রমিত বাংলা নিজে। তাহলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি কোথায়?
আমি কোনো ভাষাবিদ নই, বাংলা ভাষার একজন সামান্য ব্যবহারকারী। আমি আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করছি মাত্র।
বাংলা ভাষাকে এমন একটা পর্যায়ে যেতে হবে যেখানে ভালো বাংলা জানা আর ভালো ইংরেজি জানা সমার্থক হয়ে উঠবে। এই ফ্লুয়িড অবস্থাটায় আপনি বাংলা ব্যবহার করবেন না ইংরেজি ব্যবহার করবেন সেটা হবে একটা ভাষিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক গুরুত্বারোপের সিদ্ধান্ত না। কিছু লক্ষণ এখনই দেখা যাবে যদি আপনি দেখতে আগ্রহী হন। ব্লগস্ফেয়ারের বাংলায় যে পরিমাণ ইংরেজি শব্দ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সে পরিমাণ ইংরেজি আগে কখনোই ব্যবহৃত হয় নি। যারা ব্যবহার করছেন তারা কী ভেবে ব্যবহার করছেন একটু চিন্তা করুন। তারা মনে করছেন আমার এই লেখা যারা পড়ছেন তারা যদি মোটামুটি ইংরেজি না জানেন তাহলে আমার লেখা পুরাপুরি বুঝতে পারবেন না। অর্থাৎ মোটামুটি ইংরেজি না-জানামূলক যে সম্ভাব্য সমস্যা সেটাকে তিনি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করছেন। তার দৃষ্টিতে যে মোটেও ইংরেজি জানে না সে যদি তার লেখা নাই বা পড়ে, কোনো সমস্যা নেই।
এখন এই ধারণাটিকে খুব বড় পরিসরে পর্যালোচনা করুন।
আমি এমন একটা সময়কে কল্পনা করছি যখন প্রত্যেক লেখকই শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুমান করবেন যে আমার পাঠক ইংরেজি শব্দগুলো জানে। তখন আমাদের এমন কিছু কনভেনশনে আসতে হবে যে কী ধরনের প্রত্যয় যোগ করলে একটা ইংরেজি শব্দকে অনায়াসে বাংলা বলে চালানো যাবে, সেটা সবাই জানবে। যেমন ধরুন গুগল করো না বলে আমরা বলবো গুগলাও। আমাদের পদবাচ্য বা সিনট্যাক্স যেহেতু ইংরেজির আদলেই গড়া সেহেতু আমি মনে করি না এ ধরনের কনভেনশনে গ্রহীতার পক্ষে শব্দগুলো নেয়া খুব সমস্যাকর হবে।
কিন্তু বাংলা ভাষার এই স্ট্রাকচার ধারণ করতে হলে আমাদের কে অপ্রমিত বাংলার শরণাপন্ন হতে হবে। অর্থাৎ আবার জিগস ঘরানার বাংলা। আমি এই বাংলাকে সম্ভাবনাময় মনে করি ঠিক এ কারণে না যে অপ্রমিত বাংলা মাত্রই দুর্দান্ত চাছাছোলা বাংলা। কিন্তু এই বাংলা অভিভাবকত্বে জর্জরিত না, যে কেও যেভাবে ইচ্ছা দুমড়ে মুচড়ে ব্যবহার করতে পারছেন – যে কারণে অপ্রমিত বাংলার পক্ষে সম্ভব হবে বিশাল পরিবর্তনকে ধারণ করবার। যে কেউ যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করবে, এই স্বাধীনতার থেকেই একটা ভাষার উন্নতি – এই চেনা পথটা রুদ্ধ হয়েছে প্রমিত বাংলার অভিভাবকত্বে।
সাত
একদম শেষ কথা, বাস্তবতার কথা। আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা যে বাংলা ভাষা শক্তিশালী ও গৌরবময় হয়ে উঠবে। এই আকাঙ্ক্ষা সত্য হবে শুধুমাত্র – আরেকবার বলছি – শুধুমাত্র তখনই যখন এই দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষেরা স্বচ্ছন্দে ভাষাটা ব্যবহার করবেন। অদূর ভবিষ্যতে আমি এমন কোনো সম্ভাবনা দেখি না যে এ দেশের সফল ও মেধাবী মানুষগুলোর পার্থিব উন্নতির জন্য বাংলা ভাষা জানাটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে ভালো ইংরেজি জানা আর ভালো বাংলা জানা বেশ কাছাকাছি পর্যায়ের সক্ষমতা সেক্ষত্রে আমরা আশা করতে পারি যে বাইলিঙ্গুয়াল হওয়ার সুবিধাটা তারা প্রয়োগ করবেন।